‘১৫১ সদস্যের নির্বাহী কমিটিতে এক পরিবারেরই চারজন! গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাকেই যেখানে নামকাওয়াস্তে উপদেষ্টা কমিটিতে নেওয়া হয়েছে, সেখানে একই পরিবারের চারজন মূল কমিটিতে পদ পাওয়া খুবই দৃষ্টিকটু।’

এই বক্তব্য সিলেট জেলা বিএনপির এক নেতার। তাঁর বক্তব্যে ক্ষোভের সুর সহজেই টের পাওয়া যায়। মূলত সিলেট জেলা বিএনপির সদ্যঘোষিত পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘিরে বিতর্কের সুর ক্রমেই উচ্চ হচ্ছে। অবশ্য দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, কমিটি ঘিরে সবসময়ই ছোটখাটো বিতর্ক থাকে, এগুলো রাজনীতির অংশ।


গেল বছরের ২৯ মার্চ সিলেট জেলা বিএনপির সম্মেলন হয়। সম্মেলনে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে তিনজন কাউন্সিলরদের ভোটগ্রহণের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচিত করা হয়। ভোটে আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী সভাপতি, এমরান আহমদ চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক ও মো. শামীম আহমদ সাংগঠনিক সম্পাদক হন।

সম্মেলনের এক বছরের মাথায় এসে কাল রোববার (১৯ মার্চ) রাতে জেলা বিএনপির ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর বাইরে উপদেষ্টা কমিটিতে আছেন আরও ৯১ জন।

বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নির্বাহী কমিটিতে সহসভাপতি ২০ জন, যুগ্ম সম্পাদক ১২ জন, সাংগঠনিক সম্পাদক ৫ জন রয়েছেন। কোষাধ্যক্ষ ছাড়াও সম্পাদকীয় পদে আছেন ৩১ জন। বাকিরা সহসম্পাদক ও সদস্য পদ পেয়েছেন।

কমিটিতে নারী আছেন ৭ জন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি পেয়েছেন পদ।

বিএনপি নেতা-কর্মীরা বলছেন, বিগত প্রায় চার দশক ধরে যারা সিলেটে বিএনপিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, এগিয়ে নিয়েছেন, সাংগঠনিক শক্তি বাড়িয়েছেন, তাঁদের কাউকেই নির্বাহী কমিটিতে রাখা হয়নি। তাঁদেরকে ‘নির্বাসনে’ পাঠানো হয়েছে উপদেষ্টা কমিটিতে।

কমিটিতে বেশ কয়েকজন প্রবাসীকেও স্থান দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্য বিএনপির সহসভাপতি গোলাম রব্বানীকে জেলা বিএনপির সহসভাপতি করা হয়েছে। যুক্তরাজ্য প্রবাসী আছকির আলীও সহসভাপতি পদ পেয়েছেন। ফ্রান্সপ্রবাসী জালাল খানকে করা হয়েছে মৎস্য বিষয়ক সম্পাদক। যুক্তরাজ্য প্রবাসী তামিম ইয়াহইয়াকে কমিটিতে সহ-শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক পদ দেওয়া হয়েছে। আরব আমিরাত প্রবাসী ও দুবাই বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাহেদ আহমদ রাসেলকে এবারের কমিটিতে সহ-অর্থনীতি বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে।

বিএনপি নেতা-কর্মীরা বলছেন, এবারের নির্বাহী কমিটিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকেই যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি, অনেককেই উপদেষ্টা কমিটিতে নেওয়া হয়েছে। বিপরীতে ইলিয়াস আলীর পরিবার থেকে নির্বাহী কমিটিতে পদ পেয়েছেন চারজন।

কমিটিতে দেখা গেছে, ‘নিখোঁজ’ বিএনপি ইলিয়াস আলীকে ১ নম্বর সদস্য করা হয়েছে। তাঁর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা দ্বিতীয় সদস্য, তাঁদের ছেলে আবরার ইলিয়াস এগারোতম সদস্য হিসেবে কমিটিতে আছেন। এ ছাড়া ইলিয়াস আলীর ভাই আছকির আলী সহসভাপতি পদ পেয়েছেন।

শুরুতে যে নেতার বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেই নেতা বলছিলেন, ‘ইলিয়াস আলীকে কমিটিতে রাখা নিয়ে কথা নেই। তাঁর স্ত্রীও যেহেতু রাজনীতিতে কিছুটা সক্রিয়, তাঁকেও রাখা যায়। কিন্তু ইলিয়াসের ছেলে, যে বেশিরভাগ সময়ই যুক্তরাজ্যে থাকে, রাজনীতিতেও তার কোনো অবদান নেই, তাকে কেন কমিটিতে রাখতে হবে? ইলিয়াস আলীর ভাইও যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে থাকেন; তাকেইবা কেন গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হলো?’

এদিকে, আগে থেকেই একাধিক পদে থাকা কোনো কোনো নেতাকে এবার জেলা বিএনপির কমিটিতে রাখা হয়েছে। তন্মধ্যে রয়েছেন জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুহ আহমেদও। এই যুবদল নেতা যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক। এবার তাকে জেলা বিএনপির কমিটিতে তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক পদ দেওয়া হয়েছে।

একই নেতার একাধিক পদ পাওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে যুবদল নেতা লিটন আহমেদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমাদের কোনো কোনো সহকর্মী আজ পদভারে পিষ্ট। সব জায়গাতেই তাদের পদ বিচরণ। এতো পদ রাখি কোথায়! শো-কেসে সাজিয়ে রাখুন, ঘর আলোকিত করবে, দলকে নয়। যারা পদহীন, অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, মামলা হামলায় জর্জরিত, তাদের আহাজারি আপনাদের কানে পৌঁছায় না। অনেক ধন্যবাদ আপনাদেরকে।’

বিএনপি নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উভয়ের বাড়িই সিলেট-৩ আসনে পড়েছে। তাঁরা আগামী নির্বাচনের বিষয়টি চিন্তা করে নিজেদের পাল্লা ভারি করতে এই আসনভুক্ত এলাকা থেকে বেশি সংখ্যক নেতাকে নির্বাহী কমিটিতে পদ দিয়েছেন।

এদিকে, কমিটি ঘিরে বিতর্কের জেরে কেউ কেউ সরে যেতে শুরু করেছেন। সিলেট জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন দিনারকে জেলা বিএনপির কমিটিতে সহ-ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে। কিন্তু দিনার ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কমিটিকেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সিলেট জেলা বিএনপির এই কমিটিতে যোগ্যতার বা যোগ্যদের সঠিক পদায়ন হয়নি, তাই আমি এই কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করলাম। পরবর্তী সিদ্ধান্ত আমি জানাবো।’

সিলেট মহানগর ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বি আহসানকে জেলা বিএনপির কমিটিতে সহ-ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে। তিনিও কমিটি থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এই ছাত্রদল নেতা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি সিলেট মহানগর ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক। আমার সিলেট জেলা বিএনপির রাজনীতির সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। জেলা বিএনপির কমিটি থেকে আমি আমার নিজের নাম প্রত্যাহার করছি।’

বিএনপি নেতা-কর্মীরা বলছেন, জেলা বিএনপির নির্বাহী কমিটির বাইরে ৯১ সদস্যবিশিষ্ট যে উপদেষ্টা কমিটি করা হয়েছে, সেখানে অনেক ‘সক্রিয় ও ত্যাগী’ নেতাকে রাখা হয়েছে; যাদেরকে মূল কমিটিতে রাখা উচিত ছিল। তাঁদেরই একজন এ টি এম ফয়েজ। দক্ষিণ সুরমা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ফয়েজ ছিলেন জেলা বারের দুইবারের নির্বাচিত সভাপতি। জেলা ও মহানগর বিএনপির বিগত দুটি সম্মেলনে কাউন্সিলরদের ভোটগ্রহণ কার্যক্রমে নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।

মহানগর মহিলা দলের সভাপতি এডভোকেট রোকসানা বেগম শাহনাজ সিলেটভিউকে বলেন, ‘কাউকে যদি সম্মান দেওয়া না যায়, তাকে অসম্মানিত করার অধিকার কারো নেই। এ টি এম ফয়েজ বিএনপির সক্রিয়, নিবেদিতপ্রাণ ও ত্যাগী নেতা। বিএনপির রাজনীতি করায় মামলার আসামি হয়ে তাকে আদালতে ঘুরতে হয়। তার মতো নেতাকে নামকাওয়াস্তে উপদেষ্টা কমিটিতে রাখা হয়েছে! আওয়ামী লীগ আমাদের নেতা-কর্মীদের একেবারে গুম করে দেয়, এখন দেখছি আমাদের দল রাজনীতি থেকে নেতাদের গুম করে দিচ্ছে!’

উপদেষ্টা কমিটিতে থাকা এ টি এম ফয়েজ সিলেটভিউকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেব না। আমাকে উপদেষ্টা কমিটিতে রাখার বিষয়ে আমি পরে প্রতিক্রিয়া জানাবো।’

জেলা বিএনপির উপদেষ্টা কমিটিতে পদ পাওয়া আরেক নেতা বলছিলেন, ‘আমি সবসময় রাজপথের রাজনীতিতে সক্রিয়। নেতা-কর্মীদের সাথে আমার নিবিড় যোগাযোগ। রাজনীতি করতে গিয়ে মামলারও আসামি। আগামী নির্বাচনে দল অংশ নিলে আমার আসনে দলীয় মনোনয়নও চাইবো আমি। অথচ আমাকে রাখা হয়েছে উপদেষ্টা কমিটিতে। এর চেয়ে না রাখলেই তো পারতো! এখন পদত্যাগ করবো কিনা, সেই চিন্তা করছি।’

সামগ্রিক বিষয়ে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী সিলেটভিউকে বলেন, ‘রাজনীতিতে কমিটি নিয়ে ছোটখাটো মতপার্থক্য, বিতর্ক থাকেই। এগুলো রাজনীতিরই অংশ। আমরা একটি সুন্দর, পরিচ্ছন্ন কমিটি দেওয়ার চেষ্টা করেছি শতভাগ। সক্রিয়, ত্যাগী, নিবেদিতপ্রাণ নেতাদের সমন্বয়ে কমিটি করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ বলছেন আমি সহসভাপতি হতে চেয়েছিলাম, আমাকে কেন উপদেষ্টা কমিটিতে রাখা হলো। কিন্তু উপদেষ্টা পদ কিন্তু সহসভাপতি পদমর্যাদার সমান।’

ইলিয়াস পরিবারের চারজন কমিটিতে থাকা প্রসঙ্গে কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘ইলিয়াস আলী আমাদের জনপ্রিয় নেতা। সরকার তাঁকে গুম করে রেখেছে। আমরা বিশ্বাস করি, একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এই সরকারের পতন ঘটবে এবং ইলিয়াস আলীকে ফিরে পাবো। সবদিক বিবেচনায় তাঁকে ১ নম্বর সদস্য করা হয়েছে। তাঁর স্ত্রী লুনা দলের চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা। স্বাভাবিকভাবেই তিনি জেলার সদস্য পদ হয়েছেন। আছকির আলী সাবেক ছাত্রনেতা, জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। নিজের যোগ্যতাবলে তিনি এবার সহসভাপতি হয়েছেন। আবরার ইলিয়াস মানবাধিকার বিষয়ক বিএনপির একটি কমিটির সদস্য। সে প্রেক্ষিতে তাকে জেলা শাখায় সদস্য করা হয়েছে। আমরা মূলত যার যার যোগ্যতা, দক্ষতা দেখেছি। কে কোন পরিবারের, সেটা দেখা হয়নি।’

‘ছোটখাটো’ বিতর্ক কাটিয়ে নতুন কমিটির অধীনে জেলা বিএনপি আরও শক্তিশালী হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে