ইউরোপের দেশ পর্তুগাল অভিবাসীদের জন্য জোটের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশিই বন্ধুবৎসল। দেশটির ক্ষমতাসীন বামপন্থি সরকার অভিবাসীদের জন্য আইন-কানুন নানা সময়ে সহজ করেছে। তবে আসছে সপ্তাহের নির্বাচনে দেশটির কোনো রক্ষণশীল দল ক্ষমতায় আসলে হয়তো পরিস্থিতি ভিন্ন রকম হতে পারে।

 


দক্ষিণ-পূর্ব পর্তুগালের সাই তেওতোনিও নামের ছোট্ট শহরে পুর্তগীজ রেস্টুরেন্টের চেয়ে ভারতীয় ও নেপালি রেস্টুরেন্টেই বেশি চোখে পড়ে। অবশ্য, এই শহরে দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় শহরটিতে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের দোকান, রেস্তোরাঁ বেশি হবে এটিই স্বাভাবিক।

 

নেপাল থেকে আসা ৩৬ বছরের মেশ খাত্রি ও তা স্ত্রী রিতু পর্তুগালের এই শহরটিতে বাস করেন৷ খাত্রি একটি খামারে কাজ করেন আর তার স্ত্রী রিতু ‘নেপালি’ নামের একটি ক্যাফে পরিচালনা করেন।

 

সাত বছরের একটি পুত্র সন্তান আছে এই দম্পতির। ছোট্ট ছেলেটি পুর্তগীজ ভাষায় কথা বলতে পারেন৷ এক আধটু ইংরেজিও বলতে পারে। তবে মাতৃভাষা নেপালিতে কথা বলতে পারে না শিশুটি।


বেলজিয়াম থেকে ২০১২ সালে পুর্তগালে এসেছিলেন খাত্রি। বেলজিয়াম থেকে পুর্তগালে আসার কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বললেন, ‘‘বেলজিয়ামে রেসিডেন্স পারমিট পাওয়া খুব কঠিন। তাই আমি এই দেশে (পর্তুগালে) এসেছিলাম৷ এখানে (পর্তুগালে) কাগজপত্র (নিয়মিত হওয়ার জন্য) পাওয়া সহজ।’’

 

নেপালের এই অভিবাসী আরো জানালেন, পর্তুগালে আসার পাঁচ বছরের মাথায় তিনি দেশটিতে আইনিভাবে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় রেসিডেন্স পারমিট পান। এর দুই বছর পর পর্তুগালের নাগরিকত্ব পান খাত্রি।

 

ইউরোপের আর পাঁচটি দেশে যখন স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পেতে দীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পেরোতে হয়, তখন পর্তুগালে এই বিষয়গুলো অনেকটা সহজ। দেশটির বৈধ অর্থনীতিতে অভিবাসীরা দ্রুতই নিজেদের যুক্ত করার সুযোগ পান। কর এবং সামাজিক বিভিন্ন চার্জ প্রদানের আওতায় যুক্ত হন দ্রুত।


আর এমন পরিস্থিতিতে পর্তুগালে গত পাঁচ বছরে বিদেশিদের ঘরে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে। এর অনেকগুলো কারণের একটি হলো দেশটির রেস্টুরেন্ট, মৎস্য এবং কৃষিখাতে দক্ষিণ এশীয়দের উপস্থিতি।

 

সরকারের ইন্টিগ্রেশন, মাইগ্রেশন ও অ্যাসাইলাম বিভাগের পরিসংখ্যান বলছে, পর্তুগালে বিদেশির সংখ্যা স্থানীয় জনসংখ্যার প্রতি দশ জনে একজন।

 

পরিসংখ্যান বলছে, পর্তুগালে বিদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্রাজিলিয়ান৷ মোট চার লাখ ব্রাজিলিয়ান নাগরিক বসবাস করছেন দেশটিতে ৷ এরপরে রয়েছে ব্রিটিশেরা ওবং ইউরোপের অন্য দেশের নাগরিকেরা।

 

সেইসঙ্গে ৫৮ হাজার ভারতীয় এবং ৪০ হাজার নেপালি পর্তুগালে বাস করছেন। বাংলাদেশি এবং পাকিস্তানিদের সংখ্যাও নতুন করে আগতদের মধ্যে প্রথম দশ দেশের তালিকায় রয়েছে।

 

বিদেশিদের দেশটিতে ব্যাপক আগমন অবশ্য পর্তুগালে ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্ট সরকারের উদার নীতির কারণেই সম্ভব হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে দলটি ক্ষমতায়৷ তবে আশঙ্কা হলো, আসছে ১০ মার্চের নির্বাচনে কোনো ডানপন্থি সরকার ক্ষমতায় আসলে পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

 

অভিবাসীদেরকে এই দেশটির প্রয়োজন। আর তাই এখানে অভিবাসীর সংখ্যা বাড়ছে, এভাবেই বিষয়টিকে ব্যাখা করতে চাইলেন ইন্ট্রিগ্রেশন, মাইগ্রেশন ও অ্যাসাইলাম বিভাগের গোয়েস পিনহেইরো। বললেন, ‘‘অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়ার প্রধান কারণ হলো দেশটির তাদেরকে প্রয়োজন।’’

