আজকের আলোচ্যমূল ইতিহাসের একজন মহান ব্যক্তিকে নিয়ে। তিনি হলেন ২য় নেযার।

মূলতঃ তিনি ছিলেন প্রাচীন ব্যবিলনের একজন রাজা। প্রাচীন ‘সুমার’ এবং ‘আক্কদ’ রাজ্যগুলোও তারই শাসনাধীনেই ছিল। প্রভাব-প্রতিপত্তি-শক্তি-বীরত্ব-আবেগ-আহ্লাদের কারণে উপাধী পেয়ে গেলেন বা নাম লেগে গেল তার ‘গোটা মহাবিশ্বের রাজা’??? প্রকৃত নাম ছিল তার – নেবুচাদনেযার। তার পূর্বে নিশ্চয়ই নেযার নামে আরো কোন এক রাজা গত হয়েছিলেন। তাই, তার আমলে রাজা হিসেবে তিনি চিহ্নিত বা পরিচিত হলেন দ্বিতীয় নেযার নামে।


ছোট্টবেলা থেকেই আমি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও সমাবেশে শুনে আসছিলাম, নেযার (অপর পরিচয় ‘বখতে নেযার’) গোটা বিশ্বের রাজা বা বাদশাহ ছিলেন। তাই, কলেজে অধ্যয়ণকালেই স্বাভাবিকভাবে নিজের মনে প্রশ্ন জাগল, খৃষ্ট-পূর্ব ৭০০ শতাব্দীর ঐ অনুন্ন্ত প্যাগান প্রাগৈতিহাসিক-কালে, একজনমাত্র ব্যক্তি সারা বিশ্বের রাজা হয়ে গিয়েছিল কি করে? আর, এ স্বীয় প্রশ্ন থেকেই আজকের এ গবেষণার অবতারনা; কারণ, দেশে-বিদেশে ৪৫ বছরের অধ্যাপনা ও প্রশাসনিক কাজের চাপের মধ্যে নিজের ইংরেজি বিষয় ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে অধ্যয়ন বা গবেষণা করার তেমন কোন সুযোগ করে উঠতে পারি নি।
সুপ্রিয় পাঠক/পাঠিকাবৃন্দ, নিচে, আজ থেকে প্রায় ৪০০০ (চার হাজার) বছর পূর্বের, বাদশাহ নমরূদ-নির্মিত ও কথিত বাবিল টাওয়ারেরই একাংশ প্রদশিত হয়েছে।

প্রদর্শিত আকাশ-চুম্বি বাবিল টাওয়ারের চুড়ায় উঠিয়া নমরূদ আল্লাহকে হত্যা করিবার জন্য অজস্র তীর ছুঁড়েছিল। তার আজীবন, স্রষ্টা-বিরুধীতার একাধিক প্রচেষ্টার কারণে ইহুদি, খৃষ্টীয় এবং ইসলাম ধর্মে, রব্বানিক সাহিত্যে, প্রাচীন তাইবেরিয়ান, হাঙ্গেরিয়ান, এবং আমেরিকান লীজ্যান্ডেও, তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘ইবলিছ-শয়তান‘ (ইংরেজিতে, ‘কার্স্ড স্যাটান’) এবং ‘দৈত্ত-নমরূদ’ ইত্যাদি হিসেবে, যদিও বা যেহেতু, সে নিজেকে মহাবিশ্বের অধীশ্বর মনে করত।

ঐতিহাসিকভাবে ২য় নেযার ‘মহামতি নেযার’ হিসেবে আখ্যায়িত। এবং, এটা স্বীকার্য যে, সমসাময়িক কালের অন্য সকল রাজাদের চাইতে সে তার সাম্রাজ্যের অনেক বেশি পরাক্রমশালী রাজা ছিল। তার পিতার মৃত্যুর পর সে ৬৬২ খৃষ্ট-পূর্ব হইতে ৬০৫ খৃষ্ট-পূর্ব পরযন্ত এক নাগাড়ে ৫৭ বছর রাজত্ব করিয়াছিল।

নেযার এতই বিখ্যাত ছিল মূলতঃ কয়েকটি কারণেঃ ১/ তার সামরিক শতক্তির মোকাবেলা করা সমসাময়িক অন্য কোন রাজ্যের বাদশাহের পক্ষে ছিল অসম্ভব। ২/ তার রাজধানী ব্যবিলনে তার গৃহিত যে ভৌত ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন-প্রজেক্ট হাতে নিয়ে বাস্তবায়নও করেছিল, তা অন্য রাজাদের কাছে ছিল ঈর্ষনীয়। ৩/ ঈহুদি লীজ্যান্ড অনুযায়ী, সে ছিল চালডিয়ান বংশের দীর্ঘতম কালের রাজা। ৪/ মৃত্যু পরযন্ত সে ছিল তৎকালীন পৃথিবীর অন্যান্য রাজাদের তুলনায় সব চেয়ে অধিক ক্ষমতধর। ৫/ তার পিতার রাজত্বকালেই আসিরিয়ান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মিডো-ব্যবিলনিয়ান যুদ্ধে সে তার বীরত্বের নজীরবিহীন সফলতার পরিচয় দিয়েছিল। ৬/ খৃষ্ট-পূর্ব ৬০৫ সালর কারচেমিশ যুদ্ধে ফেরাউন ২য় নিকোর মিশরীয় বাহিনীকে সে ধংসন্তুপে পরিনত করতে সক্ষম হয়েছিল। ৭/ অধিকন্তু সে, এ-ও অনেকটা নিশ্চিৎ করে দিয়েছিল যে, অতি শীঘ্রই নিও-আসিরিয়ান সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে প্রাচীন ও সংলগ্ন পুরো নিকট-মধ্য-প্রাচ্যই তার নিও-ব্যবিলনীয়ান সাম্রাজ্যের অধীনে আসবে। ৮/ তার সফল বিভিন্ন সামরিক অভিযানসমূহই তাকে খ্যাতিমান করেছিল। ৯/ পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহন করে প্রকৃত অর্থেই তিনি তার অঞ্চলে মিশরীয় ক্ষমতা হ্রাস করেন। ১০/ তিনি প্রাচীন জুডাহ রাজ্য এবং তার রাজধানী জেরুযালেম ধ্বংস করে দেন।

আশ-পাশ রাজ্যের জনগণ এমনভাবে বসবাস করছিল, যেন তারা ব্যবিলনিয়ানদের নিকট বন্দী। তৎকালীন ঈহুদিগণ নেযারকে উপাধি দিয়েছিল “জাতিসমূহের ধ্বংসকারি” হিসেবে। বাইবেল তাকে চিহ্নিত করেছে একজন “নিষ্টুর শত্রু ও শাস্থিদাতা “ হিসেবে ।

প্রাচীন ‘তাইরে’ অঞ্চলের বিদ্রোহী ফিনিশিয়ানদের বন্দী করে এবং লিভ্যান্ট অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে তিনি তার নিও-ব্যবিলনিয়ান সাম্রাজ্যকে নিকট-প্রাচ্যের একটি পরাশক্তিতে পরিণত করেছিলেন।

এত অধিক ধ্বংসলীলা চালানো সত্বেও নেযারকে এক মহা ‘নির্মান-রাজা’ আখ্যা দেয়া হয়েছে। তার বিভিন্ন সামরিক অভিযান তাকে তার ব্যবিলনে এবং মেসোপটোমিয়ায় বড় বড় নির্মান-কাজের ডজন ডজন প্রজেক্ট বাস্তবায়নে সাহায্য করেছে। আজ অবধি ব্যবিলনের যে উন্নয়ন-চিত্র পরিদৃষ্ট হয়, তা নেবুচাদনেযারের উন্নয়ন-কর্মকান্ডেরই স্বাক্ষ্য বহন করে। প্রাচীন ব্যবিলনের শুন্যোদ্যান আজও পৃথিবীর সাত আশ্চর্যের একটি হিসেবে নেযারের অবদানের স্বাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেঃ

ব্যবিলনের শুন্যোদ্যান (দ্য হ্যাঙ্গিং গার্ডেন অব ব্যবিলন) নেযার ‘ইসাগীলা‘ এবং ‘ইটেমেনানকী’ সহ অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নেও বড় রকমের অবদান রেখেছেন। তিনি তখনকার তার রাজপ্রাসাদ নতুন করে ঢেলে সাজিয়েছেন, আবার সম্পূর্ণ নতুন ব্র্যান্ডের আর একটি রাজপ্রাসাদও নির্মান করেছেন। শুধু তা-ই নয়, নব-রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে একটি ‘সিরিমোনিয়্যাল সেন্টারে’ও নানা কারুকাজ দিয়ে তাতে নতুনত্ব এনেছেন, নির্মান করেছেন রাজধানীতে প্রবেশের ‘ইশতার গেইট’, এবং পেশাগত অনেক রাজপথ।

প্রসঙ্গক্রমে এখানে আমাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলে রাখিঃ আমাদের দেশে কোন রাজা নেই, আমরা কারো প্রজাও নই, আমরা স্বাধীন-স্বারবভৌম একটি দেশের নাগরিক। আমাদের কোন রাজদরবারও নেই; আছে দু’টি ভবনঃ একটি বঙ্গভবন, অপরটি গণভবন। যেহেতু রাজা নেই, থাকবে না রাজনীতিও, যেটি একটি ঔপনিবেশিক কথা; আমাদের দেশ আছে, থাকবে দেশনীতি; আমাদের রাষ্ট্র আছে, থাকবে রাষ্ট্রনীতি; ‘রাজপথ’ কথাটাও থাকবে না, থাকবে গণপথ এবং জনপথ; জেলা ‘প্রশাসক’ শব্দটি থাকবে না, কারণ, ‘প্রশাসক’ শব্দটি ঔপনিবেশিক শব্দ; এ পদের নাম হবে ‘জেলা নির্বাহী অফিসার”; ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী’ শব্দটি হবে ‘বিদেশমন্ত্রী’; কারণ, কোন রাষ্ট্র আমাদের ‘পর’ নয়; আমাদের কাছে আছে ‘বিদেশ’; আমাদের মানুষ ‘বিদেশ’ যায়, পররাষ্ট্রে যায় না; কোন রাষ্ট্রকে আমরা আগেভাগেই ‘পর’ বানাতে পারি না; পৃথিবীর সকল দেশই আমাদের কাছে ‘বিদেশ’, সবই আমাদের বন্ধু-রাষ্ট্র, ব্যতিক্রম ছাড়া।

আর, আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙ্গালী’ বলা যাবে না; তা হলে আমার ৩টি প্রশ্ন থাকবেঃ ১/ হাজার বছর আগে কে ছিল শ্রেষ্ট বাঙ্গালী? ২/ আর, হজার বছর পরে আবার কে হবে শ্রেষ্ট বাঙ্গালী? ৩/ চার হাজার বছর পর ‘কথাটা’ বলা হবে কী ভাবে?
বাংলাদেশের জাতির জনকের ‘বিশালত্বকে/বড়ত্বকে’ খাটো (!,?) করে তাঁকে এক হাজার বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার অধিকার কে কাকে কখন দিল? আশা করি শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞজন এ ব্যাপারে চিন্তা করবেন। বঙ্গবন্ধুর বিশালত্ব, বড়ত্ব ও শ্রেষ্টত্বকে জাতীয় এবং শর্তহীনভাবে মেনে নিয়ে বলতে হবেঃ “ইতিহাসের সর্বকালের সর্বযুগের শ্রেষ্ট বাঙ্গালী”।

আবার, আরও একটু জাতীয় কথা। আমাদের দেশে রাজনীতিবিদ থাকবেন না; থাকবেন ‘দেশনীতিবিদ’ ও ‘রাষ্ট্রনীতিবিদ’। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা পড়াই ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’। আমাদের দেশে ইংরেজি ‘পলিটিক্স’ শব্দের বাংলা অর্থ হবে ‘রাষ্ট্রনীতি’ বা ‘দেশনীতি’।
সব শেষে আবার মূল প্রবন্ধে আসা যাক। নেযারের রাজ্য-পচিলনায় মুখ্য হয়ে গিয়েছিল তার নির্মান-কাজ। এ কাজের মোকাবেলায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল তার সামরিক অভিযানসমূহ। এক সময় ঐতিহাসিকগণ তাকে অধিক মূল্যায়ন করতে থাকলেন সামরিক অভিযাত্রী হিসেবে নয়, বরং, নির্মান-শৈলীর অপরাজেয় এবং অদ্বিতীয় স্থপতি হিসেবে।

লেখক : ইংরেজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও ২৪ বছরের বিভাগীয় প্রধান, বিভাগের সাবেক জ্যেষ্ঠতম অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, ও দেশে-বিদেশে ৪৫ বছরের ইংরেজি ভাষা ও ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক।