সেই পুরনো দৃশ্যপট যেন ফিরে এলো আবার। সেবারও ছিল নির্বাচন, এবারও তাই। পার্থক্য শুধু ‘স্থানীয় সরকার’ আর ‘দলীয় কাউন্সিলে’। নেতাদের চাপ, সরিয়ে দিতে নানামুখী তৎপরতা তথা বাদবাকি সবই এক। সেবারের মতো এবারও চাপের মুখে ‘কুল্লু খালাস’!

বদরুজ্জামান সেলিম। ছাত্ররাজনীতি দিয়ে ওঠে আসা এই বিএনপি নেতা বারবার ‘কাটা পড়ছেন’ চাপের মুখে। সিলেট মহানগর বিএনপির আসন্ন কাউন্সিলে সভাপতি পদপ্রার্থী থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে তাঁকে।


সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) সর্বশেষ নির্বাচনে মেয়র পদে তুমুল আলোচনায় ছিলেন। আরিফুল হক চৌধুরীকে টপকে দলীয় মনোনয়ন পেতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছিলেন তিনি। নগরীজুড়ে ব্যাপক প্রচারণায় আরিফের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিলেন সেলিম।

কিন্তু বিএনপির একটি শক্তিশালী পক্ষ প্রকাশ্যে বদরুজ্জামান সেলিমের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। দলের হাইকমান্ডও এই পক্ষে প্রভাবিত ছিল। ফলে নানামুখী চাপের মুখে পড়তে হয় সেলিমকে। দল থেকেও বহিষ্কার করা হয় তাঁকে।

শেষপর্যন্ত চাপের মুখে নতি স্বীকার করে ‘কুল্লু খালাস’ বলে মেয়র পদে প্রার্থীতা থেকে সরে দাঁড়ান বদরুজ্জামান সেলিম। ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর বাড়িতে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলন করেন সেলিম। সেদিন তিনি বিমর্ষচিত্তে মেয়র পদ থেকে প্রার্থীতার প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।

এরপর রীতিমতো ‘উধাও’ হয়ে যান বদরুজ্জামান সেলিম। রাজনীতির মাঠে কোথাও দেখা মেলেনি তাঁর। একপর্যায়ে জানা যায় তিনি আছেন যুক্তরাজ্যে। এ ছাড়া নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তাঁর দলীয় বহিষ্কারাদেশও প্রত্যাহার হয়।

বিএনপি নেতা-কর্মীরা জানান, দেশে ফিরে সাম্প্রতিক সময়ে ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন বদরুজ্জামান সেলিম। বিএনপির সভা, সমাবেশ, মিছিলে অংশ নেন সামনের সারিতে থেকেই। মহানগর বিএনপির ওয়ার্ড কমিটির সম্মেলনেও ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি।

মূলত মহানগর বিএনপির সম্মেলনকে লক্ষ্য বানিয়েছিলেন সেলিম। সম্মেলনকে সামনে রেখে গত ২১ জানুয়ারি রাতে নগরীর একটি হোটেলে নগর বিএনপির ২৭টি ওয়ার্ডের নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় করেন তিনি। সেখানেই নগর বিএনপির সভাপতি পদে নিজের প্রার্থীতার ঘোষণা দেন সেলিম।

এরপর সভাপতি পদে প্রার্থী হতে ব্যাপক তৎপর ছিলেন তিনি। হুমায়ুন কবির শাহীন, রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, নজীবুর রহমান নজীব, নিহার রঞ্জন দে, মাহবুব কাদির শাহী, মুর্শেদ আহমদ মুকুল, নুরুল আলম সিদ্দিকী খালেদ, সৈয়দ সাফেক মাহবুবসহ মহানগর বিএনপির একটি পক্ষও ছিল তাঁর সাথে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মাঠে তৎপর থাকলেও ২০১৮ এর মতো এবারও একই দৃশ্যপট এসে হাজির হয় বদরুজ্জামান সেলিমের সামনে। গত কয়েকদিন ধরে চাপ আসতে থাকে তাঁর ওপর। বিএনপিরই একটি পক্ষ সেলিমকে সম্মেলনের মাঠ থেকে সরাতে পাল্টা তৎপরতা শুরু করে। স্থানীয় পর্যায়ে তো বটেই, এই পক্ষ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও প্রভাবিত করার চেষ্টা চালায়, যাতে তিনি সেলিমকে সরে দাঁড়ানোর বার্তা দেন। একপর্যায়ে সফলও হয় পক্ষটি। তারেক রহমানের বার্তা পৌঁছে যায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে।

