পোলট্রি খাদ্য, ডিম, বাচ্চা ও মাংস একই প্রতিষ্ঠান থেকে উৎপাদন এবং সরবরাহ হয়—এমন করপোরেট প্রতিষ্ঠান দেশে হাতেগোনা কয়েকটি। পাশাপাশি এসব কোম্পানির রয়েছে ব্যাপক আকারের চুক্তিভিত্তিক খামার বা কন্ট্রাক্ট ফার্মিং ব্যবস্থা। যা সংখ্যার ভিত্তিতে পোলট্রি খাতের ১০ থেকে ২০ ভাগ বলা হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে তারাই প্রধান। প্রান্তিক খামারিরা যেখানে দৈনিক ৫ হাজার মুরগি সরবরাহের সক্ষমতা রাখেন, সেখানে করপোরেটের সক্ষমতা ১ থেকে ৫ লাখ পিস পর্যন্ত। ফলে বাজার অস্থিরতার এই সময়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কম খরচে বেশি উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছে তারা। এতে বাজার এককেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। বিপরীতে পোলট্রি সামগ্রীর দাম বেশি হওয়া প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না সাধারণ খামারিরা। লাগামহীনভাবে বাড়ছে মুরগির দাম। এ জন্য করপোরেটদের দায়ী করে আসছেন এ খাত-সংশ্লিষ্ট ও বিশ্লেষকরা। বাজার নিয়ন্ত্রণে ডিম ও মুরগির অযৌক্তিক দাম নির্ধারণের দায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলাও করে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। এর পরও থেমে থাকেনি দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা।

জানা গেছে, বাজার নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে করপোরেট কোম্পানিগুলো কখনো ডিম-বাচ্চা ও মুরগির উৎপাদন বাড়িয়ে সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। এতে বাজারে সরবরাহ বেশি থাকায় প্রান্তিক খামারিরা সঠিক দাম না পেয়ে লোকসান করেন। ফলে পরবর্তী ব্যাচে খামারি বাচ্চা ওঠাতে পারেন না। এ সুযোগে ডিম ও মুরগির উৎপাদন কমিয়ে বাচ্চা উৎপাদন বাড়ায় করপোরেটরা। একইভাবে পোলট্রি খাদ্যের সংকট তৈরি করে বাচ্চার দাম বাড়ানোর ফলে খামারিরা কিনতে পারেন না। এভাবে বিভিন্ন কৌশলে করপোরেটের কবলে পড়ে বন্ধ হচ্ছে প্রান্তিক খামার।


পোলট্রি খাতের প্রভাবশালী কোম্পানিগুলোর মধ্যে ডায়মন্ড এগ, কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোলট্রি, নর্থ এগ, সিপি বাংলাদেশ, আফিল এগ্রো, পিপলস পোলট্রি, নাবিল এগ্রো, রানা পোলট্রি, ওয়েস্টার পোলট্রি, আজিজুল হক এগ্রো এবং আপতাব এগ্রো নাম উল্লেখযোগ্য। এসব কোম্পানির ডিম উৎপাদন, পাইকারি বিতরণ কেন্দ্র, একের অধিক ফিড বা খাদ্য মিল, প্রক্রিয়াকরণ এবং প্যাকেজিং ব্যবস্থা রয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আছে শত শত একর জমি, যেখানে তারা লোকবল নিয়োগ করে খামার গড়ে তুলছে।

দেশের পোলট্রি খাতের ব্যবসায়ীদের প্রধান সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি)। তাদের আওতাভুক্ত সমিতির মধ্যে রয়েছে—ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএবি); ডিম উৎপাদক সমিতি (ইপিএবি); ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (এফআইএবি) এবং ওয়ার্ল্ডস পোলট্রি সায়েন্সের (ডব্লিউপিএসএ-বিবি) সদস্য হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী। বিপিআইসিসি তথ্যমতে, দেশে সরকারি নিবন্ধিত ফিড

বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘প্রান্তিক খামারিরা বর্তমানে প্রতি কেজি মুরগি বিক্রি করছেন ১৬০ টাকা দরে; কিন্তু সেখান থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত যেতে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাবে সেই দাম ২০০ টাকার ওপরে চলে যাচ্ছে। প্রান্তিক পর্যায়ে সাধারণ খামারিদের ৫০ কেজির এক বস্তা মুরগির খাবার ৩ হাজার ৬০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে, যা বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিতে থাকা খামারিরা পাচ্ছেন ২ হাজার ৫০০ টাকায়। অন্যদিকে সাধারণ খামারিদের প্রতি পিস বাচ্চা কিনতে হচ্ছে ৬০ টাকায়; কিন্তু করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মুরগির বাচ্চা, ডিম, খাদ্য ও ওষুধ উৎপাদন করায় তাদের খরচ অনেক কম পড়ছে। অন্যদিকে এসব কোম্পানি থেকে বেশি দামে বাচ্চা, খাদ্য এবং ওষুধ কিনতে হচ্ছে সাধারণ খামারিদের। এতে তাদের ব্যয় বেশি এবং লাভ কম হচ্ছে। এ কারণে ব্যক্তি পর্যায়ের খামারিরা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হচ্ছেন।’

তিনি বলেন, বাজারে মুরগির দাম বেশি থাকায় বর্তমানে প্রতিদিন ১ কোটি ৮০ লাখ বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে; কিন্তু দাম কম গেলে বহুজাতিক কোম্পানির মালিকরা বাচ্চার উৎপাদন কমিয়ে ৫০ লাখে নিয়ে আসে। সেই সময় তারা শুধু নিজেদের চুক্তিভিত্তিক খামারে বাচ্চা সরবরাহ করে।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কৃষিবিদ ডা. মনোজিৎ কুমার সরকার টেলিফোনে বলেন, ডিম, মুরগি, খাদ্য ও ওষুধের বাজার বড় কোম্পানির হাতে। তারা চাইলে বাজার ওঠানামা করে। প্রান্তিক খামারিরা বেশিরভাগ সময় তাদের প্রতি মুখাপেক্ষী থাকে। যদিও তাদের সংখ্যা কম, কিন্তু তারাই নিয়ন্ত্রক। তবে তাদেরও লাভ করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু তা যৌক্তিকতা ছাড়িয়ে গেছে। বলা হচ্ছে, বিদেশে কাঁচামালের দাম বেড়েছে। সে হিসেবে আমাদের কত বাড়বে, তা তো ঠিক করা দরকার। ৫ টাকার বাচ্চা ৬০ টাকা হওয়ার কথা নয়। এভাবে অন্যান্য পোলট্রি সামগ্রীর একই অবস্থা। তাদের নিজেদের উৎপাদন ঠিক থাকলেও সাধারণ খামারিরা ভালো নেই।

চুক্তিভিত্তিক খামার সম্পর্কে এই কর্মকর্তা বলেন, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং পদ্ধতি উন্নত দেশে রয়েছে। এ ব্যবস্থা খারাপ, তা বলা যাবে না। তবে একচেটিয়া বাজার গড়ে তোলা খারাপ। এ কাজ শুধু করপোরেটরা করে না। মধ্যম সারির কিছু লোকও করে থাকে। তারা বিভিন্ন কোম্পানির পোলট্রি পণ্যের স্থানীয় ডিলার হয়। অথবা কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে এলাকাভিত্তিক কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করে। গেল কয়েক বছর থেকে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং ব্যাপক হারে বাড়ছে। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণ পর্যায়ক্রমে তাদের হাতে চলে যাচ্ছে। বাজারের দামের বিষয়ে করপোরেটদের আন্তরিক হতে হবে, সরকারের তদারকি থাকতে হবে। সবাই যাতে ন্যায্য মুনাফা পেতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

কন্ট্রাক্ট ফার্মিং কৌশল>>
এক সময় লাভে ছিল, কিন্তু করোনা ও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তারা এখন লোকসানে। এসব খামারিকে টার্গেট করে গড়ে তোলা হচ্ছে কন্ট্রাক্ট ফার্ম। মূলত লোকসানে থাকা খামারিরা দায়দেনা মেটাতে মূল কোম্পানি এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ডিলারের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিতে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে কাজ না হলে করপোরেট প্রতিষ্ঠান পার্শ্ববর্তী অন্য কোনো খামার গড়ে তোলে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত খামারি একপর্যায়ে খামার বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে খামারি চুক্তিভিত্তিক খামারে যাচ্ছেন। যদিও এর প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে প্রান্তিক খামারিদের সমিতিগুলো। বলা হচ্ছে, করপোরেট কোম্পানির হাতে ১০ শতাংশ বাজার, তারা আরও ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করছে। বাকিটা প্রান্তিক খামারি। কিন্তু বাজারের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি করপোরেটদের হাতে।

পোলট্রি শিল্পের কয়েকটি সংগঠন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে পার্থক্য থাকলেও বলা হচ্ছে, ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১ কোটি ৮০ লাখ বাচ্চা উৎপাদন হয়েছে, যা বর্তমানে ১ কোটি ৩৫ লাখ প্রায়। দেখা যাচ্ছে, বাচ্চা উৎপাদন কমেছে ৪৫ লাখ বা ২৫ শতাংশ। আর এ জন্য খামার বন্ধ হওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে। এই সময়ে চাহিদা কম থাকলেও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বাচ্চার দাম না কমিয়ে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যেজন্য সাধারণ খামারিরা লোকসানের ভয়ে উচ্চমূল্যে বাচ্চা কিনতে চাচ্ছেন না। আর এই সুযোগে নিজেদের খামারে কম মূল্যে বাচ্চা ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করছে করপোরেট প্রতিষ্ঠান, যা খামারিদের চুক্তিভিত্তিক হতে বাধ্য করছে।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে


সূত্র : কালবেলা