ছোট বেলায় মা, বাবার মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা অনেক শুনেছি। তখন অত কিছু বুঝতাম না। গল্পের মতো মনে হলেও তখন থেকেই কিন্তু ভেতরে-ভেতরে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতি ক্ষোভ ও ঘৃণা জন্ম নেয়। আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জন্ম নেয় ভালবাসা আর শ্রদ্ধা।

মা, বাবা আর টিভিতে মুক্তিযুদ্ধের ছায়াছবি ও বই পড়ে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারলেও এই প্রথমবারের মত কোন মুক্তিযোদ্ধার মুখ থেকে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনলাম।


সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের বগলাখাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মনির উদ্দিন (আহদেম) পিতা মৃত বাতির আলী, মাতা মৃত রহিমা খাতুন।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মনির উদ্দিন বলেন, আমি ১৯৭১ সালে সুনামগঞ্জ বুলচাঁন পাবলিক বিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম, তখন আমার বয়স ১৬ বছর। ২৬ শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মার্চ মাসের ২৭ তারিখ ২০-২৫ জন পাক সেনাবাহিনী সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউজে অবস্থান করে। এ খবর শহরে ছড়িয়ে পরলে ছাত্র নেতা রব্বানী ভাই এবং শহরের তুখুড় ছাত্র ছালিক ভাই, শাহী ভাই, মতিউর ভাই, নেক ভাই, মিনু ভাই, মুসাদ্দেক ভাই ও আ ও ম ছালেহ ভাই। হোসেন বখত, আলফাত মিয়া, নজির ভাইসহ ৩৫-৪০ জন আবদুস জহুর মিয়া এমপি সাহেবের বাসায় বৈঠকে বসি। তখন আনসার কমান্ডার আবুল হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে প্রায় ২০০ জন আনসার বাহিনীর সদস্য আমাদের সাথে বৈঠকে বসে। সেখানে আনসার বাহিনীর সদস্যরা আমাদের কাছে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ সহায়তা চান। সাথে সাথে বৈঠকের সিদ্ধান্ত মতে আমরা সবাই অস্ত্র সংগ্রহের জন্য সুনামগঞ্জ পশ্চিম বাজার খামার পট্রি হইতে বড় বড় হেমার লোহাড় হাতল নিয়ে সুনামগঞ্জ জেলা মহুকুমা অস্ত্র কারাগারের পুরাতন কোর্ট দরজা ভেঙে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ আনসার বাহিনীকে সরবরাহ করি।

তিনি বলেন, অস্ত্র ও গোলা-বারুদ পেয়ে আনসার বাহিনীর সদস্যরা সার্কিট হাউজে পাক সেনাদের সাথে যুদ্ধ শুরু করেন। আমাদের কোন প্রশিক্ষণ না থাকায় আমরা ১৫/২০ জন সরাসরি যুদ্ধ না করে আনসার বাহিনীকে সহয়তা করি। সার্কিট হাউজে পাক সেনাদেরকে আমাদের আনসার বাহিনী ৩ দিক থেকে এক সাথে আক্রমণ করেন। বিকাল ৩ টা সময় পাক বাহিনীর গুলিতে বালিকা বিদ্যালয়ের বর্তমানে সরকারি এস সি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের আবুল হোসেন ভাই মৃত্যুবরণ করেন। পরে আবুল হোসেন ভাইয়ের নিজ বাড়ী অচিন্তপুর গ্রামে তার দাফন কাফন করি। ঐ দিন রাতে এমদাদ মিয়া, আব্দুর রহিম, আলী হায়দার, আবধীন মিয়া, বুরহান মিয়া, আব্দুল জব্বার, আমির আলী এবং আমিসহ ২০-২৫ জন ভারতের বালাট চলে যাই। সেখানে ভারতীয় মেজর ডিসুজা, ক্যাপ্টেন ইয়াধবের সাথে যোগাযোগ করলে উনাদের সহায়তায় আমরা ইকোওয়ান ট্রেনিং সেন্টারে পৌঁছি। সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ২৯ দিনের গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ আব্দুস সামাদ আজাদসহ ৪ জন জাতীয় নেতা ও কর্ণেল ওসমানী আমাদের কে অস্ত্র হাতে তুলে দিয়ে শপথ করান। শপথ শেষে আমরা ৬৬ জন মুক্তিযোদ্ধা বালাট ৫ নং সেক্টরে ৪নং সাব সেক্টরে, সেক্টর কমান্ডার মীর শক্কত ও সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর মুত্তালিব সাহেবের অধীনে থেকে মঙ্গল কাটা ভৈশার পাড়া বাংকারে আমার ১৫ জনের একটি দল চলে আসি।

তিনি বলেন, মঙ্গল কাটা ভৈশার পাড়া প্রায় ২ মাস অবস্থান করি। এ সময় মঙ্গল কাটা ভৈশারপাড়া, সাহেব নগর, জাহাঙ্গীর নগর, আমপাড়া, কৃষ্ট পুর, বাগমারা, নলুয়া, বিরামপুর, সৈইফের গাঁও, বানগাঁও, আলী নগর, চালবন, ডলুরা, ফেনিবিলসহ আরও কিছু গ্রামে যুদ্ধ করি। কৃষ্ট পুর যুদ্ধ করার সময় রহিম বস্ক হাওয়ালদার পাকিস্তানী হানাদের অস্ত্রের আঘাতে মারা যান। বাগমারা যুদ্ধ করার সময় মদন হাওয়ালদার মারা যান। ফেনিবিলে আমির গুরিবৃদ্ধ হন। এরা ৩ জন আমার সহ যোদ্ধা ছিলেন। ফেনিবিলে যোদ্ধ করার সময় তালেব ভাই, অতীথ নায়েক অনিল বাবু ও মুজিবুর রহমান কে পাক হানাদার বাহিনী সুনামগঞ্জ ধরে নিয়ে আসে। প্রায় ১ মাস পর আবার আমাদেরকে বালাট গিয়াস উদ্দিন সুবাদার ক্যাম্পে ফেরত নেয়া হয়। ঐ সময় আমাদের সি কোম্পানি কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন ভোলাগঞ্জের এনামুল হক চৌধুরী। সেখানে ১ সপ্তাহ অবস্থান করার পর আমাকে প্রায় ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা গাইটার মর্তুজা আলীর সহায়তায় বর্তমান শান্তিগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের সত্তার মিয়া দালালের বাড়ীতে আক্রমণ করার জন্য পাঠানো হয়। এ সময় তাকে বাড়ীতে না পেয়ে কাছাকাছি আছানমারা ফেরী বিধ্বস্ত করে বালাট ৫ নং সেক্টরের ৪ নং সাব সেক্টরে ফিরে যাই। প্রায় ১ সপ্তাহ অবস্থান করার পর আবার বনগাঁও, সৈইফেরগাঁও, আশাউড়া, নইগাং ডিফেন্সে চলে আসি। এখানে প্রায় ২/৩ মাস অবস্থান করি। ডিফেন্সে অবস্থান কালীন সময় উল্লেখিত গ্রামসহ বিরামপুরেও যুদ্ধ করি। এ সময় ধনু মিয়া নামে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানীদের আক্রমণে মারা যান।

বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর সুনামগঞ্জের ইব্রাহিম পুর বিদ্যালয়ে চলে আসি। ইব্রাহিমপুরে ১ মাস অবস্থান করার পর মেজর মুক্তালিবের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে কর্ণেল ওসমানী ও সি আর দত্তের স্বাক্ষরিত সনদ নিয়ে বাড়ীতে ফিরে আসি।


সিলেটভিউ২৪ডটকম/এইচপি/এসডি-১