 

তিনি জানালেন, ইটালির পর ইউরোপে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বয়স্ক লেকেদের বাস পর্তুগালে।

 

শহরটির আরেক কৃষক লুইস কার্লোস ভিলা। খামারে কাজ চালিয়ে নিতে বিদেশিদের উপর নির্ভর করতে হয় বলে জানালেন এই কৃষক। ‘‘আমার আর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের এখানে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশি এবং কৃষিখাতে শ্রমিক নেই,’’ বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানালেন তিনি।

 

এদিকে শুধু কৃষিখাতেই নয়, দেশটির মৎস্যখাতও বিদেশি শ্রমিকের উপর নির্ভর করছে৷ জানা গেছে, পর্তুগালের মৎস্যখাতের বেশিরভাগ শ্রমিকই এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়া থেকে এসেছেন।

 

তাদেরই একজন সাইফুল আরদানি। গত ১৮ মাস ধরে পর্তুগীজ ব্যবসায়ী রুইস গোমেসের প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনি। বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিনি জানান, ‘‘এখানে ইন্দোনেশিয়ার জেলেদের কাজ করতে কোনো সমস্যা নেই। দেশে পরিবারও আমাদের বিষয়ে নিশ্চিত, কারণ আমরা বৈধ পথে এখানে এসেছি।’’      

 

সব মিলিয়ে গত দুই দশক ধরে ইউরোপর দেশ পর্তুগাল হয়ে উঠছে অভিবাসীদের গন্তব্য।

 

পর্তুগালের লিসবন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইগ্রেশন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ইয়োর্গে মালহেইরিস বলেন, ‘‘আপনি যেই দিক দিয়েই বিবেচনা করুন না কেন, অভিবাসন ইস্যুতে পর্তুগাল ইউরোপের সবচেয়ে বেশি উদার দেশ।’’

 

অভিবাসীদের নিয়ে এই ‘উদারতা’ গত প্রায় দুই দশক ধরেই দেখা যাচ্ছে৷ ২০০৭ সালে থেকে দেশটি অভিবাসীদেরকে নিয়মিত হওয়ার জন্য কাগজপত্র দেয়া শুরু করে, যারা নিজেদের আয় প্রকাশ করতো৷ পরে বামপন্থি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৮ সালে অনিয়মিত পথে আসা ব্যক্তিদেরও কাগজপত্র দেয়া শুরু করে। আর ২০২২ সালের নতুন এক সংশোধনী অনুযায়ী, চাকরির সন্ধানে বিদেশিদের ছয় মাসের ভিসা দেয়াও শুরু করে পর্তুগাল সরকার।

 

তবে এসব ইতিবাচক দিকের কিছু মন্দ দিকও দেখছেন নেপালের খাত্রি। বললেন, বিদেশিদের এমন আগমনের ফলে কিছু সমস্যাও তৈরি হয়েছে।

 

খাত্রির স্ত্রী রিতু বলেন, ‘‘আগে এখানে (পর্তুগালে) জীবন যাপনের খরচ যোগানো সহজ ছিল। এখন এখানে বর্ণবাদের সমস্যা দেখা দিয়েছে।’’

 

কোনো বাসায় যদি ১০-১৫ জন থাকেন এবং তারা স্থানীয় ভাষায় কথা বলতে পারেন না, তখন পুর্তগীজরা তা পছন্দ করেন না, রিতু বললেন।

 

সেইসঙ্গে দেশটির আবাসন সংকট তো আছেই, যা অভিবাসীদের আগমনের কারণে আরো বাড়ছে বলে মনে করেন অনেকে।

 

বাংলাদেশি দোকানপাট, রেস্তোরাঁ :

লিসবন শহরের প্রাণকেন্দ্রে চোখে পড়ে বেশ কিছু বাংলাদেশি দোকান ও রেস্তোরাঁ। শহরটির কেন্দ্রীয় সড়কটিকে অনেকেই বাংলাদেশি সড়ক নামে চেনে বলে জানালেন অভিবাসী ইয়াসির আনোয়ার।

 

২০১০ সালে ডেনমার্ক ও নরওয়ে পাড়ি দিয়ে পর্তুগালে আসেন তিনি। সেসময় তার কোনো আইনি কাগজপত্র ছিল না। তবে ২০১৮ সালের সরকার নিয়ম শিথিল করার পর তিনি দেশটিতে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পান।

 

এর মাঝে একটি রেস্টুরেন্টে চাকরি শুরু করেন তিনি। সেখান থেকে তিনি পুর্তগীজ খাবার রান্নার দক্ষতা অর্জন করেন। আর সেই সাথে পুর্তগীজ ভাষা শেখেন৷ এখন দেশটির নাগরিকত্ব পাওয়ার অপেক্ষায় আনোয়ার।

 

‘‘যখন আমি এখানে এসেছিলাম, আমাদের জন্য কিছুই ছিল না। এরপর থেকে পর্তুগাল অভিবাসীদের জন্য খুব উদার দেশ হয়ে উঠে।’’

 

ইমিগ্রেশন সলিডারিটিতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন আনোয়ার।

 


সিলেটভিউ২৪ডটকম / ইনফোমাইগ্রেন্টস / ডি.আর