বাঙালি হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র জাতি, যারা নিজের ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। ১৯৫২’র সেই উত্তাল ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বাংলাদেশে। ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল সিলেট। এখানকার দুই কিশোর ভাষা সংগ্রামী হচ্ছেন অধ্যাপক আবদুল আজিজ ও অধ্যক্ষ মাসউদ খান। পঞ্চাশের দশকের সেই উত্তাল ভাষা আন্দোলন কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরা, আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন সক্রিয়ভাবে।

সিলেটভিউ২৪ডটকম’র এই প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় সেই ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিমন্থন করেছিলেন সিলেটের গর্বিত এই দুই ভাষা সৈনিক। তাঁদের স্মৃতিচারণ নিয়ে ২০১৬ সালে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল সিলেটভিউ২৪ডটকম। আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে ভাষা সংগ্রামী ও ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতিবেদনটি ফের প্রকাশ করা হলো।


অধ্যাপক আবদুল আজিজের স্মৃতিচারণ>>
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কোষাধ্যক্ষ, রেজিস্ট্রার, অধ্যাপক, ডিন, উপাচার্য কিংবা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান- এরকম অনেক বিশেষণে তাঁকে বিশেষায়িত করা যায়। কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় ‘ভাষা সংগ্রামী’। তিনি অধ্যাপক আবদুল আজিজ। কিশোর বয়সেই ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ১৯৩৬ সালের ৩১ মার্চ সিলেটের বালাগঞ্জ থানার খাগদিওর গ্রামে জন্মগ্রহণ করা আবদুল আজিজ একজন লেখকও। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক অধ্যাপক আজিজ ২৪টির মতো বই লিখেছেন।

অধ্যাপক আজিজের শিক্ষাজীবন বালাগঞ্জের তাজপুর হাইস্কুল থেকে শুরু হয়। তারপর দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেন। পরে ইংল্যান্ডের লোস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি বিভিন্ন জায়গায় সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কোষাধ্যক্ষ ও রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন সিলেট এমসি কলেজের অধ্যক্ষ, কুমিল্লা ও রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান। এ ছাড়া সিলেটের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে ডিন ও কোষাধ্যক্ষ এবং পরবর্তীতে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাসের দায়িত্ব পালন করছেন।

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে ওঠা ভাষা আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন আবদুল আজিজ।

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে অধ্যাপক আজিজ বলেন, ‘১৯৪৭ সালের জুন বা জুলাইয়ের দিকে হায়দারাবাদে এক জনসভায় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়া উদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের রাষ্ট্র্রভাষা উর্দু হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন। তখনও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি। তার এই মন্তব্যে দেশে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একটি প্রবন্ধে জিয়া উদ্দিনের মন্তব্যের বিরোধীতা করেন। আরো অনেকেই এর বিরোধীতা করে লেখালেখি করেন।’

ভাষা আন্দোলনে নিজের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আবদুল আজিজ বলেন, ‘আমি তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। ১৬ বছরের কিশোর। মফস্বল এলাকা তাজপুর মঙ্গলচন্ডী হাইস্কুলে পড়ি। আমি রাজনীতি সচেতন ছিলাম, পত্রপত্রিকা নিয়মিত পড়তাম। ক্লাস ক্যাপ্টেন থাকায় সবাই আমার কথাকে গুরুত্ব দিত। বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে ৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলাগুলির খবর পরদিন জানতে পারি আমরা। ওইদিন থেকেই আমি সবাইকে বিষয়টি জানিয়ে স্কুলে ধর্মঘট শুরু করি। স্কুলের পাশের একটি মাদরাসার শিক্ষার্থীরাও ধর্মঘটে যোগ দেয়। আমাদের স্কুল কমিটির সদস্য ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আবদুল বারীর সহযোগিতায় ও সভাপতিত্বে ২৫ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় বাজারে আমরা সভা করি। সেখানে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সংবাদ আমি টিনের চুঙ্গার সাহায্যে পড়ে শোনাই। এতে মানুষের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। আমার এই তৎপরতার খবর বালাগঞ্জ থানায় পৌঁছার পর আমাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হলো। বাধ্য হয়ে আমি গা ঢাকা দিলাম।’

৫২’র ফেব্রুয়ারিতে উত্তাল ভাষা আন্দোলনে সিলেটে কি হয়েছিল? এমন প্রশ্নে অধ্যাপক আজিজ বলেন, ‘ঢাকায় গোলাগুলির খবর ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে সিলেটে পৌঁছার পর হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ সভা করে পরদিন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ওইদিন বিকেলে খেলাফত আন্দোলনের নেতা আবদুল্লাহর সভাপতিত্বে গোবিন্ধচরণ পার্কে জনসভা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি সিলেটে মিছিলে মহিলা কলেজের ছাত্রীরাও অংশ নেয়। এভাবে প্রতিদিনই মিছিল-মিটিং হতো। ধীরে ধীরে সিলেটের সর্বত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।’

ভাষা সৈনিক আবদুল আজিজকে পরবর্তী সময়ে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। ভাষা সংগ্রামে জড়িত থাকার ‘অপরাধে’ স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ যেতে তাঁর পাসপোর্ট পেতে বিলম্ব হয়।

বর্ণাঢ্য জীবনে বহু পরিচয় থাকলেও ‘ভাষা সৈনিক’ পরিচয়ই অধ্যাপক আবদুল আজিজের কাছে সবচেয়ে গৌরবের।

অধ্যক্ষ মাসউদ খানের স্মৃতিচারণ>>
১৯৩৫ সালের ১৮ আগস্ট সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার শেওলা ইউনিয়নের কাকড়দি গ্রামে জন্ম মাসউদ খানের। ১৯৪৪ সালে সিলেটে শহরের মানিকপীর রোডস্থ বাসায় চলে আসেন মাসউদ খান। কাজী জালালউদ্দিন বালক মক্তব, সিলেট হাই মাদরাসা, এমসি কলেজ পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করেন তিনি। একইসাথে ঢাকার সিটি ল’ কলেজ থেকে এলএলবিও সম্পন্ন করেন। সিলেট মদন মোহন কলেজে যুক্তিবিদ্যা বিভাগের লেকচারার হিসেবে কর্মজীবন শুরু। পাশাপাশি সিলেট বারেও প্র্যাকটিস শুরু করেন। একপর্যায়ে মদন মোহন কলেজের প্রিন্সিপালও হন তিনি।

এ ছাড়া মাওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় টেকনিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষও ছিলেন তিনি। খোদ ভাসানীই তাকে এ পদে নিয়োগ করেন। ৩১ বছর বয়সেই তিনি শেওলা ইউপির চেয়ারম্যান এবং সিলেট জেলা কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। অধ্যক্ষ মাসউদ ছাত্র ইউনিয়ন, তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রশক্তি, প্রগতিশীল ছাত্রদল, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি খেলাফত মজলিসের রাজনীতিতে জড়িত।

১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে অধ্যক্ষ মাসউদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধেও ভূমিকা রাখেন মাসউদ খান।

ভাষা আন্দোলনে জড়িত হওয়ার বিষয়ে অধ্যক্ষ মাসউদ খান বলেন, “পারিবারিকভাবে আমি রাজনীতি সচেতন ছিলাম। আমার বড় ভাই সা’দত খান ছিলেন রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত। ১৯৫১তে ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সা’দত খান। আমাদের বাসায় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের যাতায়াত ছিল। বাসায় বৈঠকে সার্বজনীন ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার আলোচনা হতো। আমিও এ ব্যাপারে উৎসাহী ছিলাম। ছাত্র ইউনিয়নে থাকাকালেই ভাষা আন্দোলন শুরু হলো। সিলেটে এ ধারার রাজনৈতিক নেতৃবর্গ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তরুণ কর্মী হিসেবে আমিও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি।”

বলে চলেন অধ্যক্ষ মাসউদ, ‘আন্দোলন চলাকালে আমরা প্রতিদিন স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় ধর্মঘট পালন করে মিছিল, শোভাযাত্রা নিয়ে গোবিন্ধচরণ পার্কে গিয়ে সমাবেশ করতাম। প্রতিদিন বিকেলে পার্কে জনসভায় অংশ নিতাম। সিলেটের তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট মনিটরিংয়ে দায়িত্ব ছিল আমার। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ক্রমেই তীব্র হয়। আমরা আন্দোলন অব্যাহত রাখি। ফলে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবির মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিও অন্তর্ভূক্ত হয়।’

পরবর্তীতে বিভিন্ন ন্যায্য আন্দোলন-সংগ্রামে জড়িত থেকে মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিকা রাখেন অধ্যক্ষ মাসউদ। তিনি বলেন, “ছেষট্টিতে পশ্চিম পাকিস্তানে যাই আমি। ওই সময় সেখানকার উন্নত অবস্থা আর পূর্ব পাকিস্তানের দুর্দশার বিষয়টি ভালোভাবে উপলব্দি করতে সক্ষম হই। পূর্ব-পশ্চিমের বৈষম্য আমাকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি আমার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলাম। পাকিস্তান সরকারের অধস্থন হিসেবে আমাকে পাক বাহিনীর সহযোগি হওয়ার কথা। কিন্তু আমি তাদের কোনো সাহায্য করিনি। ক্ষুব্ধ পাকিরা আমাদের গ্রামের বাড়ি জ্বালিয়ে দিল। পালিয়ে এখানে-সেখানে থাকলাম আমরা। পরিবারের কারো সাথে যোগাযোগ ছিল না। আমার ভাই সা’দত খান ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন।”

বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থান নিয়ে অধ্যক্ষ মাসউদ বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বাংলা ভাষা বর্তমানে অবহেলিত। অথচ দেশ-জাতির উন্নয়নে মাতৃভাষাকে সর্বাাধিক গুরুত্ব দেওয়ার কথা। উন্নত জাতিরাষ্ট্রগুলো তাদের নিজ ভাষাকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়েছে। আমরা হাঁটছি উল্টোপথে।’

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে