সিলেট অঞ্চলের নিজস্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী ‘বারকি’ নৌকা নিয়ে সাংবাদিক উজ্জ্বল মেহেদীর জলোপাখ্যান ‘বারকি, জন বারকি’ বইমেলায় প্রকাশ হয়েছে। বাংলা একাডেমির আয়োজনে ঢাকায় বইমেলার শেষ সপ্তাহ ২৪ ফেব্রুয়ারি বইটি বিপননে এনেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চৈতন্য প্রকাশন। প্রচ্ছদ করেছেন খ্যাতিমান প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষ। বারকি-চিত্র অঙ্কন করেছেন অরূপ বাউল। জলোপাখ্যানের সচিত্রকরণ করেছেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশুচিত্রশিল্পী সিলেটের জালালাবাদ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী নওশীন আজিজ। বইমেলার পর বইটি সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন বই বিপণি কেন্দ্রে ও অনলাইন বিপণনে পাওয়া যাবে।
 

প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চৈতন্য জানিয়েছে, বারকি-কাহিনি ব্রিটিশ আমলের প্রথম ভাগের। ইংরেজরা যখন প্রশাসন সাজায়, তখন বাংলার জলমহাল এলাকায় নৌযানের একদল নৌ-কারিগর নিয়ে আসে। সেই দলে ছিল এক কারিগর, নাম তার জন বারকি। ব্রিটিশ হয়েও ইংরেজ প্রশাসন দলে কাজ করতে অনীহা তার। শাসকদের হয়ে নয়, সাধারণ মানুষের জন‍্য কিছু করতে চায়। স্বাধীনচেতা নৌ-কারিগর জন বারকি পালিয়ে সুনামগঞ্জের লাউড়ের গড় এলাকায় আশ্রয় নেয়। জলপথে ঘুরে ঘুরে চুনাপাথর পরিবহনে জাহাজের বদলে ছোট্ট একটি নৌকা বানায়। এই নৌকা পরবর্তীকালে জলজীবিকার হাতিয়ার হয়। নাম পড়ে ওই ইংরেজ কারিগর লোকটির নামেÑবারকি নৌকা। জলপথে এই নৌকার কর্তৃত্ব নিতে জন বারকিকে তাড়িয়ে দেয় শাসকদলের চর-অনুচরের দেশীয় কিছু কুচক্রী লোক। জন বারকিকে ‘গুম’ করার চেষ্টা হয়। এরপর তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। বাংলার উত্তরপূর্বকোণের জলতল্লাট (জলমহাল এলাকা) থেকে জন বারকি চলে গেলেও নৌকাটি টিকে আছে। চলছে আড়াই শতক-কাল ধরে।
 


সন তারিখ না থাকলেও হিসেবে করলে প্রায় আড়াইশ বছর আগের এক কাহিনি। প্রান্তজনের প্রান্তিক ইতিহাস। চাপা পড়া এ ইতিহাস প্রকাশ পেয়েছে সাংবাদিক উজ্জ্বল মেহেদীর অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকতায়। প্রায় ২৫ বছর আগে বারকি নৌকা নিয়ে প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ১১ মাসের চেষ্টায় লিপিবদ্ধ হয়েছে ‘বারকি’-কাহিনি। ব্রিটিশ আমলে সিলেটের প্রথম ‘কালেক্টরেট’ সূত্রপাতের সময়কে বিবেচনায় বারকি নৌকা নিয়ে বিভিন্ন স্থান ও স্থানীয় ইতিহাস ঘেঁটে বের করা হয়েছে কাহিনি।

চৈতন্যের প্রতিষ্ঠাতা ও সত্ত্বাধিকারী মো. জাহিদুল হক চৌধুরী রাজিব বইটির প্রকাশক। তিনি জানিয়েছেন, এর আগে সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিবেদন, বারকি নৌকা চলাচল প্রসিদ্ধ এলাকা সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসনের পর্যটন ব্রান্ডিং উদ্যোগ ‘বারকি’, সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান স্থপতি রাজন দাশের বারকি-স্থাপত্য জলোপাখ্যানের ভিত্তি তৈরি করে। এ দুটো কাজের পর প্রথমে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন উজ্জ্বল মেহেদী। এরপর মলাটবন্দি হয়েছে ‘জলজীবিকার জলোপাখ্যান : বারকি, জন বারকি’।
 

জলোপাখ্যান লেখক উজ্জ্বল মেহেদী জানান, জন বারকির গল্প ধরে হিসেব করলে আড়াইশ বছরের অধিক সময় ধরে চলমান বারকি নৌকা। প্রথম নির্মাণস্থল ছিল ব্রিটিশ আমলে শিল্পশহরখ্যাত সুরমা নদীতীরের সুনামগঞ্জের ছাতক। নৌকাটি প্রথম চলেছে সুরমা নদী দিয়ে ইছাকলস হয়ে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ ধলাই নদে। এরপর ঝাঁকে ঝাঁকে বারকি চলেছে এবং চলছে লোভাছড়া-জাফলং-ধলাই-চলতি-জাদুকাটা হয়ে সমগ্র সিলেট অঞ্চলে। জলতল্লাট নামের সিলেট অঞ্চলের জল-পাথর-বালুমহাল এলাকার নিজস্ব সংস্কৃতির একটি অংশ বারকি। নাও-নদীর ঐতিহ্যের সঙ্গী এই বাহনটি সবচেয়ে বেশি চলে সিলেটের গোয়াইনঘাট-কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়। বর্ষায় প্রায় ৫০ হাজার বারকি নৌকায় লক্ষাধিক শ্রমিকের জীবিকা নির্বাহ করেছে। আদি-ঐতিহ্যের সঙ্গে একটি উদ্ভাবনকে নিজের করে ছড়িয়ে দিতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহায়তায় গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন বারকি নিয়ে পর্যটন ব্রান্ডিং উদ্যোগ নিয়েছে। এতে করে বালু-পাথরের ভার বহমান বারকি নৌকা হাতের কাছে, দেখার সৌন্দর্যে ওঠে আসে। পাঠ অথবা জানার আগ্রহের মধ্যে এসেছে আমাদের শ্রম-মেধা আর উদ্ভাবন চেষ্টার গল্প।
 

শ্রমে-ঘামে-ঐতিহ্যে ভরপুর এ জীবনই বাংলাদেশের প্রান্তসীমার প্রাণ উল্লেখ করে উজ্জ্বল মেহেদী তার জলোপাখ্যান নয়, বারকি নৌকা নিয়ে বেশি আগ্রহী। বারকি-কাহিনির সঙ্গে বারকি-শ্রমিক জীবন নিয়ে মঞ্চনাটক নিয়ে কাজ করার কথা জানান। উজ্জ্বল মেহেদী বলেন, ইঞ্জিনের সঙ্গে লড়ে পৃথিবীর বুকে ইতিহাস হয়ে আছেন জন হেনরি। গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানের সেই গল্পের মতো না হলেও বুদ্ধি ও কৌশলের জোরে ব্রিটিশ শ্রমিক-নাগরিক জন বারকির উদ্ভাবনে বারকি নৌকা আমাদের জলজীবিকার নতুন এক কর্ম সূত্রপাতের ঐতিহ্য বহন করছে। যতদিন নদী-জলাভূমি থাকবে, যতদিন শ্রম ও জীবিকা থাকবে, ঠিক ততদিনই টিকে থাকবে বারকি শ্রমের বারকি নৌকা। 
 


সিলেটভিউ২৪ডটকম/প্রেবি/পল্লব-২৯