সিলেট মহানগরীতে যদি তিনটি মূল সমস্যা চিহ্নিত করা হয়, তন্মধ্যে একটি হবে জলাবদ্ধতা। অল্প কিংবা ভারি, বৃষ্টি যেরকমই হোক, নগরীর জলমগ্ন হওয়া অবশ্যম্ভাবী। বাসা-বাড়ি, দোকানপাটেও ঢুকে পড়ে পানি। ফলে বৃষ্টির মৌসুমে নগরবাসীর দুর্ভোগ হয় সীমাহীন।

হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও জলাবদ্ধতার সমস্যা থেকে মুক্ত হয়নি সিলেট নগরী। তবে এবার একটা হেস্তনেস্ত চান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। এজন্য আগামী বর্ষা মৌসুম আসার আগেই তিনি মাঠে নেমেছেন টিম নিয়ে। এই টিমের লক্ষ্য, নগরীর সমস্ত ছড়া-খাল উদ্ধার করে পানির প্রবাহ ঠিক রাখা; যাতে দ্রুত পানি নেমে যায় সুরমা নদীতে।


সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) সূত্রে জানা গেছে, সিলেট নগরীতে ছোট-বড় মিলিয়ে ১১টি ছড়া প্রবাহমান। এসব ছড়ার ১৬টি শাখা ছড়াও (খাল) আছে। এসব ছড়া-খাল সুরমা নদীতে গিয়ে মিশেছে। ছড়া-খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০ কিলোমিটার। এর বাইরে নালা-নর্দমা আছে ৯৭০ কিলোমিটার। ছড়া-খাল উদ্ধার, রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, ড্রেন নির্মাণ, ছড়া-খাল ও ড্রেন পরিষ্কারে গত প্রায় এক যুগে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু জলাবদ্ধতার সমস্যা তবু রয়েই গেছে।

সিসিক সূত্রে জানা গেছে, মেয়রের সভাপতিত্বে সিসিকের সর্বশেষ সাধারণ সভায় আগামী বর্ষা মৌসুম এবং নগরীর জলাবদ্ধতার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনে করণীয় সম্পর্কে সভায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।

সভায় কাউন্সিলরগণ অভিমত দেন, নগরীর সমস্ত ছড়া-খাল দখলদারদের কবল থেকে উদ্ধার করতে হবে, এগুলোর পানি প্রবাহে যতো প্রতিবন্ধকতা আছে তা অপসারণ করতে হবে। তাহলে বৃষ্টির পানি দ্রুত ছড়ার মধ্য দিয়ে সুরমায় গিয়ে পড়বে। ফলে জলাবদ্ধতার শঙ্কা অনেকটাই কমে আসবে।

নগরীর ছড়া-খালের অবস্থা সরেজমিনে পরিদর্শন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে সভায় সবার মতামতের ভিত্তিতে একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়। সাব-কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আছেন কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ। সদস্য হিসেবে আছেন কাউন্সিলর তৌফিক বক্স লিপন ও এসএম শওকত আমিন তৌহিদ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এই সাব-কমিটি গত তিনদিন সরেজমিনে নগরীর সকল ছড়া পরিদর্শন করেছে। এরপর ছড়ায় থাকা দখলদারদের উচ্ছেদে মত দিয়েছে কমিটি। সে প্রেক্ষিতে আজ বুধবার থেকে নগরীর গোয়ালিছড়ায় থাকা দখলদারদের উচ্ছেদে অভিযান শুরু করেছে সিসিক।

এ বিষয়ে সাব-কমিটির সদস্য কাউন্সিলর তৌফিক বক্স লিপন বলেন, ‘সরকার আমাদেরকে কোটি কোটি টাকা দিচ্ছে নগরীর উন্নয়নের জন্য। আমরা পরিকল্পনা মোতাবেক উন্নয়নকাজ করছি। কিন্তু অতিবিৃষ্টি বা সামান্য বৃষ্টিতে অনেক জায়গায় দেখা যায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এর অন্যতম কারণ ছড়া, ড্রেনে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়। যা বৃষ্টি হলে পানি অপসারণে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এই প্রেক্ষিতে সিসিকের সাধারণ সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাব-কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন আজাদুর রহমান আজাদ, আমরা আরো দুজন কাউন্সিলর কমিটিতে রয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকটা ছড়া পরিদর্শন করেছি, এগুলো দেখা যাচ্ছে অবৈধ দখলদারদের দখলে। ছড়ার পাশে টং দোকান গড়ে তোলা হয়েছে, এগুলো ময়লা-আবর্জনা ছড়ায় ফেলা হচ্ছে, ফলে ছড়ায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে।’

লিপন আরও বলেন, ‘যতোক্ষণ না নগরীর ১১টি ছড়া পূপরিপূর্ণভাবে উদ্ধার হচ্ছে, তকোক্ষণ কঠোরভাবে কার্যক্রম চলবে। পরিপূর্ণভাবে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে পারলে জলাবদ্ধতা থাকবে না বলে আমাদের বিশ্বাস।’

নগরবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘নগরবাসীকে অনুরোধ করবো, যততত্র যাতে ময়লা-আবর্জনা তারা না ফেলেন। সিসিকের নির্ধারিত গাড়ি রয়েছে, ভ্যানগাড়ি রয়েছে, শ্রমিক রয়েছে, তাদের মাধ্যমে আপনারা বর্জ্যগুলো দিয়ে দিলে সিসিক সেগুলো নির্ধারিত স্থানে নিয়ে ফেলবে।’

সাব-কমিটির আহ্বায়ক কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ বলেন, ‘বৃষ্টি এলেই দেখা যায় আমাদের ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে। সেই পানি যাওয়ার প্রতিবন্ধকতা কিন্তু আমরা নিজেরাই করেছি। আমরা যদি ছড়া উদ্ধার করতে পারি, ছড়া পরিষ্কার রাখতে পারি, আমরা ধারণা করছি সামনের বর্ষা মৌসুমে আমাদের জলাবদ্ধতার সমস্যা কমে আসবে,বাসাবাড়িতে আর হয়তো পানি ঢুকবে না।’

তিনি বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে ছড়ার আশপাশে যেসব ব্যবসায়ী ভাইয়েরা আছেন, তাদেরকে সচেতন হতে হবে। ছড়ার মধ্যে পলিথিন আর পলিথিন, কেউ না কেউ এসব ফেলেছেন এবং তারা ব্যবসায়ী। জলাবদ্ধতামুক্ত নগরী গড়তে প্রত্যেক নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে, ভূমিকা রাখতে হবে।’

আজাদ জানান, গোয়ালিছড়ার উপরে এক থেকে দেড় হাজার ফুট জায়গায় ঢালাই করা হয়েছে। ফলে ঢালাইয়ের নিচে ছড়ায় কী রকম প্রতিবন্ধকতা আছে, তা দেখা যাচ্ছে না। এসব ঢালাই ভাঙার কাজও আজ বুধবার থেকে শুরু হয়েছে।

সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমের আগেই আমরা ছড়াগুলো উদ্ধার করে পরিষ্কার করতে চাই। এজন্য সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। আমাদের সাব-কমিটি রয়েছে, তাদের মতামতের ভিত্তিতে কাজ চলছে। উদ্ধার অভিযান, উচ্ছেদ অভিযান চলবে। ছড়া, ড্রেন পরিষ্কার করার কাজও চলবে।’

মেয়র বলেন, ‘আমাদের কাউন্সিলরগণ তিনদিন ধরে সমস্ত ছড়াগুলো পরিদর্শন করেছেন। গোয়ালিছড়ায় তারা দেখতে পেয়েছেন, ছড়া থেকে সুরমা নদীতে গিয়ে যে পানিটা পড়বে, সে জায়গা শুকনো। কিন্তু এর পেছনে ছড়ায় পানি প্রায় ৯ ফিট। আমরা অনুসন্ধান করে দেখেছি যে, সবজি বাজার, অবৈধ দোকানপাটের ময়লা-আবর্জনা ফেলে ছড়াকে পুরোপুরি ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। ছড়ার দুটো এক্সিট পয়েন্ট আছে পানি যাওয়ার, এর মধ্যে একটা সম্পূর্ণ বন্ধ, আরেকটা আংশিক বন্ধ। কাজেই বর্ষা আসার আগে আমরা এগুলো পরিষ্কার করে ফেলতে চাই। এজন্য অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে শুরু করেছি।’

মেয়র জানান, সোবহানীঘাটের সবজি বাজার থেকে ময়লা-আবর্জনা ছড়ায় ফেলায় হয়। এই সবজি বাজার দক্ষিণ সুরমায় সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘সবজি বাজার এখানে থাকা কোনোভাবেই উচিত নয়। দক্ষিণ সুরমায় ট্রাক টার্মিনালের আশপাশে এই বাজার করা গেলে পণ্য নিয়ে ট্রাক আসা সহজ হবে, ট্রাক টার্মিনালে রাখা যাবে। আমরা তাদেরকে সহযোগিতা করবো, তারাও যাতে এখান থেকে নিজেরা সরার চিন্তা করেন।’

আরিফ বলেন, ‘হুট করেই তো সরানো সম্ভব নয়, তবে আমরা চেষ্টা করছি, তারাও চেষ্টা করছে। যতো দ্রুততম সময়ের মধ্যে এটা সরানো যায়, ততোই ভালো।’

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে