মূলত যারা তরুণ, এলাকায় জনপ্রিয় অথচ বিগত জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি, তাদেরকে টার্গেট করে আগামী নির্বাচনে সংসদ সদস্য বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে এলাকায় কাজ করার জন্য গ্রিন সিগনাল দিয়েছে বিএনিপির এই ‘ইনসাফি অংশটি’। এ সিগনালের কারণেই দলের অনেক স্থানীয় জনপ্রিয় নেতা দলীয় কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয় থাকেন। এর তালিকাও বিএনপির হাইকমান্ডের কাছে রয়েছে বলে দাবি করছেন দলটির নেতারা।


সম্প্রতি রাজনীতিতে, বিশেষ করে বিএনপি ও সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত দলগুলোর মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রে ফরহাদ মজহার ও বিএনপি থেকে সদ্য বহিষ্কৃত নেতা শওকত মাহমুদের নেতৃত্বাধীন ‘ইনসাফ’। এই ইস্যুতে অস্বস্তিতে পড়েছে বিএনপি। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় জনপ্রিয় ‘বিরোধী নেতাদের’ নিয়ে বিএনপির ‘বি’ টিম তৈরি করে আগামী জাতীয় নির্বাচনে এর ব্যানারে (ইনসাফ) অংশগ্রহণ করাই মূলত উদ্দেশ্য ইনসাফের। ইতিমধ্যে এই ‘বি’ টিম ২১৬ জন প্রার্থীও বাছাই করেছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। আর এ পরিকল্পনায় জড়িত সন্দেহভাজন ৪২ জনের নাম লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে রয়েছে বলে দলের একজন ভাইস চেয়ারম্যান জানিয়েছেন।


গত ১৬ মার্চ রাতে রাজধানীর বনানীর একটি হোটেলে ‘ন্যাশনাল কমিটি ফর সিভিল রাইটস জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি’ নামে নাগরিক অধিকার বিষয়ক একটি সংগঠনের যাত্রার ঘোষণা দেন সংগঠনের আহ্বায়ক রাজনৈতিক বিশ্লেষক কবি ফরহাদ মজহার এবং সদস্য সচিব শওকত মাহমুদ। সংগঠনটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন করে সেই সরকারকে বাংলাদেশের নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং তার অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও এ ধরনের পৃথক প্ল্যাটফরম গড়ে তোলায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে শওকত মাহমুদকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বিএনপি নেতাদের ধারণা, এটি বিএনপিবিরোধী প্ল্যাটফরম এবং সরকারের প্রেসক্রিপশনেই ইনসাফ পরিচালিত হচ্ছে। ভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এটি তৈরি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বিএনপি থেকে সদ্য বহিষ্কৃত ভাইস চেয়ারম্যান জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শওকত মাহমুদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এটি কোনো রাজনৈতিক দল নয়। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমার মতো চুনাপুঁটি দিয়ে সরকার বিএনপি ভাঙতে যাবে কেন, কত রাঘববোয়াল আছে।’

তিনি বলেন, ‘মূলত অনেক সিনিয়র নেতা উল্টাপাল্টা করতে পারে। আমাকে বহিষ্কার করে তাদের থ্রেট করা হয়েছে।’

১/১১ থেকে শিক্ষা নিয়ে বিএনপিতে আর সংস্কারপন্থি বানাতে চান না দলটির শীর্ষনেতারা। এবারও সরকার থেকে বিএনপির একটি বলয়কে নির্বাচনে অংশ নেয়ার নীলনকশা করা হবে- এটি মাথায় রেখেই সন্দেহভাজনদের প্রতি তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখছেন দলটির নেতারা। এবার দলের ভিতর ১/১১ মতো পরিবেশ দেখতে চান না তারা। চিহ্নিতদের শিকড় উপড়ে ফেলতে নির্বাচনের আগেই কঠিন সিদ্ধান্তে যাবে বিএনপি, এমনটিই জানিয়েছেন দলটির একজন শীর্ষনেতা।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের বেশ কিছু নেতাকে আগে থেকেই নজরদারিতে রেখেছে বিএনপি।

গত সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে (ভার্চ্যুয়াল) ইনসাফ এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদের প্রসঙ্গে বিস্তর আলোচনা হয়। তাতে শওকত মাহমুদকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জোরালো মত দেন সদস্যরা। তাকে বহিষ্কারের পর অনেকের মধ্যেই শঙ্কা কাজ করছে।

সূত্রমতে, বৈঠকে সন্দেহের তালিকায় আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার কথা উঠলেও এখনই বহিষ্কার না করার বিষয়ে মতামত দেন স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য।

এর আগে ২০২২ সালের ২৭ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ‘পেশাজীবী সমাজের’ ব্যানারে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সমাবেশে শওকত মাহমুদসহ কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর বিএনপি এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নেন। যেখানে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীও ছিলেন। পরে গত বছরের ৬ এপ্রিল দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে পেশাজীবীদের ব্যানারে ওই সমাবেশ করায় শওকত মাহমুদের কাছে ব্যাখ্যা চায় বিএনপি ৷

২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টের সামনে বিক্ষোভে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জানানো হয়। এর পরের বছরের ১৩ ডিসেম্বর ‘সরকারের পতনের’ লক্ষ্যে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ ও জমায়েত করা হয়। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকায় ওই সময়েও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহমেদ, শওকত মাহমুদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল।

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি রাজধানীর বনানীর একটি হোটেলে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নৈশভোজের আযোজন করে। সেখানে সংগঠনের সদস্যসচিব শওকত মাহমুদ ইনসাফ কায়েম কমিটির পক্ষে অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকার গঠন এবং ওই সরকারের অধীনে নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব তুলে ধরেন। সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের শরিক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া, লেবার পার্টির ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ মজিদ, অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ইউসুফ হায়দার চৌধুরী, সাবেক রাষ্ট্রদূত সাকিন আলী ও সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজী, হাসান হাফিজ, ইলিয়াস খান, দিগন্ত মিডিয়ার চেয়ারম্যান শিব্বির মাহমুদ, কল্যাণ পার্টির মুখপাত্র আব্দুল্লাহ আল হাসান সাকিব, জাগপার মুখপাত্র রাশেদ ইঞ্জিনিয়ার প্রধান প্রমুখ।

গত তিনদিন আগে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ নিয়ে মতবিরোধ থেকে বিএনপির মিত্র মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের লেবার পার্টি ১২ দলীয় জোট ত্যাগ করে।

দলীয় সূত্রমতে, ওইদিন বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী ও দলের বঞ্চিত নেতাদের অনেকেই অংশগ্রহণের কথা ছিল। তবে দলের তরফ থেকে তাদেরকে ওই অনুষ্ঠানে যোগদান না করতে অনুরোধ জানানো হয়। তাদের প্রতিও নজর রাখছে বিএনপি। তবে সংগঠনের স্বার্থে ও দলীয় শৃঙ্খলা ধরে রাখতে শক্ত অবস্থানে বিএনপির হাইকমান্ড। চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তার জন্য এ বিষয়ে কৌশলী হচ্ছে বিএনপি।

এ বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘আমরা দলীয় কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না, এটা পরিষ্কার। এখানে ইনসাফ বা বেইনসাফ কে কী করলো তাতে বিএনপির কিছু আসে যায় না।’

তিনি বলেন, ‘আগেও বিএনপির আকাশ থেকে অনেক বড় বড় তারা (নক্ষত্র) চলে গেছে, বিএনপির ক্ষতি হয়নি। বরং যারা চলে গেছেন, তারাই হারিয়ে গেছেন।’

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক বলেন, ‘বিএনপি সিদ্ধান্ত নিতে অতীতেও কোনো ভুল করেনি, এখনো করে না। যারা ভুল করবে, অন্যায় করবে তাদের শাস্তি পেতেই হবে। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা অমান্যকারী এবং চক্রান্তকারীদের জন্য একটি ম্যাসেজ। দলে থেকে দলের বিরুদ্ধে কাজ করা যাবে না। দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা কুচক্রীদের কোনো ক্ষমা নেই।’

এ বিষয়ে ইনসাফের আহ্বায়ক ফরহাদ মজহারের বক্তব্য নেয়ার জন্য একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/ডেস্ক/ইআ-০৪