জয়ের দিকে তাকিয়ে শান্তরা।

রেকর্ডটি সিলেট ফ্র্যাঞ্চাইজির। রাখঢাক না করে যদি বলা হয়, তবে রেকর্ডটি আসলে লজ্জার!

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) শুরু হয় ২০১২ সালে। তখন সিলেটের নামে ফ্র্যাঞ্চাইজি ‘সিলেট রয়্যালস’ নামে ছিল। প্রথম আসরেই লজ্জার রেকর্ডটি নিজেদের করে নেয় তারা। আসর শুরু হওয়ার পর টানা ৭ ম্যাচে হারে সিলেট রয়্যালস!


সময় গড়িয়ে বিপিএল এখন দশম আসরে। কিন্তু সিলেট রয়্যালসের সেই রেকর্ড আর কেউ ‘ভাঙেতে পারেনি’।

বিপিএলের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সিলেট ফ্র্যাঞ্চাইজির নামের পরিবর্তনের সংখ্যাও বেড়েছে। কখনো সিলেট রয়্যালস, কখনোবা সিলেট থান্ডার; কখনো সিলেট সানরাইজার্স, কখনোবা সিলেট সুপার স্টার্স কিংবা সিলেট সিক্সার্স। এবার ফ্র্যাঞ্চাইজির নাম সিলেট স্ট্রাইকার্স। বিপিএলে সিলেটই একমাত্র দল, যাদের মালিকানা সর্বোচ্চ ছয়বার পরিবর্তন হয়েছে!

শুরুর আসরে সিলেট রয়্যালস টানা হারের যে ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন’ রেকর্ড গড়েছিল, সেই রেকর্ড এবার ডাকছে সিলেট স্ট্রাইকার্সকে। টানা ৫ ম্যাচে হেরে ৭-এর পানে যেন চলেছে দলটি।

অথচ গেল আসরে দারুণ পারফরম্যান্স ছিল সিলেট স্ট্রাইকার্সের। শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে না পারলেও প্রথমবার রানার্সআপ হওয়াটা কম আনন্দের ছিল না দলটির জন্য।

কিন্তু এবার রীতিমতো বিভীষিকা! ঢাকায় দুই হারের পর ‘ঘরের মাঠ’ সিলেটে টানা তিন পরাজয়। বারবার একাদশে পরিবর্তন, পরিকল্পনায় বদল এনেও সাফল্যের সোনালী সূর্য ছুঁতে পারছে না দলটি।

অবশ্য সিলেট স্ট্রাইকার্স মালিকপক্ষ সাফল্যের জন্য কতোটা উন্মুখ, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন বলে মনে করেন ক্রিকেট বিশ্লেষকরা। কারণ, টি-টোয়েন্টির জন্য যেরকম দল গঠন করা প্রয়োজন, তা করতে ব্যর্থ ফ্র্যাঞ্চাইজিটি। দেশি তো বটেই, বিদেশি কোনো বড় তারকাও দলে নেই।

দেশিদের মধ্যে নাজমুল হোসেন শান্ত আছে সিলেটে। গেল আসরে সর্বোচ্চ ৫১৬ রান করা শান্ত এবার রানের খোঁজে হয়রান। ৫ ম্যাচে তার রান ৩৬, ১৪, ৫, ৫ ও ৯!

শুধু শান্তই নন, সিলেটের একমাত্র জাকির হাসান ছাড়া বাকি ব্যাটারদের কারোর পারফরম্যান্সই গড়পড়তার উপরে নয়। ফ্র্যাঞ্চাইজিটির হয়ে এবারের আসরে একমাত্র ফিফটি করেছেন জাকির; সঙ্গে আরও তিনটি ত্রিশ ছাড়ানো ইনিংসে তার রান ১৮৯, যা এই আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

বাদবাকিদের অবস্থা তথৈবচ। মোহাম্মদ মিঠুন প্রথম ম্যাচে ৪০ রানের ইনিংস খেললেও পরের তিন ম্যাচে করেন ৫, ০ ও ১ রান। চতুর্থ ম্যাচে ছিটকে যান একাদশ থেকে। ইয়াসির আলী চৌধুরী দুই ম্যাচে করেছেন ১০ রান! বিদেশিদের মধ্যে বেনি হাওয়েল, বেন কাটিং, হেরি টেক্টর থাকলেও তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ফল পাচ্ছে না সিলেট স্ট্রাইকার্স।

জাকির ১৮৯ রান করলেও সিলেটের অন্য কোনো ব্যাটারই এবারের আসরে সব ম্যাচ মিলিয়ে ৮০ রানের ঘরও টপকাতে পারেননি!

ব্যাটিংয়ের মতো বোলিংয়েও ছন্নছাড়া সিলেট। এবারের আসরে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায় সেরা দশে নেই দলটির কেউ। অভিজ্ঞ মাশরাফি বিন মুর্তজা ছিলেন সিলেট স্ট্রাইকার্সের অধিনায়ক। টানা পাঁচ ম্যাচে খেললেও তিনি বোলিং করেছেন মাত্র ৭.৩ ওভার, উইকেট পেয়েছেন ১টি। একাদশে থাকলেও তার কাছ থেকে গড়পড়তা পারফরম্যান্সও পায়নি সিলেট। তানজিম হাসান সাকিব ৪ ম্যাচে ওভারপ্রতি সাড়ে ৯ রান করে দিয়ে পেয়েছেন ৩ উইকেট। রেজাউর রহমান রাজা ৩ ম্যাচে উইকেটশূন্য। বাঁহাতি স্পিনার নাজমুল ইসলাম ২ ম্যাচে ২ উইকেট পেয়েছেন। পরে আর সুযোগ পাননি। ইংলিশ অলরাউন্ডার বেনি হাওয়েল ৩ ম্যাচে ৩টি, আরেক ইংলিশ অলরাউন্ডার সামিট প্যাটেল ৩ ম্যাচে ৩টি, লঙ্কান স্পিনার দুশান হেমন্থ ২ ম্যাচে ৩টি, অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডার বেন কাটিং ২ ম্যাচে ১টি উইকেট নিয়েছেন। খানিকটা ভালো করছেন জিম্বাবুইয়ান পেসার রিচার্ড এনগারাভা ৪ ম্যাচে নিয়েছেন ৫টি উইকেট।

পারফরম্যান্সের মতো নেতৃত্ব নিয়েও সমালোচনার কাঠগড়ায় সিলেট স্ট্রাইকার্স। একেবারে আনফিট, দীর্ঘদিন খেলায় না থাকা মাশরাফিকে ‘জোর করে’ নেত্বত্বে রাখে তারা। এ নিয়ে আকরাম খান, মোহাম্মদ আশরাফুলের মতো সাবেক ক্রিকেটাররাও সমালোচনায় মুখর হন। তবে যে আশায় ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’কে নেতৃত্বে রাখে সিলেটের মালিকপক্ষ, পূর্ণতা পায়নি সে আশা। মাশরাফির নেতৃত্বের ‘ম্যাজিক’ কাজে আসেনি এবার। শেষমেষ ‘সংসদে হুইপের দায়িত্ব পালনের কথা’ বলে এবারের বিপিএল থেকে ‘বিরতি’ নিয়েছেন মাশরাফি।

নতুন যে অধিনায়ক করেছে সিলেট স্ট্রাইকার্স, সেই মোহাম্মদ মিঠুনকে ঘিরেও আছে প্রশ্ন। অধিনায়ক মানেই পারফরম্যান্সে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া। কিন্তু মিঠুনের ব্যাট থেকে এ আসরে ভালো পারফরম্যান্স দেখা গেল কই! ৪ ম্যাচে করেছেন মাত্র ৪৬ রান! বাজে পারফরম্যান্সের কারণে সিলেটের পঞ্চম ম্যাচে একাদশেই ছিলেন না তিনি। সেই মিঠুনকে হুট করে অধিনায়কত্ব সমঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সবমিলিয়ে সিলেটের পারফরম্যান্স এবার নিবু নিবু প্রদীপ। আসরে তাদের ম্যাচ বাকি ৭টি। এসব ম্যাচে ‘ভালো করার’ আশা যেমন আছে সিলেট স্ট্রাইকার্স শিবিরে, তেমনি টানা ৭ ম্যাচে হারের অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার হাতছানিও আছে। তবে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে সাফল্য খোঁজা সিলেট এখন ‘ঘুরে দাঁড়ানোর’ দিকেই মনোযোগী।

যেমনটি বলছিলেন দলিটির ইংলিশ অলরাউন্ডার বেনি হাওয়েল, ‘আমরা এখন ঘুরে দাঁড়াতে চাই। আমাদের শুধু পরিকল্পনাটা ঠিকঠাক মতো বাস্তবায়ন করতে হবে।’

‘এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি। বিভিন্ন ম্যাচে আমরা যেসব জিনিস ঠিক করছি, সেগুলো সব একই ম্যাচে করতে হবে আমাদের। আশা করি, পরের ম্যাচেই আমরা সেটি করতে পারব। সামনের কথাই এখন ভাবতে হবে।’

হ্যাঁ, কাগজে-কলমে সিলেট স্ট্রাইকার্সের সব এখনও ‘শেষ হয়ে যায়নি’। কিন্তু যে দল হতশ্রী পারফরম্যান্সে টানা ৫ ম্যাচে হারে, সেই দল পরের ৭ ম্যাচে জয় তুলে নিয়ে টুর্নামেন্টে টিকে থাকবে, সেই আশা খানিকটা দূরাশাই বটে!

গেল আসরেও সিলেটের বড় শক্তি ছিল দর্শক সমর্থন। ভালো পারফরম্যান্সের ফলে সেই সমর্থন বেড়েছিল তাদের। এবারও দর্শকদের, বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক। সেই প্রত্যাশা এখন চুপসে যাওয়া বেলুন। দর্শক-সমর্থকরাও ক্ষুব্ধ। ভালো দল গড়তে সিলেটের ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকপক্ষকে প্রয়োজনে টাকা দিতেও রাজি অনেকে! অবস্থা এমন যে, সিলেটের সবশেষ ম্যাচে সিলেটের সমর্থকরাই প্রতিপক্ষ দল ফরচুন বরিশালের পক্ষে স্লোগান দিয়েছেন!

তেতে থাকা দর্শক-সমর্থকদের শান্ত করার উপায় অবশ্য জানা সিলেট স্ট্রাইকার্সের। সেই ‘উপায়’ একটাই—জয়!

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে