সিলেট মহানগরের পুরাতন ২৭টি ওয়ার্ডে হঠাৎ করে এক লাফে হোল্ডিং ট্যাক্স (গৃহকর) বেড়ে গেছে কয়েক শ গুণ। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন এসব ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। তারা বলছেন- দ্রব্যমূল্যের অবিরাম ঊর্ধ্বগতির বাজারে সাধারণভাবেই জীবনযাপন যেখানে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে এমন হারে বাড়ানো হোল্ডিং ট্যাক্স তাদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।

 


 

 

সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) সম্প্রতি আরোপ করা ‘অস্বাভাবিক হারের’ হোল্ডিং ট্যাক্সের তথ্য নগরভবনের সামনে ক্যাম্প করে মহানগরের পুরাতন ২৭টি ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের জানিয়ে দিচ্ছে এবং ট্যাক্স আদায় করছে। আর এ তথ্য জানতে বা ট্যাক্স দিতে গিয়ে সবাই অবাক হচ্ছেন, হচ্ছেন ক্ষুব্ধ। অনেকেই সমালোচনায় মেতে উঠেছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর। কিন্তু যখন জানতে পারছেন- এই নতুন হোল্ডিং ট্যাক্সের অ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) বা হার নির্ধারণ করেছে সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর পরিষদ, তখন নগরবাসীর সব ক্ষোভ গিয়ে পড়ছে আরিফ চৌধুরীর উপর।

 

 

 

সিসিক সূত্র সিলেটভিউ-কে জানায়, বর্তমানে নির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্সের জন্য ফিল্ড সার্ভে হয় ২০১৯-২০ অর্থবছরে। ২০২১ সালের আগস্টে তৎকালীন সিসিক (সাবেক মেয়র আরিফ চৌধুরীর) পরিষদের বিশেষ সভায় সেটি পাস হয়। কর ধার্য্যের অর্থবছর নির্ধারণ করা হয় ২০২১-২২ সাল। ওই অ্যাসেসমেন্টে মোট ৭৫ হাজার ৪ শ ৩০টি হোল্ডিংয়ে ১ শ তেরো কোটি ২৭ লক্ষ ৭ হাজার ৪ শ ৪৫ টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সেটি অনুমোদনের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হলে পরে ২০২১ সালের অক্টোবরে তা অনুমোদিত হয়।

 

 

 


এদিকে, কর ধার্য্যের অর্থবছর ২০২১-২২ সাল নির্ধারিত থাকলেও ‘রহস্যজনক’ কারণে সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সেটি তার মেয়াদকালে কার্যকর করেননি। বর্তমান মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর পরিষদ সেটি কার্যকর করতে গিয়ে পড়েছে রীতিমতো জনরোষে। তবে শেষ পর্যন্ত যারা জানতে পারছেন- এই হোল্ডিং ট্যাক্সের হার পাস হয়েছে আরিফুল হক চৌধুরীর মেয়াদকালে তখন সব ক্ষোভ তারা ঝাড়ছেন সাবেক মেয়রেরই উপর।

 

 

 


নগরভবনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের প্রাঙ্গণজুড়ে শামিয়ানা টানিয়ে করা হয়েছে বড় একটি ক্যাম্প। ক্যাম্পটি শুরু হয়েছে ৩০ এপ্রিল থেকে, চলবে ১৪ মে পর্যন্ত। তবে সরকারি ছুটির দিন ক্যাম্পে কোনো কার্যক্রম হবে না। ক্যাম্পের মধ্যে রয়েছে ৪০টির মতো বুথ। এর মধ্যে প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য আলাদা বুথ, একটি ইনফরমেশনের জন্য এবং বাকিগুলো লিখিতভাবে আপত্তি জানানোর। ক্যাম্পের বিভিন্ন খুুঁটিতে লাগানো রয়েছে হোল্ডিং ট্যাক্স-বিষয়ক নানা তথ্যসম্বলিত ফেস্টুন। তথ্য জানা বা ট্যাক্স দেওয়ার ওয়ার্ড-নির্দিষ্ট কয়েকটি বুথের সামনে দেখা গেলো নারী-পুরুষের দীর্ঘ সারি। এছাড়া প্রাঙ্গণজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন লোকজন। সবার মুখে একটাই কথা- হঠাৎ করে হোল্ডিং ট্যাক্স খুব বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে সিসিক কর্তৃপক্ষ। যা তাদের জন্য পরিশোধ করা কষ্টদায়ক হবে। তবে বেশ কয়েকজনকে ট্যাক্স পরিশোধ করতেও দেখা গেছে।

 

 

 

 

এদিকে শুধু তথ্য জানা বা ট্যাক্স দেওয়ার ওয়ার্ড-নির্দিষ্ট বুথগুলোর সামনেই লম্বা সারি নয়, আপত্তি জানানোর কয়েকটি বুথের সামনেও দেখা গেলো মানুষের বেশ ভিড়। তারা নির্দিষ্টি ডি-ফরম পূরণ করে লিখিতভাবে তাদের আপত্তি জানাচ্ছেন। তাদের মাঝে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ ও অসন্তোষ। নগর কর্তৃপক্ষের প্রতি তাদের দাবি- দ্রুত এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হোক।

 

 


 


এ বিষয়ে সিসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. মতিউর রহমান খান সিলেটভিউ-কে বলেন- ‘হোল্ডিং ট্যাক্সের জন্য দুই ধরণের অ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) করা হয়। একটি জেনারেল অ্যাসেসমেন্ট, ৫ বছর পর পর হয়। আর আরেকটি অ্যাসেসমেন্ট করা হয় প্রতি বছর, সিসিকের রাজস্ব শাখার নিজস্ব লোক দিয়ে। তবে সিসিকে ২০০৫ সালের পর কোনো অ্যাসেসমেন্ট হয়নি। ২০০৫ সালের অ্যাসেসমেন্টের নির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্স ২০০৭ সাল থেকে কার্যকর হয়। তবে ২০১১ সাল থেকে গণপূর্ত অধিদপ্তর (পিডব্লিউডি) কর্তৃক সিটি করপোরেশনের জন্য নির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্স নগরবাসীর কাছ থেকে আদায় করা হতো। তবে বর্তমানে আরোপিত হোল্ডিং ট্যাক্সের অ্যাসেসমেন্ট ২০১৯-২০ অর্থবছরে করা হয় এবং এখন সেটি মহানগরের পুরাতন ২৭টি ওয়ার্ডের জন্য কার্যকর করা হয়েছে। আর নতুন ওয়ার্ডগুলোতে অ্যাসেসমেন্টের কাজ চলমান রয়েছে, শেষ হলে এসব ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের হোল্ডিং ট্যাক্সের পরিমাণ জানিয়ে দেওয়া হবে।’

 

 

 


২৭টি ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের অভিযোগ-আপত্তি নিয়ে তিনি সিলেটভিউ-কে বলেন- ‘মূলতঃ হোল্ডিং ট্যাক্স খুব বেশি বাড়ানো হয়নি। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণত প্রতি ৫ বছর পর একবার করে হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করার নিয়ম। কিন্তু সিসিকে দীর্ঘদিন তা করা হয়নি। প্রায় ২০ বছর পর নতুন হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করায় মানুষের কাছে একটু বেশি-ই মনে হচ্ছে। তারপরও সিসিক কর্তৃপক্ষ আপত্তি করার সুযোগ রেখেছে। নির্দিষ্ট ডি-ফরম পূরণ করে তার যৌক্তিক দাবি তুলে ধরলে তা যাচাই করা হবে। আর এটি যাচাই করার জন্য কয়েক দিনের মধ্যেই রিভিউ বোর্ড গঠন করা হবে। এই বোর্ড পরবর্তীতে শুনানির দিন ধার্য্য করবে এবং আপত্তিকারীর দাবি যৌক্তিক হলে তাঁর ট্যাক্স কমিয়ে দেওয়া হবে।’

 

 


এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, আমি একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি।  সিলেট নগরের সর্বস্তরের জনগণ মেয়র পদে আমাকে নির্বাচিত করেছেন। জনগণের ভোগান্তি বা ক্ষতি হয় এমন কোনও কাজ আমাকে দিয়ে হবে না।

 


 

তিনি আরও বলেন, হল্ডিং কর নিয়ে যদি কোনোরূপ অসঙ্গতি/অমিল পাওয়া যায় তবে অবশ্যই ডি-ফরমের মাধ্যমে আপত্তি করার ব্যবস্থা রয়েছে।

 

 


বিষয়টি নিয়ে নগরবাসীকে উদ্বিগ্ন না হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণের ভোগান্তি বা কষ্ট হয় এমন কোনো কাগজে আমি স্বাক্ষর করবো না। আর এই বিষয়টিও সম্মানিত নাগরিকদের সাথে আলোচনা করে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাবো।

 

 

 


মঙ্গলবার (৭ মে) দুপুরে মহানগরের কিনব্রিজ এলাকায় সুরমা নদী পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের মেয়র এসব কথা বলেন।

 

 

 

সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডালিম