স্বাস্থ্য যে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকতে পারে না। যে কারণে স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল, এই বাক্যটি আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে বহুদিন ধরেই। তবে স্বাস্থ্যের সাথে সুখের যোগাযোগ কতটা ঘনিষ্ঠ তা মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে গত দুই বছরে করোনা মহামারি আসার পর।

তবে করোনার আগে পরে আরও কিছু রোগ আমাদের জীবনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল যেগুলোর কথা হয়তো করোনা চলাকালীন সময়ে করোনার চাপে চিড়ে-চ্যাপ্টা ছিলাম বলে আমরা মনে রাখতে পারিনি। কিন্তু এখন করোনা যখন ম্রিয়মাণ, তখন এসব বিষয়ে আবারও জোর দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলেই মনে হয়।


বেশ ক’বছর ধরেই ডেঙ্গুতে পর্যুদস্ত হচ্ছে ঢাকা নগরবাসী। ডেঙ্গু অতিমারি পর্যায়ে না পৌঁছালেও করোনা আসার ঠিক আগের বছরে দেশ জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল ডেঙ্গু মহামারি, যা আমরা হয়তো মনের ভুলে ভুলতে বসেছি।

করোনার মাঝেও ডেঙ্গুর ধাক্কায় ধরাশায়ী হয়েছিলাম আমরা। আর এইতো সেদিন কলেরায় আক্রান্ত হাজারো মানুষের আশ্রয় হয়েছিল আইসিডিডিআরবি প্রাঙ্গণে তাঁবুর হাসপাতালে। বলা হচ্ছে, তার প্রতিষ্ঠার ষাট বছরে এত বেশি সংখ্যায় কলেরা রোগী কখনো দেখেনি আইসিডিডিআরবি। ক’বছর আগেই চিকুনগুনিয়ায় কুপোকাত হয়েছিলাম আমরা আর ইদানীং আফ্রিকার কোথাও কোথাও আবারও চোখ রাঙাচ্ছে ইবোলা।

প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ করে এমন দুর্যোগ? কীসের আলামত এসব? এক কথায় বলতে গেলে, এসবের পেছনে মানুষের অবদানই বেশি। যেভাবে আমরা আমাদের এ পৃথিবীকে শোষণ করেছি, তাতে জলবায়ুর পরিবর্তন এখন আমাদের অমোঘ নিয়তি, যার ফলশ্রুতিতে এই ধরনের রোগ বালাইয়ের প্রকোপ যে সামনে আরও বাড়বে ছাড়া কমবে না, এ নিয়ে সম্ভবত বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই।

আর সাথে আছে অপরিকল্পিত নগরায়ন আর নগরবাসীদের সুযোগ সুবিধাগুলো ঠিকঠাক মতো দেখভাল করায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কখনো অপারগতা তো কখনো উদাসীনতা। তেমনি পাশাপাশি আছে, নাগরিকের দায়িত্বজ্ঞানহীনতাও।

বছর খানেক আগে চট্টগ্রাম শহরে হেপাটাইটিস ই ভাইরাসের আউটব্রেক ইনভেস্টিগেশনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ওখানে গিয়ে আমি দেখেছি বসতবাড়ির রিজার্ভার থেকে উদ্ধার করা হয়েছে সাপ, ব্যাঙ আর এমনকি কুকুরের গলিত মরদেহও!

সামনের পৃথিবীতে আমরা রাতারাতি কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারব, অমন প্রত্যাশা আমি করি না। কারণ শতশত বছরের পুঞ্জিভূত এসব সমস্যার রাতারাতি কোনো সমাধান কখনোই সম্ভব না।

সমাধানের জায়গায় নিশ্চয়ই আমরা পৌঁছাব, তবে তার ঢের বাকি আছে বলেই সবার ধারণা। এর জন্য একদিকে যেমন প্রয়োজন বৈশ্বিক পর্যায়ে আন্তরাষ্ট্রীয় সমঝোতা, তেমনি প্রয়োজন ব্যক্তি পর্যায়ের সচেতনতার। তবে করোনা শিখিয়ে গিয়েছে এমন দুর্যোগে আপাতকালীন সমাধানটাও জরুরি।

করোনা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে মাস্ক আর ভ্যাকসিন দিয়ে। শহরজুড়ে যখন কলেরায় মাতম, তখন তা ঠেকানোর জন্য সরকার ভ্যাকসিনকেই বেছে নিয়েছেন। অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদে মুক্তির পথটা দীর্ঘসূত্রিতার হলেও, মহামারি থেকে তাৎক্ষণিক মুক্তি আসে ভ্যাকসিনেই। এর জন্য প্রয়োজন নিজস্ব ভ্যাকসিন সক্ষমতা।

যে করোনা মহামারি আমরা নিয়ন্ত্রণে আনলাম, কোটি কোটি ডোজ ভ্যাকসিন ব্যবহার করে তার জন্য রাষ্ট্রকে গুনতে হয়েছে চল্লিশ হাজার কোটি টাকা। অথচ নিজেদের ভ্যাকসিন সক্ষমতা থাকলে এরচেয়ে বহুগুণ কম খরচে এবং আরও দ্রুত আমরা করোনাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারতাম।

এ যাত্রায় আমরা পার পেয়ে গিয়েছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ম্যানেজারিয়াল দক্ষতা আর নেতৃত্বের প্রজ্ঞায়। দুনিয়ার হেন দেশ নেই যেখান থেকে তিনি ভ্যাকসিন নিয়ে আসেননি বাঙালিকে করোনার শৃঙ্খল মুক্ত করার জন্য। তার প্রজ্ঞায় বাংলাদেশের এক ঘাটে জল খেয়েছে পৃথিবীর তাবৎ ভ্যাকসিন পরাশক্তিগুলো।

ভ্যাকসিন বোঝাই উড়োজাহাজ ঢাকায় উড়ে এসেছে ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর রাশিয়া—কোথা থেকে না? মনে রাখতে হবে, আজ থেকে পঞ্চাশ বা একশ বছর পর যদি এমনি আরেকটি মহামারি আঘাত হানে আর তখনকার বাংলাদেশে যদি শেখ হাসিনার মতো প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বে না থাকে, তাহলে তো ভেস্তে যাবে আমাদের এত শত অর্জন।

তাছাড়া অত দূরেই বা যাই কেন? এই যে হালের কলেরা, একে ঠেকানোর জন্যই তো আমাদের হাতে নেই যথেষ্ট ভ্যাকসিনের মজুদ। থাকলে কলেরার টুটিটা চেপে ধরা যেত আরও জোরেশোরে। কাজেই আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি আর পেশাগত অভিজ্ঞতায় আমি যতটুকু বুঝি প্রকৃতি আমাদের ম্যাসেজ দিচ্ছে।

এখন সেই ম্যাসেজটুকু বুঝে আমরা যত তাড়াতাড়ি আমাদের প্রস্তুতি পর্বটা শেষ করতে পারবো তাতেই মঙ্গল। কারণ প্রকৃতির ধর্মই হচ্ছে ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’। আর প্রকৃতির কাছে নিজের ফিটনেসের প্রমাণ দিতে হলে চাই নিজস্ব এমআরএনএ ভ্যাকসিন (mRNA vaccine) সক্ষমতা।  

সিলেটভিউ২৪ডটকম/পিডি


সূত্র : ঢাকাপোস্ট