সিলেটের প্রবাসী অধ্যুষিত বিশ্বনাথে পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরদের পাল্টাপাল্টি ভার্চুয়াল বাহাসে বেরিয়ে আসছে ‘নামে-বেনামে ও অনিয়ম-দূর্নীতি’র মাধ্যমে নানান প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের খবর!

 


 

পৌর মেয়র-কাউন্সিলরদের দ্বন্দের জের ধরে বিশ্বনাথে সংগঠিত হয়েছে একাধিক হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা। চলমান রয়েছে মামলাও। এতে বিরাজ করছে চরম উত্তেজনা। মাত্র একটি বছর যেতে না, যেতেই মেয়র-কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অর্থ আতœসাতের অভিযোগে কপালে চোখ উঠেছে পৌরবাসীর। কারণ ওই এক বছরে পৌর এলাকায় দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়িত না হলেও পৌরবাসীর দেওয়া ট্যাক্সের কয়েক কোটি টাকা পৌর একাউন্টে জমা হয়েছে।

 

 

দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বনাথ পৌরসভার প্রথম নির্বাচনে নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের মধ্যে ‘লুটপাট, চাঁদাদাবী ও পাওয়া, না পাওয়া’ নিয়ে দ্বন্দ চলে আসলে সম্প্রতি এটি চরম আকার ধারণ করেছে। মেয়র নিজের পিএস-এপিএসের মাধ্যমে কাউন্সিলরদের কাজ থেকে লিল্লার ফান্ডের নামে চাঁদা আদায় করছে এমন একটি অডিও ক্লিপ ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর হতবাক হয়ে পড়েন পৌরবাসী। সেই অডিও ক্লিপে চাঁদা আদায় নিয়ে মেয়র’সহ কাউন্সিলরদের  ওপেন কথাবার্তা ফুটে উঠেছে। আর এসব কারণে বর্তমানে তাদের ওই দ্বন্দে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পৌর মেয়র ও কাউন্সিলরবৃন্দ। তিনজন কাউন্সিলরকে সাথে নিয়ে এর একটি পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন পৌর মেয়র মুহিবুর রহমান নিজে। আর সাতজন কাউন্সিলরকে সাথে নিয়ে অপর পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন প্যানেল মেয়র-১ রফিক মিয়া।

 

 

পৌর মেয়র-কাউন্সিলরদের দ্বন্দের জের ধরে গত ১৬ এপ্রিল পৌরসভার প্যানেল মেয়র-১ রফিক মিয়ার নেতৃত্বে থাকা ওই ৭ কাউন্সিলর পৌর মেয়র মুহিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ‘ভারসাম্যহীনভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার, কাউন্সিলর ও জনগণের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ প্রদর্শন ও গালিগালাজ, স্বজনপ্রীতি, ময়লা-আবর্জনার পরিস্কার করাসহ ভ‚য়া প্রকল্প দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা আতœসাৎ’র অভিযোগ এনে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব বরাবরে ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন ২০০৯ এর ৩৮ ধারা মোতাবেক’ অনাস্থা প্রস্তাব দাখিল করেন। রফিক মিয়া ছাড়াও সেই অনাস্থা প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছেন পৌরসভার প্যানেল মেয়র-২ সাবিনা বেগম, ২নং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রাসনা বেগম, ৩নং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর লাকী বেগম, ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রাজুক মিয়া রাজ্জাক, ৭নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহুর আলী ও ৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শামীম আহমদ। এরপূর্বে গত ৯ এপ্রিল দুপুরে পৌরসভা কার্যালয়ের কাউন্সিলর হল রুমে প্যানেল মেয়র-১ রফিক মিয়ার সভাপতিত্বে ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন ২০০৯ এর ৩৮ ধারা’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এক বিশেষ জরুরী সভা করে ‘অনাস্তার প্রস্তাব’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন কাউন্সিলররা।

 

 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে পৌর মেয়র ও কাউন্সিলরদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগের বিষয়টি গোটা বিশ্ববাসী দেখতে, জানতে ও বুঝতে পারছেন। এতে করে বিশ্বনাথের মানসম্মান নষ্ট হলেও যেনো তাদের কোন দায় নেই, তারা ব্যস্থ রয়েছেন নিজের ইগ্যো নিয়ে। ইতিপূর্বে পৌর মেয়র মুহিবুর রহমান, কাউন্সিলর রফিক মিয়া ও শামীম নূর নিজেদের ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে পাল্টাপাল্টি অনিয়ম-দূর্নীতির অভিযোগগুলো জনসম্মুখে তুলে আনছে। যার ফলে বিষয়গুলোর পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে এলাকায় এলাকায় বাড়ছে উত্তেজনা ও চরম হতাশা। তাদের দ্বন্দের জের ধরে পৌর এলাকার যেকোন এলাকায় বড় ধরণের অনাকাঙ্খিত ঘটনা সংগঠিত হওয়ার ধারণাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না সচেতন সমাজের নেতৃবৃন্দ।

 

 


এদিকে পৌর মেয়র মুহিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সাত কাউন্সিলরের অনাস্থা প্রস্তাব দেওয়ার (১৬ এপ্রিল) একদিন পরই ১৮ এপ্রিল মেয়র মুহিবুর রহমান নিজের নামের ফেসবুক পেইজে পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-১ রফিক মিয়া (রফিক হাসান) বিরুদ্ধে একটি রাস্তায় টিআর কর্মসূচীর ১ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে সরেজমিন গিয়ে তদন্ত করে ভিডিও ছেড়েছেন মুহিবুর রহমান। একই দিন (১৮ এপ্রিল) বিকেলে কাউন্সিলর মোঃ শামীম নুর’র ফেসবুক পেইজে একটি ভিডিওতে দেখা যায় মেয়র সাহেবের দুর্নীতির সচিত্র ফিরিস্তি পর্ব-১ তুলে ধরেছেন প্যানেল মেয়র-১ রফিক মিয়া। তিনি এই ভিডিওতে বলেছেন বিশ্বনাথ পুরান বাজারের গরুর হাটে অনুমান মাত্র ৫/৬ লাখ টাকার ইটসলিং কাজ করে প্রায় ২৩ লাখ টাকা বিল তুলেছেন। এছাড়াও মেয়র কোনো প্রকার রেজুলেশন অথবা টেন্ডার ছাড়া এই কাজ করেছেন। এই ভিডিওতে দেখাগেছে মেয়র মুহিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অনাস্তা প্রস্তাবে স্বাক্ষরকারী অপর ৬ জন কাউন্সিলর রয়েছেন। এরপর ১৯ এপ্রিল ও ২০ এপ্রিল প্যানেল মেয়র-১ রফিক মিয়া নিজের পেইজে পৃথক দুটি ভিডিও ছাড়েন। এতে দেখা গেছে স্থানীয় কাউন্সিলরের (রফিক) বিরুদ্ধে মেয়রের করা অভিযোগকে মিথ্যা দাবী করেছেন এলাকাবাসীও এবং এলাকাবাসীর দাবী যে কাজ চলাকালে মেয়র একাধিকবার পরিদর্শন করেছেন, প্রায় এক বছর পর সেই কাজে স্থানীয় কাউন্সিলরের (রফিক) বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ কিভাবে আনেন মেয়র। এতে এলাকায় সম্যা বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছুই হবে না। এছাড়া সম্প্রতি ৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শামীম আহমদের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে অর্থ আতœসাতের অভিযোগ এনে নিজের পেইজে একটি ভিডিও ছেড়েছেন মেয়র। আর কাউন্সিলর শামীম আহমদ মেয়রের ছাড়া ভিডিও’র পাল্টা ভিডিও ১মে ফেসবুকে ছাড়বেন বলেন জানিয়েছেন।

 

 


গত ২৩ এপ্রিল পৌর মেয়র মুহিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ‘মারধর, শ্লীলতাহানী ও মেয়রের নির্দেশে গাড়ি দিয়ে প্রাণে হত্যা’র চেষ্টার অভিযোগ আনেন পৌরসভার ২নং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর রাসনা বেগম। এর পরদিন (২৪ এপ্রিল) আহত নারী কাউন্সিলর রাসনা বেগম বাদী হয়ে মেয়র মুহিবুর রহমান’কে প্রধান অভিযুক্ত করে বিশ্বনাথ থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ৫ (তাং ২৪.০৪.২৪ইং)। ২৯ এপ্রিল এ মামলায় মেয়র আদালত থেকে জামিন লাভও করেছেন।

 

 

গত ২৮ এপ্রিল বিকেল ৩টার দিকে পৌরসভার মেয়র মুহিবুর রহমানের উপর ‘মারধর, শ্লীলতাহানী ও মেয়রের নির্দেশে গাড়ি দিয়ে প্রাণে হত্যা’র চেষ্টার অভিযোগ এনে নারী কাউন্সিলর রাসনা বেগমের মামলা দায়েরের প্রতিবাদে (মামলা নং ৫, তাং ২৪.০৪.২৪ইং) পৌর শহরের নতুন বাজার এলাকাস্থ মেয়রের বাসার সামনে প্রতিবাদ সভা আহবান করেন মেয়র পক্ষের লোকজন। অন্যদিকে একই সময়ে প্রায় একশ গজের মধ্যে নারী কাউন্সিলর ও উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রাসনা বেগমের উপর ‘হামলার প্রতিবাদে এবং পৌর মেয়র মুহিবুর রহমানের গ্রেপ্তার ও অপসারণের’ দাবীতে প্রতিবাদ সভা আহবান করে পৌর আওয়ামী লীগ। কিন্তু সভাগুলো শুরুর পূর্বেই উভয় পক্ষের পক্ষে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়। এসময় মেয়রের বাসা লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন পৌর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। ইট পাটকেল নিক্ষেপের সময় কয়েকটি সিএনজি চালিত অটোরিক্সা ও দোকানপাঠ ভাংচুরের ঘটনা সংগঠিত হয় এবং প্রায় আধা ঘন্টা বিশ্বনাথ-রামপাশা-লামাকাজী সড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল। এতে পথচারী নারী ও শিশু’সহ কমপক্ষে ১০ জন আহত হন।

 

 

মেয়রের আনা অভিযোগের ব্যাপারে বিশ্বনাথ পৌরসভার প্যানেল মেয়র-১ রফিক মিয়া বলেন, মেয়র সাহেব আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছেন তা মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব দেওয়ার কারণেই এখন তিনি এমন অভিযোগ আনছেন। এতো দিন তিনি কোথায় ছিলেন। কারণ আমাকে দেয়া টিআর প্রকল্পের কাজ তদন্ত করে বিল দিয়েছে পিআইও অফিস। আর মেয়র নিজের ক্ষমতা বলে টেন্ডার না করে তার পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে কাজ করান এবং ময়লা-আবর্জনা পরিস্কারের বিলও তিনি করে। কারণ একাজগুলোর চেগের ক্ষমতা একমাত্র মেয়রের রয়েছে। তাই তার ইচ্ছে মতো অধিক টাকার প্রকল্প করে তিনি নিজস্ব ঠিকাদার দিয়ে কাজ করে টাকা উত্তোলন করে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করছেন।

 

 


এব্যাপারে জানতে বিশ্বনাথ পৌরসভার মেয়র মুহিবুর রহমানের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

 

 

সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডি.আর