ওখানে হাতিঘোড়া কিছু নেই। আছে কালো পানি। তাতে হাতিঘোড়া না ডুবলেও, মানুষ তলাতে সময় লাগবে না। তারপরও বিকেল পর্যন্ত ছিলাম। ফাঁকে বন্ধুকে নিয়ে মিনি স্টিমারে চড়েছি কয়েক পাঁক। এমনিতে এরা স্টিমারে নিয়ে ঘুরে না। এপার থেকে ওপারে গিয়ে আবার ফেরত আসছি। এমন ভ্রমণ সুখকর নয়। পানিতে গন্ধ এত কটু যে, শুরুতে মনে হবে পালাতে পারলেই বাঁচি।

ইদানিং বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলাম না কোথাও। প্রকৃতিরও বেহাল দশা। রাস্তার পাশে গাছপালা পাতার উপর ধুলো আর ধুলো। যাইহোক, আজ এক ছড়াকার বন্ধুকে নিয়ে হাতিরঝিলে ঘুরতে বেরিয়েছি হাতে আর কোনও উপায় নেই দেখে। 


প্রথমত ওখানে ফ্লাইওভারের উপর থেকে চারপাশের দৃশ্য দেখার মতো। পাড়ে ফুলগাছের তলে দাঁড়িয়ে বন্ধুর সাথে ছবি তুলে মন ভরে গেল অবশ‍্য। বন্ধু বললো, 'গাছগাছালি আছে বন্ধু, তাতে ছায়া নেই। ছায়া হয়ে দাঁড়াও কাছে, মনে মায়া নাই? বসবে নাকি রোদ দুপুরে, খাবা রোদের জ্বালা; উফ বলো না কথা আহা মুখে লাগাও তালা।'

হাতির ঝিলে ফুটেছে ফুল, সে ফুল ঘাসের বুনোফুল। দূরে ভাসছে জলে নৌকা। মাঝি হওয়ার সাধ হবে এক পলক তাকালে। পাড়ে ভিড়েছে স্টিমারখানা, মানুষ বোঝাই হবে। কেমন করে যে মানুষ দুগর্ন্ধময় জলে জলচর হতে চায়! 

বন্ধু ছড়া কাটছে। 'স্টিমার চলে জাহাজ চলে, ডিঙি নৌকা নাই ক্যান?
এই কথাটি কানের কাছে বলে
করো নাতো প্যান প্যান!
আমায় নিয়া ভাসবা?
একটুখানি হাসবা? চলো স্টিমারেই উঠি
একটুখানি হাসি খুশি প্রেমের মজা লুটি।'

হাতিরঝিলের কালো জলে ভাসে নৌকা, দেখতে নয় মন্দ।
জলগুলো কেন শাদা হলো না তাই নিয়ে মনে আসে দ্বন্দ্ব।

ঝিলের পাড়ে বসে ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে একাধারে অনেকগুলো ছড়া কবিতা কেটে ফেলেছে আমার বন্ধুটি। 

'ঝিলের পাড়ে সবুজ ঘাসে বসবে নাকি আমায় নিয়ে
গল্প করো ভালোবাসার মনখানি আজ নাও ছিনিয়ে।'

'চলো যাই বাড়ী যাইগা, কালো পানির গন্ধ
এখানটাতে বসলে বাপু আসে না প্রেম ছন্দ।'

'চলো দাঁড়াই ব্রীজের উপর, দেখি কোলাহল
করি গল্প দেখি দৃশ্য, বুকে বানাই প্রেম মহল।'

'জলের উপর একটা মসজিদ, আযান হবে সুরে
যাও বন্ধু পড়ো নামাজ, মসজিদ নয় খুব দূরে।'

'কত মানুষ পানির উপর, ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে,
যাবে নাকি, দাঁড়াবে গিয়ে তাদের কাছে
কী গল্প করে ওরা শুনবো কানটা পেতে,
তাদের নিয়ে কাব্যের খাতায় যাবো ছন্দ গেঁথে।'

আমার মনে পড়ল ঝিলের ইতিহাস। কোথায় যেন পড়েছি ভাওয়ালের রাজার এস্টেটে হাতিরঝিলসহ তেজগাঁও এলাকায় অনেক ভূসম্পত্তি ছিল। এস্টেটের হাতির পাল এখানকার ঝিলে স্নান করতে বা পানি খেতে বিচরণ করত বলে কালের পরিক্রমায় এর নাম হাতিরঝিল হয়েছে।

হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকাটি উদ্বোধন ও জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি। ঢাকার তেজগাঁও, গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা, মৌচাক, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার ও মগবাজার এলাকার বাসিন্দাসহ এ পথ দিয়ে চলাচলকারী যাত্রীরা বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন। ঝিল প্রকল্প বাস্তবায়ন ও তদারকি করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর 'স্পেশাল ওয়ার্কস অরগানাইজেশন'। এর অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, জলাবদ্ধতা ও বন্যা প্রতিরোধ, ময়লা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাজধানীর যানজট নিরসন আর শ্রীবৃদ্ধি করা।

সবমিলিয়ে ব‍্যস্ততম শহরে হাতে পাওয়া সামান‍্য অবকাশ কাটাতে হাতিরঝিল ভালো একটা জায়গা হয়েছে। হাতি ঘোড়া না পেলেও এখানে এসে কালো জলে একদন্ড শান্তির পরশ উপেক্ষা করা মুশকিল। 

বন্ধুর কাটা ছড়া কানে কানে লেগে থাকল ফিরতি পথের পুরো রাস্তায়। 

'ভালো লাগে হাতির ঝিলটা, 
কত সুন্দর সাজানো অই
বৃষ্টি আসুক জলে ভরুক 
অপেক্ষায় উতলে রই।'

'বিষাদ কাব্য লিখি শেষে, 
লিখি কালো জলের গল্প,
এই শহরের নদী মরলো, 
ঝিলও মরলো,
মুগ্ধতা নেই আর অল্প।'