যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই/যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই/তবে বিশ্ব পেতো এক মহান নেতা, আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা/যে মানুষ ভিরু কাপুরুষের মতো, করেনি কো কখনো মাথা নত/এনেছিল হায়েনার ছোবল থেকে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা।

উপরের লাইন কয়টি গীতিকার হাসান মতিউর রহমানের লেখা, শিল্পী-সুরকার মলয় কুমার গাঙ্গুলীর সুরারোপিত এবং বরেণ্য কন্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়সমিনের গাওয়া কালজয়ী একটি গানের কয়েকটি কলি। বঙ্গবন্ধু ঘাতকের বুলেটে নিহত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেছেন আজ থেকে দীর্ঘ ৪৭ বছর আগে। তার পরেও ভাবতে ইচ্ছে করে তিনি বেঁচে আছেন। কল্পনা করতে ইচ্ছে করে সেই দুর্বার অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলির কথা। উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠি আজন্ম সংগ্রামি বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে আটকে রেখেছে, তাঁরই মুক্তির দাবিতে ছাত্র-জনতার মিছিলে-আন্দোলনে রাজপথ উত্তাল। কিংবা স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে, তিনি নিহত হননি, শতবর্ষী বঙ্গবন্ধু তাঁরই হাতে গড়া স্বাধীন বাংলাদেশে আজও বেঁচে আছেন। কিন্তু বাস্তব বড় পীড়াদায়ক। কোন কোন স্মৃতি বড়ই বেদনার, কাল-কালান্তর ধরে জাতিকে বয়ে বেড়াতে হয় দুঃসহ বেদনা। এক ভয়াবহ স্মৃতি নাম পনের আগষ্ট উনিশ শ’ পঁচাত্তর। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে স্বপরিবারে।


বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স ১০০ বছর অতিক্রম করত। নিঃসন্দেহে জীবনকালটি একজন মানুষের জন্য খুব বেশি, তবে একেবারে অবাস্তব তো কিছু নয়। বিশ্বে শতায়ু রাষ্ট্রনায়ক অতিতে অনেক ছিলেন, বর্তমানেও কাছাকাছি বয়সের অনেকে আছেন। কৃতি সাংবাদিক সওগাৎ পত্রিকার সম্পাদক মো. নাসিরুদ্দিন মারা যাবার আগে তাঁর বয়স হয়েছিল ১০৬ বছর। বৃটেনের বর্তমান রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের বয়স ৯৭ বছর অতিক্রম করেছে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই বেঁচেছিলেন ৯৯ বছর। আশি বছর বয়সে আততায়ীর গুলিতে নিহত হবার আগে মহাত্মা গান্ধী নিজেই ঘোষনা দিয়ে বলেছিলেন তিনি শতায়ু হবেন। বঙ্গবন্ধুও জীবদ্দশায় একজন সুঠামদেহী সুস্থ শরীরের অধিকারী ছিলেন এবং তাঁর পিতা-মাতাও দীর্ঘজবিী ছিলেন। তাই স্বভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ পেলে, তিনি দীর্ঘজীবি হতেন এটুকু কল্পনা করা অমূলক নয়।

যুদ্ধবিধ্বস্ত এই স্বাধীন বাংলাদেশকে সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন লালিত ছিল বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে তার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বেতার ও টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ’শ্মশান বাংলাকে সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই, সেই বাংলায় আগামি দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমাদের সাধারণ মানুষেরা যদি আশ্রয় না পায়, খাবার না পায়, যুবকরা যদি চাকুরি বা কাজ না পায়, তাহলে আমাদের এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে।’

ধ্বংসস্তুপের উপর সমৃদ্ধির ইমারত গড়তে যে সময় প্রয়োজন, যুদ্ধোত্তর সময়ে বঙ্গবন্ধু সে সুযোগ পাননি। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন সত্যিকার মুক্তি। ক্ষুধা থেকে, দারিদ্র্য থেকে, অবিচার থেকে, নির্যাতন থেকে মুক্তি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর বৃহত শক্তি যে অর্থ ব্যায় করে মানুষ মারার জন্য অস্ত্র তৈরী করছে, সেই অর্থ গরীব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’

মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত যখন স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন তাঁর বয়স আশির কাছাকাছি। আর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে যখন বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন তাঁর বয়স মাত্র ৫০ অতিক্রম করেছে। মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে যে নেতা একটি দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়ে জাতির জনকের মর্যাদা অর্জন করতে পারেন, তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনায় পরিণত ও দক্ষ বঙ্গবন্ধু আরও ৪০-৫০ বছর বেচে থাকলে দেশকে কোন উচ্চতায় নিয়ে যেতেন সেই ধারণা করা অবাস্তব কিছু নয়।

স্মৃতিকে স্বপ্ন মনে হয়। মনে হয় বঙ্গবন্ধু মরেননি। সে এক দুঃস্বপ্ন, তিনি বেঁচে আছেন। পাল তোলা নৌকা দেখলে, লাল-সবুজের পতাকা দেখলে, শিশুদের কলকাকলি দেখলে এখনও মনে হয় বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন। ঘাতকের বুলেট তাঁকে শারীরিকভাবে অন্তর্হিত করেছিল বটে, কিন্তু মহাকালের নিরিখে তিনি অগ্নিশিখার মত আমাদের হৃদয়ে দেদিপ্যমান। যত দিন যাচ্ছে, তিনি আমাদের চৈতন্যে অমোঘ ও অবিনাশী হয়ে উঠছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতাকে উদ্যেশ্য করে বলেছেন, ’তুমি ঘুমাও পিতা শান্তিতে। তোমার বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যচ্ছে, এগিয়ে যাবে। আমরা জেগে রইবো তোমার আদর্শ বুকে নিয়ে।’

জীবদ্দশায় তো সংগ্রাম, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আর কারাবরণ নিয়েই কাটিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। শান্তিতে ঘুমোনোর সুযোগেই ঘটেনি। আর স্বাধীনতা উত্তর সময়ে বিদ্ধস্ত দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার আগেই বিদায় নিতে হল স্বল্পায়ুর কারনে। ফলে শান্তির ঘুম ঘুমানোর মত সুযোগ বেঁচে থাকতে ঘটেনি। তাই পিতা-মাতার পাশেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন শান্তির নীড়, অনাবিল ঘুমের অফুরন্ত সময়। জাতির জনকের এই শাহাদাৎবার্ষিকীর প্রাক্কালে তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি অশ্রæসিক্ত হৃদয়ে শ্রদ্ধা জানাই।


লেখক: অধ্যাপক, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।