এরই প্রেক্ষিতে কাল সোমবার রাতে বদরুজ্জামান সেলিমের বাসায় যান বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির, দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান চৌধুরী, নগর বিএনপির আসন্ন কাউন্সিলে সভাপতি পদপ্রার্থী নাসিম হোসাইন, মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক জিয়াউল গনি আরোফিন জিল্লুর, আহবায়ক কমিটির সদস্য মাহবুব কাদির শাহী প্রমুখ।

[ছবি: কাল রাতে বদরুজ্জামান সেলিমের বাসায় বিএনপি নেতারা।]

ওই সময় সেলিমের বাসায় উপস্থিত থাকা একটি সূত্র সিলেটভিউকে জানায়, বিএনপি নেতারা তারেক রহমানের বার্তা পৌঁছে দেন বদরুজ্জামান সেলিমকে। সম্মেলন থেকে সরে দাঁড়াতে তাঁরা তাঁকে অনুরোধ জানান। সবার চাপের মুখে এবারও নতি স্বীকারে বাধ্য হন সেলিম। সম্মেলনে প্রার্থী হবেন না বলে জানিয়ে দেন নেতাদের।

এ বিষয়ে কথা বলতে আজ মঙ্গলবার দুপুরে এ প্রতিবেদক ফোন দেন বিএনপি নেতা বদরুজ্জামান সেলিমকে। কথা বলার সময় তাঁর কণ্ঠে ছিল ক্ষোভ আর কষ্টের রেশ।

কেন সরে দাঁড়ালেন, এমন প্রশ্নে সেলিম বলেন, ‘বক্তব্য নাই।’

ভিন্নভাবে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘জানি না আমি উত্তর।’

এরপর আরেকবার বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কোনো বক্তব্য নাই।’

বদরুজ্জামান সেলিমের সরে দাঁড়ানোর বিষয়ে কথা বলতে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরকে একাধিকবার কল করেও তাঁর সাড়া মেলেনি।

সম্মেলনে সভাপতি প্রার্থী, নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নাসিম হোসাইন সিলেটভিউকে বলেন, ‘বদরুজ্জামান সেলিম সম্মেলন থেকে সরে দাঁড়িয়ে আমাকে সমর্থন দিয়েছেন।’

প্রসঙ্গত, আগামী ১০ মার্চ সিলেট মহানগর বিএনপির সম্মেলন হওয়ার কথা। সম্মেলনে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ভোটাভুটির মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে। সভাপতি পদে বর্তমান আহ্বায়ক আব্দুল কাইয়ুম জালালী পংকি, সদস্যসচিব মিফতাহ সিদ্দিকী, যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান হাবিব, সাবেক সভাপতি নাসিম হোসাইন ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম মনোনয়নপত্র কিনেছেন। তবে সেলিম এবার সরে দাঁড়ালেন।

সাধারণ সম্পাদক পদে বর্তমান আহ্বায়ক কমিটর দুই যুগ্ম আহ্বায়ক ফরহাদ চৌধুরী শামীম ও এমদাদ হোসেন চৌধুরী মনোনয়নপত্র কিনেছেন। আর সাংগঠনিক সম্পাদক পদে মনোনয়নপত্র কিনেছেন ছাত্রদলের সাবেক নেতা সৈয়দ সাফেক মাহবুব, রেজাউল করিম নাচন, আখতার রশীদ চৌধুরী, মোস্তফা কামাল ফরহাদ ও আব্দুল্লাহ শফী সাহেদ।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে