বৃষ্টি হয়, পানি জমে। বৃষ্টি থামে, পানি নামে। ফের বৃষ্টি, ফের জলাবদ্ধতা....। বৃষ্টির মৌসুমে এরকম দৃশ্যপটই বড্ড নিয়মিত সিলেট নগরীজুড়ে। এই মৌসুমে জলাবদ্ধতার যন্ত্রণায় নিত্য ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকে। এ নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে জনমানসে। শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেও জলাবদ্ধতা থেকে কেন মুক্তি মিলছে না, ওঠছে সেই প্রশ্নও।

সর্বশেষ আজ সোমবার টানা তিন ঘন্টার ভারি বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয় সিলেট। সড়ক উপচে পানি ঢুকে পড়ে মানুষের বাসা-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। নগরবাসীকে পোহাতে হয় চরম ভোগান্তি।


সিলেট আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, আজ সকাল ৬টা থেকে ৯টার মধ্যে ১০৮.২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এই বৃষ্টির পানিতে তৈরি হয় জলাবদ্ধতার।

আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী সিলেটভিউকে বলেন, ‘তিন ঘন্টায় ১০৮ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়েছে। কম সময়ের মধ্যে এটা অনেক বেশি পরিমাণ বৃষ্টি। যার ফলে নগরীতে দ্রুত জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। আমি যখন সকালে অফিসে আসি, তখনও কয়েকটি এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখেছি।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারি বৃষ্টির ফলে নগরীর জিন্দাবাজার, বারুতখানা, হাওয়াপাড়া, রাজারগলি, উপশহর, যতরপুর, ছড়ারপাড়, ভাতালিয়া, জল্লারপাড়, তালতলা, চৌহাট্টা, সুবিদবাজার, ঘাসিটুলা, শামীমাবাদ, শিবগঞ্জ, নয়াবাজার, খাসদবির, মেডিকেল রোড, মজুমদারিসহ বিভিন্ন এলাকার সড়ক তলিয়ে যায়। অনেক এলাকায় সড়কে হাঁটুপানি জমে। সড়ক উপচে পানি ঢুকে পড়ে মানুষের বাসা-বাড়িতে। অনেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও ঢুকে পড়ে পানি। বিশেষ করে নিচু এলাকায় বসবাসরত মানুষের দুর্ভোগ ছিল বেশি।

শুধু পানি ঢুকে পড়াই নয়, ড্রেনের ময়লা-আবর্জনা মিশ্রিত পানি অনেকের বাসা-বাড়িতে ঢুকেছে।

নগরীর ছড়ারপাড়ের বাসিন্দা ঝিলু মিয়া বলেন, ‘জলাবদ্ধতার কষ্টের কথা বলে লাভ নাই। আমরা থাকি বাসার নিচতলায়। বৃষ্টি হলেই আমরা আতঙ্কে থাকি, এই বুঝি বাসায় ঢুকে পড়লো পানি! আজও ঘরে ঢুকেছে পানি। জিনিসপত্র নিয়ে টানাটানি করতে করতে আমরা হয়রান।’

সড়ক জলমগ্ন হয়ে পড়ায় চলাচলেও ভোগান্তিতে পড়তে হয় নগরবাসীকে। সকালে অফিসে যাওয়ার বেরিয়েছিলেন শিবগঞ্জের আবির ফয়সাল। কিন্তু জলমগ্ন সড়কে যানবাহন না পেয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর তিনি বাসায় ফিরে যান।

এদিকে, জলাবদ্ধতার পানি ওসমানী মেডিকেল কলেজের নিচতলায়ও ঢুকে পড়ে।

নগরবাসী বলছেন, জলাবদ্ধতার পেছনে শুধু ভারি বৃষ্টিই দায়ী নয়, এর পেছনে সিটি করপোরেশনের কর্তাদেরও দায় আছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করার পরও নগরীতে যখন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, তখন সংশ্লিষ্ট কাজে গাফিলতি আছে বলে মনে করছেন নগরবাসী। এ ছাড়া ছড়া-খাল, নালা-নর্দমা নিয়মমাফিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না বলেও নগরবাসীর অভিযোগ।

নগরীর তালতলার বাসিন্দা আফতাব আলী বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা শত শত কোটি টাকা খরচের কথা শুনেছি। কিন্তু টাকা খরচ করে লাভ কী হলো? বৃষ্টি আসে, সড়ক ডুকে যায়, বাসা-বাড়িতে পানি ঢুকে..এসবের শেষ কোথায়?’

মজুমদারির আদনান আক্তার কর্তাব্যক্তিদের দায় দেখছেন, ‘যেসব কাজ হয়েছে, সেগুলো কী সঠিকভাবে, সঠিক পরিকল্পনায় হয়েছে? যদি হয়ে থাকে, তাহলে জলাবদ্ধতা কেন নিরসন হয় না? সিটি করপোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলরগণ, কর্মকর্তারা কী করছেন? তারা তো সম্মিলিতভাবে সঠিক চেষ্টা করছেন বলে মনে হয় না।’

সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) সূত্রে জানা গেছে, সিলেট নগরীতে ছোট-বড় মিলিয়ে ১১টি ছড়া প্রবাহমান। এসব ছড়ার ১৬টি শাখা ছড়াও (খাল) আছে। এসব ছড়া-খাল সুরমা নদীতে গিয়ে মিশেছে। ছড়া-খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০ কিলোমিটার। এর বাইরে নালা-নর্দমা আছে ৯৭০ কিলোমিটার। নালা-নর্দমায় প্রায় সাড়ে ৬শ’ কিলোমিটার পাকা ড্রেন আছে।

সিসিকের প্রকৌশল শাখা সূত্র জানায়, বদর উদ্দিন আহমদ কামরান মেয়র থাকাবস্থায় ২০০৯ সালে জলাবদ্ধতা নিরসনে ছড়া-খাল খনন ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণে ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। ২০১২ সালে ২৭টি ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেন নির্মাণে ব্যয় করা হয় ৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে সিসিক মেয়র নির্বাচিত হন আরিফুল হক চৌধুরী। ওই বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন খাতে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা, ২০১৪ সালে ৭৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ২০১৫ সালে ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। ২০১৬ থেকে ২০১৯ অবধি ২৩৬ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়।

২০১৯ সালে ‘সিলেট সিটি কর্পোরেশনের জলাবদ্ধতা নিরসন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ আসে ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। প্রকল্পটি গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়; যা বাস্তবায়ন করছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)।

এই প্রকল্পের আওতায় দুই অর্থবছরে সিসিক ৩২৯ কোটি টাকা পেয়েছে বলে জানা গেছে। প্রকল্পটির আওতায় অন্যান্য কাজের সাথে ৩২৭ কিলোমিটার ড্রেন ও ৮ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। আরসিসি রাস্তা, আরসিসি ড্রেন ও আরসিসি ড্রেনসহ ফুটপাত নির্মাণ খাতে প্রকল্পটির সিংহভাগ বরাদ্দ ব্যয় হওয়ার কথা।

এবারের বৃষ্টির মৌসুমে বেশ কয়েকবার জলমগ্ন হয়েছে সিলেট নগরী। গত জুলাই মাসেও জলাবদ্ধতার কবলে পড়েন নগরবাসী। তখনও ১২২৮ কোটি টাকা কোথায় গেল, সেই প্রশ্ন ওঠে জোরেশোরে।

সমালোচনার প্রেক্ষিতে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সিলেটের উন্নয়নে ১২২৮ কোটি টাকা শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দিয়েছিলেন। এই পরিমাণ অর্থ পেতে বিধি অনুযায়ী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সিলেট সিটি করপোরেশনকে নিজস্ব আয় থেকে ২০ শতাংশ অর্থাৎ, ২৪৫ কোটি যুক্ত করতে হবে। ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ৯৮২ কোটি টাকা সরকার দেবে। বরাদ্দের পুরো টাকা চারটি অর্থ বছরে ছাড় দেওয়া হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই বরাদ্দের প্রথম ধাপে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ১২৯ কোটি টাকা পায় সিসিক। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দুইশ কোটি টাকা বরাদ্দ পায়। এখন পর্যন্ত ৯৮২ কোটি টাকার মধ্যে সিসিক পেয়েছে ৩২৯ কোটি টাকা।’

বরাদ্দকৃত টাকা সঠিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না বলে যে অভিযোগ, তা ‘সঠিক নয়’ বলেও দাবি করছেন মেয়র আরিফ, ‘সরকারি অর্থ কারো পক্ষে স্বেচ্ছাচারি হয়ে খরচ করা অসম্ভব। নজরদারির জন্য আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থে উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নের নির্ধারিত নিয়ম রয়েছে।’

অপরিকল্পিত কোনো কিছুই হচ্ছে না বলে দাবি তাঁর, ‘সিসিকের মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের সময় সরকারের যথাযথ নিয়ম মেনে সিলেটের প্রকৃতি বিবেচনায় জলাবদ্ধতা নিরসনে ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়। ইন্সিটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম)  ফিজিবিলিটি স্টাডির কাজ করে। সেই অনুযায়ী সিসিকের ছড়া, ড্রেনের উন্নয়ন কাজ পরিচালিত হচ্ছে। ড্রেনের প্রসার বা বর্ধিতকরণ কতো হতে পারে সেটা, জলাবদ্ধতা নিরসনে মহানগর এলাকার নিম্নাঞ্চল এবং নদী তীরবর্তী এলাকায় স্লুইস গেট নির্মাণ এবং পাম্প হাউস স্থাপনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী সিসিক পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করছে।’

সিসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী সিলেটভিউকে বলেন, ‘অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এতো বৃষ্টিপাত সাধারণত সিলেটে হয় না। তবে এক ঘন্টার মধ্যে পানি নাই (নেমে যায়)।’

তিনি বলেন, ‘ক্লাইমেট চেঞ্জের (জলবায়ু পরিবর্তন) কারণে সিলেটে নিত্যনতুন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। যেটা আগে সিলেটে ছিল না।’

বিধায়ক চৌধুরী আরও বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে আমাদের যে প্রকল্পগুলো আছে, সেগুলো চলছে। যদিও বরাদ্দ সেভাবে মিলছে না, তবে কাজ চলমান আছে। আমি এটা বলতে পারি, গত দুই-তিন বছরে সিলেটে যে ড্রেনেজ সিস্টেম দেওয়া হয়েছে, এটা এর আগে কখনোই হয় নাই। আমি জোর গলায় বলতে পারি। এখন কথা হচ্ছে, ত্রুটি থাকতে পারে। ত্রুটি আমাদের আছে, নাগরিকের আছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেরও আছে। বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য নির্ধারিত স্থানে ফেলা, যেখানে-সেখানে না ফেলা হচ্ছে নাগরিকের দায়িত্ব। রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ময়লা-আবর্জনা ড্রেনের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের লোকজন সময়মতো যায় না। ড্রেনের ছিদ্রগুলো যে পরিষ্কার করবে, সঠিক সময়ে যায় না।’

সিসিকের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযানের মাধ্যমে আমরা নিয়মিত শ্রমিক দিয়ে কাউন্সিলরদের তদারকিতে কাজ করানো হয়। কিন্তু এতো কিছুর পরও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। যদি আমরা মালনিছড়া, লাক্কাতুরা, দলদলি এসব চা বাগানের পানিকে ডাইভার্ট করে, প্রয়োজনে খাল খনন করে অন্যদিকে নিতে পারি, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। আরেকটি বিষয়, সুরমা নদী দীর্ঘদিন ধরে খনন করা হয় না। এটা করাও জরুরি। এ ছাড়া উন্নয়নের ফলে নিচু এলাকা, জলাধারগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। জলাধারগুলোও বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন।’

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে