বিদ্যা অমূল্য ধন। এই সম্পদ কেউ কেরে নিতে পারে না, দান করলেও বিন্দু মাত্র কমে না। আর জ্ঞান-চক্ষু যার উন্মিলিত হয়নি, সেও এক ভিন্ন ধরনের দৃষ্টিহিন।

কবির ভাষায়-
এই ধন কেহ নাহি নিতে পারে কেড়ে, যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে।
জ্ঞানের প্রদীপ মনে নাহি জ্বলে যার, কখনো ঘুচে না তার ভ্রম-অন্ধকার।


বছর জুড়ে বিভিন্ন দিন-ক্ষণে এই মর্ত্যভুমিতে পিতৃ-মাতৃ-অবতার রূপে তাদের ভক্তকূলের মাঝে আশীর্বাদ নিয়ে আবির্ভুত হন দেব-দেবী। বিদ্যাদেবীও প্রতিবছর একবার সকল সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ আরও কয়েকটি ধর্মীয় সম্প্রদাযের ভক্তকূলের মাঝে আবির্ভূত হন। কালের পরিক্রমায় বছর ঘুরে আবারও ফিরে এলো একটি মাঘ মাস, আরো একটি শ্রীপঞ্চমী তিথি। ঘরে-ঘরে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে গেছে তাঁর আগমনি বার্তা। পূজারি হৃদয় উদ্বেলিত ও আকুল হচ্ছে বিদ্যাদেবীর আশীর্বাদ লাভের প্রত্যাশায়।

সরস্বতী পূজা মুলত বাঙালি তথা আপামর ভারত উপমহাদেশের সকল পর্যায়ের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি প্রাণের উৎসব। বিদ্যাদেবীর আবির্ভাব ও আরাধনা সকল বাঙালির মনে যে পূর্ণতার বিকাশ ঘটায়, তা জাতিকে জ্ঞান ও সংস্কিৃতি চর্চার উৎসাহ প্রদান করে। ঋক বেদ অনুযায়ী বিদ্যাদেবী বিবেচিত হন ‘The best of Mothers, best of Rivers and best Goddesses’ হিসেবে। তিনি শ্রেষ্ঠ জননী, শ্রেষ্ঠ নদী ও শ্রেষ্ঠ দেবী। তিনি বিদ্যা, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার দেবী। বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারনে সরস্বতী বাগদেবী, বিরজা, সারদা, ব্রাহ্মী, শতরূপা, মহাশ্বেতা প্রভৃতি নামে পরিচিত হন। আবার বিদ্যা দেবীকে বলা হয়  ‘The Goddess of Fame and Fortune’। অর্থাৎ খ্যাতি ও সৌভাগ্যের দেবী। কারন বিদ্যা ও জ্ঞানার্জনই হলো সকল প্রকার শ্রী ও সমৃদ্ধি অর্জনের প্রথম সোপান।

পৌরাণিক তত্ত্ব¡বিদ শিবশংকর ভারতী’র মতে সরস্বতী হলেন শুচীতার প্রতীক। জ্ঞান হলো নিরাকার এবং জ্যোতির্ময়। আবার জ্ঞানই হলো পরম ব্রহ্ম, তাই সবকিছুই রঙবিহীন সাদা। তাঁর প্রচলিত বাহন ময়ূর এবং হাঁস। ময়ূর হলো সৌন্দর্যের প্রতীক।  হাঁস হলো সেই পরমহংস যে দুধ এবং জল মিশিয়ে দিলে তার মধ্য থেকে শুধুমাত্র দুধটুকু আলাদা করে পান করতে পারে, অর্থাৎ জ্ঞান থেকে সার তত্ত্বটুকু আয়ত্ত করতে পারে। বিদ্যাদেবীর চার হস্তে ধারণকৃত প্রতিটি বস্তুর প্রতিকী তাৎপর্য রয়েছে। দেবী এক হস্তে ধারণ করেন পুস্তক বা বই। পুস্তক একটি সার্বজনীন, ঐশ^রিক ও প্রকৃতজ্ঞানে বিদ্যার্জনের প্রতীক। তাঁর এক হস্তে ধারণকৃত মালা ধ্যান ও আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক। এক হস্তে জলপূর্ণ ঘট নির্দেশ করে পবিত্রতা, স্বচ্ছতা ও শুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে। সরস্বতীর আরেক হস্তে ধারণ করেছেন বীণা। যার কারনে তাঁর আরেক নাম বীণাপাণি। বীণা নির্দেশ করে সৃজণশীল শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও সংকীর্ণতা বিরোধী সাম্যের প্রতীক। পূজার জন্য দেবী সরস্বতীর মুর্তি শে^তবস্ত্র পরিহিত থাকেন যা পবিত্রতার নিদর্শন। বিশ^ভূবন প্রকাশ সরস্বতীর জ্যোতিতে। হৃদয়ে সে আলোকবর্তিকা যখন প্রজ্জলিত হয়, তখন জমাট বাধা অজ্ঞনতার অন্ধকার দূর হয়। এই জ্যোতিজ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান, এই জ্যোতিই সরস্বতী।

আঞ্চলিক ও জাতীয় রূপ ছাড়াও সরস্বতী পূজার একটি আন্তর্জাতিক ব্যপ্তি রয়েছে। বাংলা ছাড়াও সারা ভারতবর্ষেই সরস্বতী পূজার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সরস্বতী পূজা দেশে ও বিদেশে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের বাইরে শিখ এবং আরও কয়েকটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকেরাও বসন্ত পঞ্চমী পালন করে। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যও বিদ্যাদেবীর পূজার প্রচলন রয়েছে। ভারতবর্ষ ছাড়াও  জাপান, কাম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার, তিব্বত ইত্যাদি দেশে বিদ্যাদেবীর আরাধনা করা হয়। তাছাড়াও বাণী অর্চণা শুধুমাত্র উৎসব আয়োজনের মধ্যই সীমাবদ্ধ নয়। দিনটির মর্ম উপলব্ধি করে কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্টানের প্রতিষ্ঠাও হয়েছে এই দিনে। খ্যাতির শির্ষে অবস্থানকারী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘বেনারস হিন্দু বিশ^বিদ্যালয়’ যার যাত্রা শুরু হয় এই দিনে। বরেণ্য শিক্ষাবিদ পন্ডিত মদন মোহন মালবিয়া ১৯১৬ সালের শ্রীপঞ্চমীর দিনেই প্রতিষ্ঠা করেন এই বিশ^বিদ্যালয়।

মাঘ মাসের উজ্জল শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী তিথিতে পালিত হয় সরস্বতী পূজা। এই তিথি নব-বসন্তের আগমনি বার্তা বয়ে আনে বিধায় এর আরেক নাম বসন্তপঞ্চমী। পৌরাণিক মতবাদ অনুযায়ী ইহাই দেবীর জন্মতিথি। বসন্তপঞ্চমী শীতকালের বিদায়ধ্বনি ঘোষণা করে ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করে নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। গাছে গাছে ঝরে যাওয়া পাতার দুঃখ ভুলে দেখা দেয় নুতন কিশলয়, পাতায়-পাতায়, লাগে নুতন রং, ফুলে ফুলে ভরে যায় সমগ্র পরিবেশ। এই পূজাকে কেন্দ্র করে সকলের মনে সর্বপ্রকার ভেদাভেদ ভুলে পূর্ণতার বিকাশ ঘটে। যুগযুগ ধরে এই পূজা বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে তাদের উৎসবের তালিকাকে বিশেষভাবে অলংকৃত করেছে।

মুলত সরস্বতী পূজা একটি বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় পর্ব হলেও এর একটি বিশেষ সার্বজনীন গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষতঃ শিক্ষার্থীদের মাঝে এই গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।  তারা এই পূজায় অংশগ্রহনের দ্বারা একত্রে অংশ গ্রহনের মাধ্যমে একটি বিশেষ সামজিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জ্ঞান ও বিদ্যালাভের প্রতি আকৃষ্ঠ হয়। ভক্তকুল নিজেদের মনের অজ্ঞতা দূরীকরন এবং জ্ঞানের বিকাশের জন্য বিদ্যাদেবীর পূজা করেন। এর মধ্য দিয়ে জ্ঞান আহরনের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গভীর ভক্তিভরে দিনটি উদযাপন করে। তারা বিদ্যাদেবীর কাছে বিনীতভাবে অঞ্জলি প্রদান করে এবং এর মাধ্যমে নিজেদের পরিশুদ্ধ করে জ্ঞানার্জনের প্রতি মনোযোগী হয়। সামাজিক প্রেক্ষাপটে সরস্বতী পূজার মাধ্যমে সমাজের সকল শ্রেণির ভক্তবৃন্দ সার্বজনীন পূজা মন্ডপে পুষ্পাঞ্জলি দেয়ার জন্য একত্রিত হয়। আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ধর্ম-বর্ন নির্বিশেষে জ্ঞানের বিকাশ ও সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভুমিকা পালন করে। নিজেদের মধ্য কুশল বিনিময়ের মাধ্যমে ব্যক্তি ও সামাজিক পর্যায়ে সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি করে। এবারের বাণীঅর্চনা দেশ সমাজের অশান্ত মনে ও মননে বয়ে নিয়ে আসুক শান্তির বার্তা, উদ্বুদ্ধ করুক শান্তিপূর্ণ ও সুখী-সমৃদ্ধিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠায়।

লেখক: অধ্যাপক, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।