ছবি: মোজাম্মেল হক।

চা শ্রমিক আন্দোলন নতুন মোড় নিয়েছে। কাল রাতে মৌলভীবাজারে প্রশাসনের সাথে চা শ্রমিক ইউনিয়নের বৈঠকে কাজে যোগ দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা প্রত্যাখ্যান করেছেন সাধারণ শ্রমিকরা। তারা ‘রাতের অন্ধকারের সিদ্ধান্ত’ মানেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলনে অনড় রয়েছেন তারা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গতকাল রোববার রাত ৯টায় মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে প্রশাসন ও চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়। দীর্ঘ সেই বৈঠক শেষ হয় রাত তিনটার দিকে।


বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে, আজ সোমবার থেকে শ্রমিকরা ১২০ টাকা মজুরিতেই কাজে যোগ দেবেন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলে নিজেদের দাবিদাওয়া জানাবেন তারা।

কিন্তু গভীর রাতে শেষ হওয়া বৈঠকের সিদ্ধান্ত আজ সকালে জানতে পেরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন চা শ্রমিকরা। বিভিন্ন ভ্যালি এবং পঞ্চায়েত কমিটির নেতারাও কেন্দ্রীয় নেতাদের ওই সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় কমিটির ওপরই অনাস্থা প্রকাশ করছেন ভ্যালি এবং পঞ্চায়েত কমিটির নেতারা। সাধারণ শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে তারা ৩০০ টাকা মজুরি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

জানতে চাইলে চা শ্রমিক ফেডারেশনের সংগঠক অজিত রায় সিলেটভিউকে বলেন, ‘রাতের অন্ধকারের সিদ্ধান্ত শ্রমিকরা মানে না। রাতের সিদ্ধান্ত চোর-ডাকাতের সিদ্ধান্ত। এমন সিদ্ধান্তে শ্রমিকরা খুবই ক্ষুব্ধ। সিলেট ভ্যালি, শ্রীমঙ্গল বালিশিরা ভ্যালি, কমলগঞ্জ ভ্যালিসহ সবখানে শ্রমিকরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কাজে যোগ দেয়নি।’

তিনি বলেন, ‘১৩ দিন ধরে শ্রমিকরা খেয়ে না খেয়ে আন্দোলন করছে, অথচ রাতের অন্ধকারে ১২০ টাকায় কাজে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল! এটা তো হঠকারী সিদ্ধান্ত। আমাদের দাবি, ৩০০ টাকা মজুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি আমাদের সাথে সরাসরি ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেন, তবেই আমরা কাজে ফিরে যাবো।’

এক প্রশ্নের জবাবে অজিত রায় বলেন, ‘চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে কোনো ভ্যালি বা পঞ্চায়েত কমিটির সাথে কথা বলেনি। তারা এখন শ্রমিকদের জোরপূর্বক কাজে যোগ দেওয়াতে চাইছে।’

পরবর্তী কর্মসূচি কী হবে, এমন প্রশ্নে এই চা শ্রমিক নেতা সিলেটভিউকে বলেন, ‘গতকাল রোববার আমরা আম্বরখানা-বিমানবন্দর সড়ক অবরোধ করেছিলাম। তখন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী এসে আমাদের কাছে দুইদিন সময় চেয়েছিলেন। এর মধ্যে তিনি আমাদের দাবি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা আশ্বাস দেন। আমরা তাঁর আশ্বাসে সড়ক অবরোধ থেকে সরে আসি। আপাতত বাগানের মধ্যেই আমরা আন্দোলন করছি। আগামীকালের মধ্যে আমরা যদি তাঁর কাছ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না পাই, তাহলে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করা হবে।’

এদিকে, চা শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের সভাপতি রিদেশ মোদিও কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আগের মজুরিতেই যদি কাজে ফিরতে হয়, তাহলে আমরা কেন এতোদিন না খেয়ে ধর্মঘট করলাম?’

মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে গত ৮ আগস্ট থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন দুই ঘন্টা করে কর্মবিরতি পালন করেন চা শ্রমিকরা। ১৩ আগস্ট থেকে শুরু হয় অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট। সেই ধর্মঘটের যবনিকাপাত ঘটেছে কাল রাতে, এমনটাই ছিল সকলের ধারণা।

গতকাল রোববার রাত ৯টায় মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে প্রশাসন ও চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়। দীর্ঘ সেই বৈঠক শেষ হয় রাত তিনটার দিকে। মূলত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে শ্রমিক অসন্তোষ দূর করতে এই বৈঠক ডাকে স্থানীয় প্রশাসন। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসানের সভাপতিত্বে বৈঠকে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া, বিভাগীয় শ্রম দপ্তর শ্রীমঙ্গল কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল, সহসভাপতি পঙ্কজ কন্দ, সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে জানানো হয়। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসকের প্যাডে দেওয়া বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখে তাঁর সম্মানে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে আজ সোমবার কাজে যোগ দেবে। আপাতত চলমান মজুরি ১২০ টাকা হারেই শ্রমিকেরা কাজ করবেন।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে পরবর্তী সময়ে মজুরির বিষয়টি নির্ধারিত হবে। আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজার আগেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হওয়ার জন্য চা-শ্রমিক নেতারা আবেদন করেছেন, যা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জানানো হবে। চা-শ্রমিকের অন্যান্য দাবি লিখিত আকারে জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া হবে, সেগুলো পাঠানো হবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। আর বাগান মালিকেরা চা বাগানের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ধর্মঘটকালীন মজুরি শ্রমিকদের পরিশোধ করবেন।

যৌথ বিবৃতিতে প্রশাসনের পক্ষে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া ও বিভাগীয় শ্রম দপ্তর শ্রীমঙ্গল কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুল ইসলাম সই করেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষে ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল, সহসভাপতি পঙ্কজ কন্দ, সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা, অর্থ সম্পাদক পরেশ কালিন্দী সই করেন।

কিন্তু রাতের এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে আজ সকাল থেকে ফের আন্দোলনে রয়েছেন শ্রমিকরা।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে