একজন সুশিক্ষিত ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষেই বুঝবেন এবং স্বীকার করবেন- বিশ্বাসের সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী, এটি যে কোন প্রেক্ষিতেই হউক না কেন। ইহুদি ধর্মগ্রন্থ, রাব্বানিক সাহিত্য, খৃষ্টানদের বাইবেল, ইংরেজি সাহিত্য এবং সব শেষে মুসলিমদের আল-ক্বোরআন, ও নবিজী (সাঃ) এর আল-হাদিস, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও বাদশাহ নমরূদের ইতিহাস বিভিন্ন আঙ্গিকে আলোচনা ও বর্ণনা করেছে। এতগুলো রেফারেন্সের পর স্বীকার করে নিতেই হবে, আঙ্গিক যতই ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকুক না কেন, এ দুই মহা ব্যক্তির ইতিহাস ১০০% সত্য, আঙ্গিকের বিভিন্নতায় ইতিহাসের কিছুই যায় আসে না।


আজ থেকে প্রায় ৪০০০ হাজার বছর পূর্বে জন্ম হয়েছিল এই দুই ব্যক্তির। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর জন্ম হয়েছিল ব্যবিলনে (বর্তমান ইরাকের অনর্ভুক্ত একটি এলাকা); আর, নমরূদ জন্মেছিলেন মিশরে।


ইব্রাহীম (আ.) শৈশবকাল থেকেই করুনাময় আল্লাহর অনুগত ও রহমত-প্রাপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ-প্রদত্ত আসমানি ও ঐশী-জ্ঞানের পরশে ছোটবেলা থেকেই তিনি তাঁর পিতা আযর-এর, কাট এবং পাথরের সুন্দর সুন্দর ভাষ্কর্য্য বানানো ও ওগুলো বাজারে নিয়ে বিক্রি করার বা ওগুলোর আরাধণা করার কোন যুক্তিই খোঁজে পান নি, খোঁজে পান নি নিজের হাতে বানানো ভাষ্করগুলো কী ভাবে আবার মানুষেরই উপাষ্য হতে পারে। যৌবনে পৌঁছার সাথে সাথে পিতাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে কোন সন্তুজনক উত্তর না পেয়ে তিনি ঐ স্থান ত্যাগ করেন এই বলে যে, “আপনি এবং আপনার সম্প্রদায় স্পষ্ট ভ্রমের মধ্যে রহিয়াছেন”।

এর পর থেকেই ইবাহীম (আঃ) সমূহ লোকজনকে এক আল্লাহর উপর ঈমান আনতে, অর্থাৎ আল্লাহর একত্ববাদের উপর বিশ্বাস করতে দাওয়াত দিতে থাকেন, এবং এ-ও জানিয়ে দিতে লাগলেন যে, তিনি স্বয়ং আল্লাহ প্রেরিত রাসূল, এবং কোন বিনিময় ব্যতিরেকে মানুষকে একমাত্র আল্লাহর সরল ও সঠিক পথে চলার জন্য ডাকাই তাঁর কাজ।

মানুষকে বুঝানোর সম্ভাব্য কোন পন্থাই তিনি বাকি রাখেন নি। কিন্তু তাঁর ক্বওমের লোকজন তাঁর মায়াময় ডাকে সাড়া তো দিলই না, বরং তাঁকে ত্যাগ করল ও তাঁর উপর জুলুম-অত্যাচার করার সমূহ পন্থা অবলম্বন করল। তবে, মাত্র একজন মহিলা এবং একজন পুরুষ তাঁর সাথে আল্লাহর উপর ঈমান আনলেন এবং তাঁকে নবী হিসেবে বিশ্বাস করলেন, যাঁদের একজন ছিলেন মহিলা, সারাহ- যিনি পরবর্তীতে তাঁর স্ত্রী হয়েছিলেন, এবং অপরজন ছিলেন পুরুষ, লূত- যিনি তাঁর পরবর্তীতে নবী হয়েছিলেন।

ইব্রাহীম (আঃ) যখন হতাশ ও নিশ্চিৎ হয়ে গেলেন যে ক্বওমের আর কেউই, আল্লাহর উপর ঈমান আনবে না ও তিনি নবী হিসেবে তাঁর উপর বিশ্বাস করবে না, অধিকন্তু তাঁর উপর নির্যাতন করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তখন তিনি হিযরত করার করার সিদ্ধান্ত নিলেন এই উদ্দেশ্যে যে, তিনি অন্যত্র চলে গেলে ঐ সমস্থ জাতির লোকজন হয়তো বা নিশ্চিৎ তাঁর ডাকে সাড়া দেবেন। কিন্তু হিযরতের পূর্বেও তিনি তাঁর পিতাকে শেষবারের মত আবার দাওয়াত দিয়ে নিশ্চিৎ হয়ে গেলেন যে, সত্যিই তাঁর পিতা আল্লাহ তা’লার একজন শত্রু, তখন তিনি পিতার সাথে সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন করে হিযরতের সিদ্ধান্তেই অটল থাকলেন। আল-ক্বোরআনে এর বিশদ বর্ণনা এসেছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, এর পূর্ব-ইতিহাসে হযরত নূহ (আঃ) ছিলেন আল্লাহর প্রেরিত একজন নবী, কিন্তু তাঁর পুত্র ছিল একজন অবিশ্বাসী; আর, ইব্রাহীম (আঃ) এর বেলায় দেখা যায়, পুত্র আল্লাহর একজন নবী, অথচ তাঁর পিতা একজন অবিশ্বাসী। তাই, বিজ্ঞ-জনেরা সিদ্ধান্ত দিয়েছেনঃ রক্তের বন্ধনের চাইতে বিশ্বাসের সম্পর্ক অনেক বেশি শক্তিশালী।

আর, এ জন্য আল্লাহর হুকুমেই ইব্রাহীম (আঃ) ত্যাগ করলেন তাঁর পিতাকে, তাঁর সম্প্রদায়কে, ত্যাগ করলেন নিজ জন্মভূমি ও স্বদেশকে – যা আমরা দেখেছি অন্যান্য অনেক নবী-রাসূলদের ক্ষেত্রেও। আর সব শেষে দেখেছি, বিশ্ব-মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর বেলায়ও। তাই, মহা-বিজ্ঞান-গ্রন্থ চির-আধুনিক আল-ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে, আল্লাহ বলছেন, “হায় আফসোস্ আমার বান্দাদের জন্য! আমি এমন কোন নবী-রাসূল আমারই জমিনে প্রেরণ করি নাই, যাঁদেরকে নিয়ে তারা উপহাস করে নাই, বিদ্রোপ করে নাই, বা নিপিড়ন-নির্যাতন করে নাই”।

হযরত লূত (আঃ) ও স্ত্রী সারাহ-সহ ইব্রাহীম (আঃ) হিযরতে রওয়ানা দিয়ে ঊর্ শহরে গিয়ে পৌঁছলেন, সেখান থেকে ‘হারান’ নামক একটি জায়গায় এবং পরবর্তীতে পেলেষ্টাইনে।

কলামে পাকে আল্লাহ বলেনঃ “লূত আমার ইব্রাহীমের রিসালতে এবং আমার একত্ববাদে ঈমান এনেছিল। ইব্রাহীম বললো=‘আমি হিযরত করছি আমার মহান প্রভূর নির্দেশে, অবশ্যই আমার আল্লাহ সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞানী”।

অতঃপর পেলেষ্টাইন থেকে ইব্রাহীম (আঃ) চলে গেলেন মিশরে। এই ভ্রমনকালেও তিনি আল্লাহ-প্রদত্ত সরল ও সঠিক পথ গ্রহন করতে এবং আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করে এক আল্লাহর উপাসনা করতে লোকজনকে আহ্বান জানান। ভ্রমন-পথে তিনি এক-সময় এক স্বৈরাচারির (ব্যবিলনের রাজা) খপ্পরে পড়ে যান। ঐ স্বৈরাচারি রাজা চক্রান্ত করে মোহনীয় সারাহকে ইব্রাহীম (আঃ) এর নিকট থেকে আলাদা করে একা পাওয়ার সুযোগ করে নেয় এবং তাঁর ক্ষতি বা সর্বনাশ করতে প্রানপণ চেষ্টা চালায়। কিন্তু পর পর তিনবার সে সারাহ-র দিকে হাত বাড়াতে চেষ্ঠা করলেও মহান আল্লাহর কুদরতে প্রতিবারই তার হাত অবশ কিম্বা রডের মত শক্ত হয়ে যায়। তবে, অসৎ উদ্দেশ্য সাধনে বিফল মনোরত হয়ে সে সারাহকে অতি-মানবী মনে করে ভয় পেয়ে যায় এবং অনুশোচনা হিসেবে তাঁকে হাজারাহ নামের এক বালিকা-দাসীকে উপহার হিসেবে প্রদান করে।

সারাহ্ ইব্রাহীম (আঃ) এর কাছে ফিরে এসে ঐ পাষণ্ড-পাপিষ্টের ব্যাপারে সবকিছু খুলে বলেন। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, ঐ হাজারাহ বা হাজেরাহ আমাদের আম্মাজান হাজেরাহ ভিন্ন অন্য কেউ নন। পবিত্র হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা বলেনঃ “ও বানী মা-ইস- সামাৃ‘হে আরব-বাসিগণ! তোমরা তো হাজেরার পুত্র ইসমাইলেরই বংশধরগণ, যে হাজেরাহ ইসমাইলের আম্মাজান’।” (বুখারিঃ ৩৩৫৮)। অতএব, এই হাজেরাহ আমাদেরও আম্মাজান।

সারাহ্ জানতেন, বহুদিন থেকে তাঁর প্রিয় স্বামী ইব্রাহীম (আঃ) একজন সন্তানের আকাঙ্খায় ছিলেন; অথচ, নারী হিসেবে তিনি তো তাঁর এ বৃদ্ধাবস্থায় স্বামীর আকাঙ্খা পূরন করতে পারছেন না। অন্যদিকে, স্বামীর দোয়া ছিলঃ “হে আমার প্রভূ! আমাকে এমন একজন সন্তান দান করুন, যে হবে পূণ্যবান, সৎ এবং ধৈর্য্যশীল”। তাই সারাহ নিজ থেকে প্রিয় স্বামীকে প্রস্তাব দিলেন, তিনি যেন হাজেরাকে শাদী করে নেন, হয় তো আল্লাহর কৃপায় হাজেরার মাধ্যমে উভয়ের আশা পূর্ণ হতে পারে। ইব্রাহীম (আঃ) প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। আর, হাজেরার মাধ্যমে তাঁরা সকলে আল্লাহ রহমতে একজন পুত্র-সন্তান দ্বরা আশির্বাদ-পুষ্ট হলেন। তাঁরা এ সন্তনের নাম রাখলেন ইসমাঈল। প্রথম পুত্র-সন্তান পেয়ে সকলের আনন্দের সীমা রইল না। তাঁরা অনুষ্ঠান করে আল্লাহর শুক্রিয়া আদায় করলেন। কোন কোন জ্ঞানীর মতে, এ সময় ইব্রাহীম (আঃ) এর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।

ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর গোটা পার্থীব জীবন আল্লাহর হুকুম মত এবাদত করে, আল্লাহর গৌরব-গাঁথা বর্ণনা করে এবং মনুষকে আল্লাহর পথে ডেকে ডেকেই কাটিয়েছেন। মৃত্যূ-পরবর্তী অবাদ সুখ, শান্তি, পুরষ্কার ও পুনরুজ্জীবনের ব্যাপারে এক সময় ইব্রাহীম (আঃ) খুব কৌতুহলি হয়ে উঠলেন এবং দয়াময় আল্লাহর পক্ষ থেকে এ সবের কিছু নিদর্শন চাইলেন। আল্লাহ পাক রাজি ও খুশি হয়ে তাঁর প্রেরিত এ রাসূলকে এ সবের কিছু বিস্তারিত নিদর্শন দেখালেন মহা-কিতাব আল-ক্বোরআনের একটি মহাকাব্যিক আয়াতের মাধ্যমে (সূরাহ্ আল-বাক্বারাহ, আয়াতঃ ২৬০ দেখুন)।

ইব্রাহীম (আঃ) এত বড় নবী ছিলেন যে, আল-ক্বোরআন আমাদের সর্বশেষ নবীজি মোহাম্মাদ (সাঃ)কে নির্দেশ দিয়েছে ইব্রাহীম (আঃ)কে দ্বীনের রোল-মডেল হিসেবে দেখতেঃ “ইব্রাহীম হানিফার ফিতরত (ধর্ম)কে অনুসরন করুন (যেটা ইসলামিক একত্ববাদ), একমাত্র আল্লাহর উপাসনা করুন বাধ্যতামূলকভাবে (অন্য সবকিছুকে দূরে ছুঁড়ে মেরে), (সূরাহ্ আন-নাহল, আয়াতঃ ১২৩)।

ইমাম ইবনে কাথিরের বর্ণনা অনুযায়ী, ইব্রাহীম (আঃ)কে দাফন-কাপন-কবর দেয়া হয় পেলেষ্টাইনের হিবরন (আল-খালীল) নামক একটি গ্রামে। ওখানেই শায়িত আছেন তাঁর পুত্র ইসহাক (আঃ), তাঁর নাতি ইয়া’কূব (আঃ) এবং তাঁর খন্তি (গ্রেট-গ্রেণ্ডসন) ইউসুফ (আঃ)। এ নবী (আঃ) গণের কবরসমূহ অবস্থিত আছে মাসজিদ-ই-খালীল এর নিচে। এ মাসজিদটিকে মাসজিদ-ই-ইব্রাহীমও বলা হয়।

আমার এ নিবন্ধে আমরা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর কঠিন জীবনের অতি অল্প একটি ধারণা পাই মাত্র। তাঁর মৌলিক শিক্ষাগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ

১/ আমাদের আজীবনে দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে একমাত্র মহিমাময় আল্লাহর উপর।
২/ মাতাপিতাকে আজীবন ভালবাসাময় সম্মান দেখাতে হবে অন্তর থেকে, কোন প্রেক্ষিতেই তাঁদের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানো যাবে না।

৩/ জীবনে প্রত্যেক অবস্থায় ধৈর্য্যশীল হতে হবে, একমাত্র আল্লাহর মনসার উপর দৃঢ় আস্থা ও ভরসা রেখে।
৪/ সবচেয়ে প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করতে হবে।

এ নিবন্ধের শেষ কথাঃ প্রতিটি মুসলমানের অন্তরে ইব্রাহীম (আঃ) এর প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও সম্মান ধারণ করতে হবে, কারণঃ আল্লাহ তা’লার পয়গাম্বর হিসেবে বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) এর পরেই তাঁর সুউচ্চ স্থান ও মর্যাদা। আমরা মুসলমানরা যখনই সালাত, অর্থাৎ নামায আদায় করি, তখন প্রত্যেকবারই মোহাম্মাদুররাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নামের সাথে ইব্রাহীম (আঃ) এর নাম উচ্চারন করি। অধিকন্তু, মোহাম্মাদ (সাঃ) এর প্রতি আমরা যে সমস্থ দুরুদ শরীফ পাঠাই, তার মধ্যে সর্বোচ্চ দুরুদ হচ্ছে “দুরুদ-ই- ইব্রাহীম”। এখানেই প্রমানিত হয়, ইব্রাহীম (আঃ)কে আল্লাহ পাক কত সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন করেছেন। সুবহানাল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে আরো বেশি বেশি নেক আ’মল করার তৌফীক্ব দান করুন, আ-মীন।

লেখক : ইংরেজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও ২৪ বছরের বিভাগীয় প্রধান, শাবিপ্রবি