প্রেম মানে না কোনো শাসন-বারণ। প্রেম মানে না কোনো সীমানা ও ভূখণ্ড। সাত সাগর তের নদী পেরিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকার মিলনেই যেন প্রেমের সার্থকতা। এমন মর্মার্থে প্রায়ই বাংলাদেশে ছুটে আসছেন বিদেশি প্রেমিক-প্রেমিকা। এসব ঘটনা দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করলেও এর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে বলে দাবি করছেন বিশেষজ্ঞরা।

 


সম্প্রতি প্রেমের টানে বিদেশিদের বাংলাদেশে আগমন আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বিগ্ন তারা।

 

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রেমের টানে যারা বাংলাদেশে ঢুকছেন তাদের অধিকাংশই লোভী প্রকৃতির একটি চক্র। চক্রটি বিভিন্ন দেশের ধনী ছেলে-মেয়েদের টার্গেট করে। পরে টার্গেট মিস হলে তারা আবার নিজ দেশে ফিরে যান। বিষয়টি নিয়ে দেশবাসীর সচেতন হওয়ার এখনই মোক্ষম সময়।


 
তারা বলেন, প্রযুক্তির বদৌলতে এসব সম্পর্কের দ্রুত প্রসার ঘটছে। 

গত ৫ আগস্ট প্রেমের টানে বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার জেলা পরিষদের ডাক বাংলোতে অবস্থান নেন ভারতের তামিলনাডু থেকে আসা যুবক প্রেমকান্ত। ভারতীয় এই যুবক জানান, প্রেমিকা ও তার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করা ছাড়া তিনি নিজ দেশে ফিরবেন না।

গত ১৮ জুলাই প্রেমের টানে গাজীপুরের জোলারপাড় এলাকার জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িতে ছুটে আসেন মালয়েশিয়ান যুবতী। পরে তাদের বিয়ে হয় ধুমধাম করে। মসজিদে অনুষ্ঠিত এই বিয়েতে হাজির হয়ে গ্রামবাসী আনন্দ উল্লাস করেন।

 

একই জেলার শ্রীপুর উপজেলার বরমী কুমারভিটা এলাকায় ইমরান খান নামে এক যুবকের প্রেমের টানে আমেরিকা থেকে লিডিয়া লুজা নামে এক তরুণী বাংলাদেশে ছুটে আসেন।

গত ১১ জুলাই ভোরে তিনি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান।

লিডিয়া লুজা খান ভোরে বিমানবন্দরে পৌঁছালে বরমীর যুবক ইমরান খান তাকে স্বাগত জানিয়ে বাড়িতে তোলেন। ঈদের পরদিন ভিনদেশি এক তরুণী পারিবারিক সদস্য হয়ে আসায় ওই পরিবারের লোকজনের ঈদ কেটেছে একটু ভিন্ন স্বাদে।

প্রেমের টানে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে রাজশাহী আসেন ২০ বছর বয়সী মালয়েশিয়ান তরুণী স্যান্ডি। মন দেওয়া-নেওয়ার পর অবশেষে গাঁটছড়া বাঁধেন প্রেমিক জুলফিকারের সঙ্গে।

জুলফিকার রাজশাহী মহানগরীর বিনোদপুর এলাকার মৃত আব্দুস সাত্তারের ছেলে। জুলফিকার প্রায় ৮ বছর আগে পড়ালেখার জন্য মালয়েশিয়ায় যান। সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন একটি চাকরিও করতেন। ওই সময় জুলফিকারের সঙ্গে পরিচয় হয় এই তরুণীর।

 

এই পরিচয় একটা সময় পর পরিণেয় রূপ নেয়। এরপর দুইজনের মধ্যকার প্রেমের সম্পর্ক আরো গভীরতা পায়। শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার টানে বাবা-মাকে ছেড়ে উড়ে আসেন রাজশাহীতে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে লিডিয়া লুজা নামের এক তরুণী প্রেমের টানে চলে এসেছেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমী কুমারভিটা এলাকার যুবক ইমরান খানের কাছে

কুমিল্লার রাসেল জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমান মালদ্বীপে। কাজের সূত্রে ২০২০ সালের মাঝের দিকে মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে রাসেলের সঙ্গে পরিচয় হয় সে দেশের তরুণী হাব্বা আহমেদের সঙ্গে। পরিচয় থেকে প্রেম, তারপর ২০২১ সালের অক্টোবরে মালদ্বীপেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন দু'জন।

 

গত ২৪ জুলাই মালদ্বীপের তরুণীকে নিয়ে দেশে এসেছেন রাসেল। বরুড়া উপজেলা পয়ালগাছা ইউনিয়নের গন্ডামারা গ্রামের আব্দুর রশিদের বড় ছেলে মোহাম্মদ রাসেল। হাব্বা আহমেদ মালদ্বীপের মালে সিটির আহমেদ দিদি'র মেয়ে। হাব্বা আহমেদ ও মোহাম্মদ রাসেল মুসলিম রীতিনীতে বিয়ে করেন মালদ্বীপের মালে সিটিতে।

প্রেমের টানে ভারত থেকে বাংলাদেশে এসে বিয়ে করেছেন এক নারী। তার নাম বহ্নিশিখা ঘোষ ওরফে ফারজানা ইয়াসমিন।

ফেসবুকে পরিচয়ের সুবাদে চার বছর প্রেমের পর কয়েক মাস আগে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জেঠুয়া গ্রামে আসেন ওই নারী। এরপর ওই গ্রামের রেজাউল ইসলাম আকুঞ্জির ছেলে ইব্রাহিম হোসেন মুন্নাকে বিয়ে করেন। 

প্রেমের টানে হাজারও মাইল পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা বরগুনার তালতলীতে ভারতের তামিলনাড়ুর নাগরিক প্রেমকান্ত

 

২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির জামালপুর বাজারের মিষ্টির দোকানি বলাই ঘোষের ছেলে শ্যামলী পরিবহনের সুপারভাইজার সঞ্জয় ঘোষের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রেম হয় ব্রাজিলের সাওপাউলোর বাসিন্দা সরকারি চাকরিজীবী ২৯ বছর বয়সী জেইসা ওলিভেরিয়া সিলভারের। দীর্ঘ দেড় বছর প্রেম করার পর তারা সিদ্ধান্ত নেন সারা জীবন থাকবেন একসঙ্গে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৭ সালের পহেলা এপ্রিল ব্রাজিল থেকে রওনা হয়ে ৩ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় ঢাকায় পা রাখেন ব্রাজিলিয়ান তরুণী সিলভা।

৬ এপ্রিল ২০১৭ সালে বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর ১০ এপ্রিল (সোমবার) ঢাকা ছেড়ে ব্রাজিলে পাড়ি জমান জেইসা ওলিভেরিয়া সিলভা। এরপর থেকে পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাদের।

 

প্রেমের টানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এসেছেন রাইয়ান কফম্যান নামে এক মার্কিন যুবক। গত ২৯ মে প্রেমিকার নানা বাড়ি গাজীপুরে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের মিশৌরী স্টেটের ক্যানসাস সিটির এই নাগরিক। আসার পর ওই মুসলিম তরুণীকে বিয়েও করেছেন তিনি। 

সম্প্রতি প্রেমের টানে বিদেশিদের বাংলাদেশে প্রবেশের সংখ্যা বৃদ্ধি সম্পর্কে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুর রশিদ বলেন, প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে এ দেশ থেকে অনেকে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, আবার অনেক বিদেশিও এ দেশে আসছেন। এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। অতীতেও এ ধরনের ঘটছে ভবিষ্যতেও ঘটবে। এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তবে সামাজিক জটিলতা যেন তৈরি না হয়, সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ভিন্ন দেশ থেকে অনেকে আমাদের দেশে আসতেছে তাদের উপর নজর রাখা উচিত। অনেক কারণেই বিদেশি নাগরিকরা বাংলাদেশে আসতে পারে। তারা বাংলাদেশে যদি ব্যবসা করে তাহলে তা করতেই পারে। যেই বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে সেটি হলো আমাদের দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে কি না কেননা শ্রীলংকায় কিন্তু এমনটা হয়েছে। শ্রীলংকার ধনী শ্রেণি দীর্ঘদিন এই টাকা পাচার করেছিল। আর যারা বিদেশি আছে তারা আমাদের দেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কিছু করছে কি না! এই সার্বিক বিষয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর নজর রাখা উচিত।

 

তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশ থেকে অনেকে বিদেশে যাচ্ছেন নানা কারণে তারা যদি সেখানে গিয়ে কাজ করে দেশে টাকা পাঠায় তাহলে তা আমাদের দেশের জন্য ভালো কিন্তু যদি দেখা যায় তারা এদেশ থেকে টাকা পাচার করছেন তাহলে সেদিকে আমাদের কঠোর নজর রাখা উচিত। কারণ মানি লন্ডারিং আমাদের দেশ থেকে অনেক উন্নত দেশে যায় তাই বাংলাদেশ সরকারের আরো চিন্তাভাবনা করা দরকার। যারা বিদেশে যাচ্ছেন তারা যাতে সেখানে স্থায়ী না হয়ে যায় বা থেকে গেলেও বাংলাদেশ থেকে সম্পদ না নিয়ে যান। এ বিষয়ে যদি নজরদারি বাড়ানো না হয় এবং পরিকল্পনা না করা হয় তাহলে বাংলাদেশ বড় আকারের ক্ষতির দিকে যাবে।

 


সিলেটভিউ২৪ডটকম/ডেস্ক/এসডি-২২


সূত্র : ডেইলি বাংলাদেশ