সিলেট অঞ্চলে গত প্রায় শত বছরে আঘাত হানা ভূমিকম্পগুলোর উপকেন্দ্র। ছবি: ভলকানো ডিসকভারি।

তুরস্ক কিংবা সিরিয়া, ফিলিপাইন কিংবা ইন্দোনেশিয়া-দুনিয়ার যেখানেই যখন ভূমিকম্প হোক, আতঙ্ক ছড়ায় বাংলাদেশেও। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে মানুষের ভয় জাগে বেশি। এর কারণ, সিলেট আছে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে। এখানে যদি ৬ মাত্রার ভূকম্প হয়, তাহলে ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা আছে।

অতীত ইতিহাস বলছে, সিলেট অঞ্চল বরাবরই ভূমিকম্পপ্রবণ। ১৫৪৮ সালে প্রচন্ড ভূমিকম্পে সিলেট এলাকায় ব্যাপক ভূ-পরিবর্তন ঘটে। উঁচু-নিচু ভূমি সমতলে পরিণত হয়। এরপর ১৬৪২, ১৬৬৩, ১৮১২ ও ১৮৬৯ সালের ভূমিকম্পে সিলেটের মানচিত্র পাল্টে যায় অনেকটাই। সিলেটে এ যাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৯৭ সালের ১২ জুন। সেদিন বিকাল সোয়া ৫টার দিকে সংঘটিত ভূমিকম্প ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থ কোয়াক’ নামে পরিচিত। ৮ দশমিক ৭ মাত্রার সেই ভূকম্পে বাংলাদেশের গোটা সিলেট অঞ্চল ও ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল মিলিয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। করে। শুধু সিলেট জেলারই ৫৪৫টি ভবন ভেঙে পড়ে। মারা যান হাজারো মানুষ। ওই ভূকম্পের ফলেই সিলেটজুড়ে সৃষ্টি হয় বিশালাকারের হাওর, বিল, জলাশয়ের।


বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই সময়ে সিলেট অঞ্চলে উঁচু বা পাকা ভবন খুব বেশি ছিল না। এখনকার মতো এতো বেশি ভবন যদি তখন থাকতো, তবে পরিস্থিতি কল্পনাতীত হতে পারতো।

সিলেট অঞ্চলে সর্বশেষ বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয় ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই। শ্রীমঙ্গলে সংঘটিত সেই ভূকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৬। এরপর এরকম বড় মাত্রার ভূমিকম্প আর হয়নি এ অঞ্চলে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেট ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোনের’ (বিপজ্জনক এলাকা) মধ্যে পড়েছে। সিলেট একদিকে ভূকম্পের উৎপত্তিস্থল ‘ডাউকি পয়েন্টে’র মাত্র ২শ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, অন্যদিকে শাহবাজপুর ফল্টও (ভূগর্ভস্থ প্লেটের ফাঁক, এটি হবিগঞ্জ-কুমিল্লা এলাকাধীন) সিলেটের কাছাকাছি। যে কারণে সিলেটের জন্য ভূমিকম্পের ঝুঁকি খুব বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকিভেদে তিনটি বলয় নির্ধারিত রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ তথা প্রথম বলয়েই সিলেটের স্থান। এ বলয়ে ৭-৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। এই প্রথম বলয়কে ভূকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ বলে বিবেচনা করা হয়।

জানতে চাইলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং ভিাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেন, ‘সন্দেহাতীতভাবে সিলেট রয়েছে ভয়ানক ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। সিলেটের একেবারে কাছে পড়েছে ডাউকি ফল্ট, আবার শাহবাজপুর ফল্টও কাছাকাছি। যে কারণে সিলেটে ভূমিকম্পের ঝুঁকি অনেক বেশি।’

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) পুর ও পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মুশতাক আহমদের মতে, ‘টেকটোনিক প্লেটের বাউন্ডারি সিলেটের কাছাকাছি থাকায় এ অঞ্চল ভূমিকম্পের সবচাইতে বেশী ঝুঁকিতে রয়েছে। পাশাপাশি ডাউকি ফল্ট, ত্রিপুরা ফল্টের অবস্থানও সিলেটের কাছাকাছি হওয়ায় এখানকার ঝুঁকির কারণ বেশি।’

বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে, সিলেট অঞ্চল যে টেকটোনিক প্লেটে রয়েছে, তা ক্রমেই উত্তর-পূর্ব দিকে সরছে। এক শতাব্দিতে সরে যাওয়ার পরিমাণ এক মিটার। এ কারণে এই অঞ্চল প্রবল ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে।

ফরাসি ইঞ্জিনিয়ারিং কনসার্টিয়াম ১৯৯৮-এর জরিপ অনুসারে, সিলেট অঞ্চল ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে সক্রিয় ভূকম্পন এলাকা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আসছে।

২০০৯ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) পরিচালিত জরিপে ওঠে আসে, সিলেট অঞ্চলে ৫২ হাজার ভবন রয়েছে। তন্মধ্যে ২৪ হাজার ভবনই ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। ওই জরিপের তথ্য দেখে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বিল্ডিং কোড অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।

২০০৬ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একটি জরিপ চালায়। জরিপ অনুযায়ী, সিলেট মহানগরীতে শতাধিক প্রাচীন ভবন রয়েছে, যেগুলোর বয়স একশ থেকে দেড়শ বছর। এসব ভবন ভূমিকম্পের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে।

অধ্যাপক ড. জহির বিন আলমের মতে, সিলেটে যদি ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তবে ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ পুরনো ভবনগুলো নিয়ে তিনি বেশি শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সিলেটে নতুন ভবনের ডিজাইন থার্ড পার্টিকে (তৃতীয় পক্ষ) দিয়ে ভেটিং করানোর (মতামত নেওয়া) কথা বলছেন অধ্যাপক ড. মুশতাক আহমদ।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে