বাংলা ৮৮৭ বঙ্গাব্দের কথা। ইংরেজি ১৪৮০ সাল। বর্তমান রাজশাহীর তাহেরপুর অঞ্চলে রাজত্ব করেন এক প্রজা-বৎসল ও ধর্মপরায়ণ জমিদার। নাম কংশ নারায়ণ রায় বাহাদুর। ঐ বছরে রাজকীয় পূজা-অর্চনার মানসে অনেক অর্থ ব্যায়ে প্রতিষ্ঠা করলেন এক সুরম্যদেবালয়। প্রতিষ্ঠাতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে মন্দিরের নাম রাখা হলো কংশ নারায়ণ মন্দির। সেই বছরেরই শরৎকালে মহাসমারোহে রাজা কংশ নারায়ণ আয়োজন করলেন এক বিশেষ দেবী আরাধনার (যা অতীতে কেউ করেননি), তথা এক পূজা উৎসবের। সেই পরমারাধ্যা দেবীর নাম, ‘শ্রীশ্রী দুর্গা’।

জানামতে ভারতীয় উপমহাদেশে, তথা মর্ত্যলোকে এটিই শ্রীশ্রী দুর্গাদেবীর প্রথম পূজানুষ্ঠান। সে হিসেবে মা দুর্গার প্রথম আবাহনও হয় তাহেরপুরে। রাজা কংশ নারায়ণের আহবানেই মা দুর্গা প্রথম আবির্ভুত হন তাঁর ভক্তকুলে। দেবীপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে হয় দেবীর বোধন। সেই পূজায় পৌরহিত্য করেন রাজপন্ডিত রমেশ শাস্ত্রী। মা দুর্গার প্রথম আবির্ভাবে ধন্য হয় পুন্যভূমি, আর সেদিন থেকেই সূচনা হয় শারদীয় দুর্গাপূজার। কথিত আছে, রাজা সেই পূজা-উৎসবে ব্যায় করেছিলেন নয় লক্ষ টাকা, বর্তমান মুল্যে যার মান বহু কোটি টাকার সমতুল্য। বিশাল অর্থব্যায়ে সেই পূজা-উৎসবের সূচনা হয় বিধায় এই পূজা অর্চ্চনা প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা পায় বিত্তশালীদের পূজা উৎসব হিসেবে। কিন্তু যুগের বিবর্তনে এখন এই উৎসব কোন শ্রেণি বা গোষ্টীবিশেষের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। অর্জন করেছে এক সর্বজনীন রূপ, ছড়িয়ে গেছে গ্রামে-গঞ্জে থেকে বাঙালি অধ্যুষিত সারা বিশ্বসমাজে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালে লন্ডনের বৃটিশ মিউজিয়ামের গ্রেট হলে অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে শারদীয় দুর্গাপূজা উৎসবের আয়োজন করা হয়।


কালের পরিক্রমায় বছর ঘুরে আবারো ফিরে এলো বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ‘দুর্গাপূজা-১৪২৯ বঙ্গাব্দ’। আনন্দে-উদ্দীপনায় ভক্তকূলের শ্রদ্ধায় অবনত ও আত্মহারা হওয়ার দিন। ধর্মীয় পরিচয়ে এটি শুধুমাত্র বাঙালি হিন্দুদের অনুষ্ঠান হলেও এর একটি সর্বজনীন আবহ বিদ্যমান। সকল ধর্মীয় বিবেধ পরিহার করে, সাম্প্রদায়িকতাকে দুরে ঠেলে, এক ও অভিন্ন মানব সত্ত¡ায় আবেসিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিলীন হওয়ার অনুষ্ঠান এই দুর্গোৎসব।

জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুসারে পিতৃপক্ষের বিদায়লগ্নে আগমন ঘটে দেবীপক্ষের। মহিষাসুর কর্তৃক স্বর্গলোক অধিকৃত হওয়ার ফলে দেবগণ স্বর্গলোক থেকে বিতাড়িত হন এবং শরনাপন্ন হন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার। অতপর ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবগনের শরীর থেকে তেজোরাশি নির্গত হয়। সেই তেজোরাশি একীভূত হয়ে সৃষ্টি হয় এক দেবীমুর্তির। সেই দেবীই নিধন করেন মহিষাসুরকে। আর সেই শাস্ত্রীয় ঘটনা অনুযায়ী দুর্গাদেবী এক সম্মিলিত শক্তির প্রতীক।

দুর্গাপূজা হিন্দুদের হলেও দুর্গোৎসব সকল বাঙালির, সকল ধর্মের, বর্ণের, মতের, পথের মানুষের আনন্দের জন্য নিবেদিত। দেবী ভগবতীর পাশে রয়েছেন ধন-ধান্যে ভরিয়ে তোলার দেবী লক্ষী, আছেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার দেবী সরস্বতী, বাণিজ্যে সাফল্য এনে দেওয়ার জন্য রয়েছেন গনেশ ঠাকুর। আরও আছেন সকল বাধা-বিঘœ অতিক্রম করে টিকে থাকার প্রতীক দেব-সেনাপতি বীর কার্তিক। সকল বিভেদ ভুলে আনন্দের জন্যই আনন্দময়ীর আগমনকে স্বাগত জানায় সবাই। ধর্মের রীতিনীতি ও মর্মবাণী অনুসরণ করে যারা নিজ নিজ ধর্ম চর্চা করেন, তারাও এই উৎসবে ঐক্যবদ্ধ হয়। আর এমনি করেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।

একসময় দুর্গোৎসব সীমাবদ্ধ ছিল কিছু বিত্তশালী ব্যক্তি বা পরিবারের মধ্যে। সাধারন্যে এর প্রচলন ছিল সীমিত, কারণ আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় এ পূজার আয়োজন করা সম্ভব হতো না।্ কিন্তু বর্তমান যুগে অসচ্ছল কিন্তু উদ্যোগীদের আগ্রহে সর্বজনীন দুর্গাপূজার প্রচলন এমনভাবে প্রসার লাভ করেছে, যা এখন শুধুমাত্র সম্পন্নদের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। সবাই মিলে এখন সম্মিলিতভাবে পূজার অয়োজন করে থাকে। আর এভাবেই দুর্গাপূজা সমাজের সম্প্রীতি ও বন্ধন দৃঢ় করতে ভুমিকা রাখে।

শারদীয় দুর্গোৎসব বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়। বিজয়া শব্দের অর্থ বিশেষভাবে জয় অর্জন। সেই জয় আমাদের মালিন্যের উপর, সংকীর্ণতার উপর, ক্ষুদ্রতার উপর, দুর্বলতার উপর ও কাপুরুষতার উপর জয়। দুর্গাপূজার মূল বাণী সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে নিবেদিত। সুদৃঢ় হোক সম্প্রীতির বন্ধন। যা সমাজকে অন্যায়ের পথে, অশুভের পথে, অকল্যাণের পথে নিয়ে যায়, সেই বৃত্তির বিরুদ্ধে সকলের সংগ্রাম করতে হবে। মানবিকতা হোক একমাত্র আশ্রয়। মানুষের কল্যাণই হোক আমাদের ধর্ম। শারদোৎসবসহ প্রতিটি উৎসবের অংশীজন হবো আমরা। জয় হোক মানবতার ও মনুষ্যত্বের। দুর্গোৎসব বয়ে আনুক সকলের জন্য নির্মল আনন্দ।


লেখক: অধ্যাপক, সেচ ও পানি ব্যবস্তাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।