ওয়ার্ক পারমিট বা কাজের ভিসায় রোমানিয়ায় গিয়ে দুর্দশায় পড়েছেন বহু প্রবাসী বাংলাদেশি। নির্মাণ খাতের কাজ নিয়ে রোমানিয়ায় এসে প্রতিশ্রুত বেতন না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন একদল বাংলাদেশি শ্রমিক৷ কর্মক্ষেত্রে নানা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন তারা৷ দেশটির রাজধানী বুখারেস্টে শোচনীয় পরিস্থিতিতে কোনোমতে টিকে আছেন এসব বাংলাদেশিরা৷ অভিবাসন নিয়ে সংবাদ প্রকাশকারী পোর্টাল ইনফোমাইগ্রেন্টসের প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।


সংবাদ মাধ্যমটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুখারেস্টে একতলা একটি ভবনে প্রায় ৫০ জন দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী কর্মীর বসবাস৷ সেখানকারই একটি কক্ষের বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহীন৷ ভালো আয়-রোজগারের স্বপ্নে ১৩ মাস আগে সাত লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচে তিনি এসেছেন ইউরোপের দেশ রোমানিয়াতে৷ শাহীন জানান নির্মাণ খাতের কাজের কথা বলে দেশটিতে আনা হলেও ‘সাপ্লায়ার’ তাকে কাজ দিয়েছে একটি কারখানায়৷



তার দাবি, বাংলাদেশ থেকে আসার আগে তাকে তিন হাজার লিউ বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭০ হাজার টাকা বেতনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল৷ কিন্তু শাহীন এখন বেতন পান আড়াই হাজার লিউ৷ আসার আগে বলা হয়েছিল কোম্পানিই করের টাকা বহন করবে৷ কিন্তু আসার পর সেই টাকা তাকেই বহন করতে হচ্ছে৷ তার উপরও বেতন থেকে প্রতিমাসে কর্মী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ২০০ থেকে ৪০০ লিউ কেটে রাখে বলেও অভিযোগ করেন তিনি৷ বাকি টাকা দিয়েই সারা মাস চলতে হয়৷ নেই চিকিৎসা ভাতা বা অন্যান্য কোনো সুযোগ-সুবিধা৷


কেন বেতন কাটছে তার কোনো কৈফিয়তও দেয় না
শুধু শাহীন নন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেতন না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন এই ভবনটিতে থাকা অন্য বাংলাদেশিরাও৷ মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম এসেছেন গত বছরের মে মাসে৷ তিনিও জানান, চুক্তি অনুযায়ী তিন হাজার লিউ পাওয়ার কথা থাকলেও কর কেটে রাখার পর তিনি আড়াই হাজার লিউ হাতে পান৷ আক্ষেপ করে বলেন, ‘আট-নয় লাখ টাকা খরচ করে এসে যদি ৫০ হাজার টাকা রোজগার করা না যায় তাহলে তো এখানে থেকে লাভ নাই৷’


শুধু তাই নয়, অনেক সময় কী কারণে বেতনের টাকা কেটে রাখা হয় নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সেই ব্যাখ্যাটুকুও দেয় না বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন৷ সাত মাস আগে আসা শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘কোম্পানি কিছু হলেই চাকরি থেকে বের করে দেয়৷ না হলে বেতন কেটে রাখে৷ কেন কাটছে তার কোনো কৈফিয়তও দেয় না৷’


কুষ্টিয়া থেকে আসা মোহাম্মদ রাজীব হোসেন বলেন, ‘আমরা সরাসরি কোম্পানির মাধ্যমে এসেছি৷ সেই কোম্পানি আরেক কোম্পানির কাছে আমাদের বেঁচে দিয়েছে৷ আমাকে বলা হয়েছিল তিন হাজার লিউ পাব৷ দেয়া হয় দুই হাজার৷’


এমন অবস্থায় বেতনের টাকা দিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ে এই অভিবাসীদের৷ তাই বাড়তি আয়ের জন্য তারা প্রত্যেকেই কম-বেশি ফুড ডেলিভারি বা ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী খাবার তার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার কাজ করেন৷ শাহীন বলেন, ‘ফুড ডেলিভারি না করলে বাড়ি থেকে টাকা এনে খেতে হতো৷’


কেড়ে নেয়া হয় বসবাসের অনুমতিপত্র


এই অভিবাসীদের অভিযোগ রোমানিয়ায় আসার পর তারা টিআরসি বা সাময়িক বসবাসের যে অনুমতিপত্র পেয়েছেন তা কেড়ে নেয়া হয়, যাতে অন্য কোনো কোম্পানিতে তারা কাজ নিতে না পারেন৷ এমনকি বেতন-ভাতা বা কাজ নিয়ে অসন্তোষের কথা জানালে নিয়োগকর্তা প্রতিষ্ঠান তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে বলেও হুমকি দেয়৷ এমন অবস্থায় তারা অন্যায়ের শিকার হলেও একই কোম্পানিতে কাজ করে যেতে বাধ্য হন৷


শাহীন বলেন, ‘নিয়োগকর্তাদেরকে অভিযোগ করলে তারা বলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিব৷ আমরা যেই কাজ দেব সেই কাজই করতে হবে৷’


মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এ নিয়ে কথা বললে কোম্পানি বলে তোমরা থাকলে থাকো না হলে চলে যাও৷ ...টিআরসি কার্ড নিয়ে গেছে ওরা৷ এনওসি দিচ্ছে না৷ এনওসি দিলে আমি অন্য কোম্পানিতে যেতে পারবো৷ না হলে আমাকে অবৈধ হয়ে যেতে হবে৷’


এই অভিবাসী জানান, শুরুতে কোম্পানি তাদের পাসপোর্টও জমা নিয়ে নেয়৷ কিন্তু পরে সবাই মিলে আন্দোলনের পর পাসপোর্ট ফেরত দেয়া হয়েছে৷


ইউরোপের একটি দেশে এই অভিবাসীরা যে পরিবেশে থাকেন তা দেখে যে কেউ অবাক হতে পারেন৷ বড়জোর দুই জনের থাকার মতো একটি কক্ষে বাঙ্কার বেডে ছয় থেকে দশ জনও থাকেন সেখানে৷ ঘিঞ্জি ও স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে আছে ছারপোকার যন্ত্রণা, যার কারণে ঘুমানোই কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানান তারা৷


শধু যে বাংলাদেশিরাই আছেন সেখানে তা নন, আছেন ভারতীয় অভিবাসীরাও৷ তাদের পরিস্থিতিও একই৷ কর্মক্ষেত্রে প্রতিশ্রুত বেতন, সুযোগ-সুবিধা না পাওয়াসহ থাকার শোচনীয় পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরেন তাদের কয়েকজন৷


মোহাম্মদ শরীফ নামে এক ভারতীয় বলেন, ‘দেখুন কী পরিস্থিতিতে আছি৷ আমাদের থাকার জায়গা দেখুন, রান্নাঘরের পরিস্থিতি দেখুন৷ ইউরোপে যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা এখানে তার কিছুই নাই৷ যেই চাকরির কথা বলা হয়েছে সেটি কিংবা ভারতে আমাদের যে বেতনের কথা বলা হয়েছিল তার কোনোটিই এখানে মিলছে না৷’


রোমানিয়ায় এই পরিস্থিতিতে থাকতে হবে সে কথা ভাবেননি এই অভিবাসীদের কেউই৷ সবারই স্বপ্ন ছিল ইউরোপের দেশে কর্মক্ষেত্রে তাদের যথাযথ অধিকার থাকবে, জীবন-যাপনের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধাগুলো তারা পাবেন৷ নিয়মিত বা বৈধ প্রক্রিয়ায় কাজ নিয়ে এসেও এমন পরিস্থিতির কারণে হতাশ তাই অনেকে৷


সাইফুল বলেন, ‘আমি ওমানে ছিলাম, দুবাইতে ছিলাম৷ আমার মনে হয় আরব গালফ এ ভালো ছিলাম৷ ইউরোপে এসেছিলাম বেশি টাকার জন্য৷ প্রত্যাশা করেছিলাম ভালো পজিশন পাব, সুযোগ সুবিধা ভালো পাব৷ কিন্তু এখানে তো এসে দেখি কিছুই নাই৷’


উল্লেখ্য, রোমানিয়ায় গত কয়েক বছরে অনেক বাংলাদেশি কাজের ভিসা নিয়ে এসেছেন৷ তাদের অনেকে সীমান্ত পেরিয়ে অনিয়মিত পথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে প্রবেশের চেষ্টা করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে ধরা পড়েছেন৷ অভিবাসীদের অভিযোগ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ না পেয়ে তারা অনেকেই এই পথ বেছে নেন৷ তবে রোমানিয়ায় এসে ভালো বেতনে ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে চাকরি করছেন এমন উদাহরণও আছে৷


মোহাম্মদ মুকুল নামে একজন অভিবাসী বলেন, ‘রোমানিয়ায় ভালো কোম্পানিও আছে৷ খারাপ কোম্পানিও আছে৷ অনেক কোম্পানি আছে যাদের টিআরসি জমা দিতে হয় না৷’
 

সিলেটভিউ২৪ডটকম / নাজাত/ নোমান