এ নিবন্ধটিতে আমার অলোচনা থাকবে, আল-ক্বোরআন, ইন্জিল, তৌরাত, ইংরেজিতে আরো যেগুলোকে বলে “ওল্ড টেস্টামেন্ট”, “নিউ টেস্টামেন্ট” অর্থাৎ বাইবেল, ইহুদি রাব্বানিক সাহিত্য, আমার ইংরেজি সাহিত্য এবং যতটুকু পারা যায় অন্যান্য উৎস বা সোর্স থেকে তথ্য সংগ্রহ করে হযরত আদম ও বিবি হাওয়া (আ.) -এ দু’জনের সৃষ্টি, বেহেশ্তে তাঁদের বসবাস এবং বেহেশ্ত থেকে তাঁদের বের হওয়া থেকে নিয়ে আদম-হাওয়ার ইন্তেকাল পর্যন্ত। তবে, আল-ক্বোরআনই থাকবে মুখ্য তথ্য-ভাণ্ডার, যেহেতু এ চির-আধুনিক মহাবিজ্ঞান-গ্রন্থ নাযিল হওয়ার পর পূর্বের সবকিছুই এক কথায় বলতে গেলে বাতিল বা কোন ফাইনাল সিদ্ধান্ত দেবার দাবিদার রয় নি।
আদম (আঃ)কে সৃষ্টি করার পূর্বে মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন তাঁর ফেরেশ্তাকূলের সাথে পরামর্শ করেছিলেন এ সৃষ্টির ব্যাপারে, যদিও কারো কাছ থেকে পরামর্শ নেবার কোন প্রয়োজন মহান আল্লাহর ছিল না। তাই, এ পরামর্শ নেবার রহস্যও আল্লাহ পাকই উত্তমভাবে অবগত আছেন, যদিও এ-ও তাঁর অসীম জ্ঞানের মধ্যে ছিল যে, ফেরেশ্তাকূল এ ব্যাপারে খামাখা, বা, না সৃষ্টি করার একটি অজুহাত দেখাবেন, যেহেতু জ্বীন জাতির অভিজ্ঞতা পূর্ব থেকেই ফেরেশ্তাকূলের ছিল; কিন্তু আল্লাহর অভিপ্রায়ের বিপরীতে তারা যে, কোন অযুহাত দাঁড় করাবার সাহস রাখবে, এটাও প্রকাশ্যে আনাটাই আল্লাহর মনসায় ছিল, যদিও মহান আল্লাহ শেষ পর্যন্ত তাঁর স্বীয় মনসামতই কাজ করবেন। এ অযুহাতটা প্রকাশ্যে আনাটাই নিশ্চয় ছিল আল্লাহর জ্ঞানের অসীময়তার মধ্যে লুক্কায়িত। তাই আল্লাহ তাঁদের যুক্তি খণ্ডন করে বলেছিলেন, “আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না।” আর এ পরামর্শের মধ্য দিয়ে আল্লাহ সকল আদম সন্তাকে এ শিক্ষাও দিলেন যে, দুনিয়াবী জীবনে যেকোন কাজ করতে তোমারা পরামর্শ করে করিও, সে পরামর্শ কাজে লাগুক বা না লাগুক, কারণ, এর মধ্য দিয়ে তোমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবশ্যই বরকত লাভ করবে।
আল্লাহ পাক তাঁর ক্বুদরতি হাতে আদমকে সৃষ্টি করলেন। নিজ ক্বুদরতী ‘ফুঁক’ দিয়ে আদমের ভেতরে রূহ বা প্রাণ সঞ্চার করলেন। আল্লাহই নাম রাখলেন ‘আদম’। এ নামটি রাখার পেছনেও একটি কারণ আছে; আর তা হলঃ মাটির চামড়াকে আরবীতে বলা হয় ‘আদিম’। আল-ক্বোরআন এবং হাদিস আদমের সৃষ্টি ও নাম রাখার ব্যাপারে একই সিদ্ধান্ত দিয়েছে।
অতঃপর আল্লাহ আদমকে পার্থিব যাবতীয় জ্ঞান দান করে ফেরেশ্তাদেরকে সামনে হাজির করে, তাঁদের ও আদমের পরীক্ষাও নিলেন, যে পরীক্ষায় আল্লাহর মনসায় আদমই পাস করলেন।
আদমকে সৃষ্টি করার পর মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের প্রথম যে আদেশ এসেছিল, সেটা ছিল আদমের প্রতিঃ “হে আদম! আপনি আমার ফেরেশ্তাকূলকে সালাম করুন”। আদমকে ফেরেশ্তাদের চাইতে অধিক জ্ঞানী বিানিয়েও আদমকে দিয়ে আবার প্রথমেই এটা করানোর রহস্যও আল্লাহই ভাল জানেন। তবে,মনে হয়, ফেরেশ্তাকূল বয়ঃ-জ্যেষ্ট বলে, অথবা ফেরেশ্তাদের কোন খাহেশ বা চাহিদা নেই বলে, বা তারা আমরন বেগুনাহ বলে, বা তারা সবাই একবাক্যে ‘আশরাফুল মাখলুক্বাত’ বলে; হেঁ, বাছাইকৃত মানবগণও আশরাফুল মাখলুক্বাত, তবে ঢালাওভাবে সকলে নয়, আল-ক্বোরআন এবং হাদিস কোথাও ঢালাওভাবে সকল মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলুক্বাত’ বলে নি, এ শব্দযুগলের কোন দলিলও ক্বোরআন-হাদিসের কোথাও নেই। ঢালাওভাবে সকল সাধারন মানুষই যদি আশরাফুল মাখলুক্বাত হয়ে যায়, তবে তারা আবার দোযখে জ্বলবে কেন ? মানব, জ্বীন এবং শয়তান ও তার কোটি কোটি সাঙ্গপাঙ্গই তো দোযখে জ্বলবে। তবে এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
আল্লাহর হুকুম মত ফেরেশ্তাকূলকে সম্বোধন করে আদম বললেন, “আস্সালামু আ’লাইকুম”। আল্লাহ আদমকে সাথে সাথে জানিয়ে ও শিখিয়ে দিলেন, ক্বিয়ামত পর্যন্ত এটাই হলো তোমার বংশধরদের জন্য অভ্যর্থনা করার বা সম্মান দেখানোর বা সম্বোধন করার বিধান। আদমের সালামের জবাবে ফেরেশ্তাকূল এক বাক্যে আরো বাড়িয়ে বললেন, “ওয়া আ’লাইকুমুসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ”। এ বাড়িয়ে বলাটাও আল্লাহরই মনসায়, যেমনটা করে থাকেন আজও গোটা পৃথিবীর সকল মুসলমানগণ।
অতঃপর আল্লাহ তা’লার দ্বিতীয় হুকুম আসল ফেরেশ্তাদের উপর, “তোমরা আদমকে সিজদা করো”, অর্থাৎ, সিজদার মাধ্যমে আমার ক্বুদরতি হাতে সৃষ্ট আদমকে সম্মান জানাও। ফেরেশ্তাকূল সকলে আল্লাহর হুকুম মত আদমকে সিজদা করলেন, শুধু ইবলিস ছাড়া। মহান আল্লাহ তাঁর হুকুম না মানার কারণ জিজ্ঞেস করায় ইবলিস যুক্তি খাড়া করল দু’টিঃ ১/ সে আদম থেকে উচ্চ মর্যাদার অধিকারি, যেহেতু আদমের সৃষ্টি মাটি দিয়ে, এবং মাটির থাকে পায়ের নিচে। ২/ সে আগুনের তৈরি, এবং আগুন উঠে উপরের দিকে।
আল্লাহর জ্ঞানের অসীময়তার মধ্যে পূর্ব থেকেই ছিল যে ইবলিস এ রকমই করবে। কিন্তু, প্রকাশ্য পরীক্ষা ব্যতিরেকে ইবলিসকে “বিতাড়িত শয়তান” ঘোষণা করা এবং বেহেশ্ত থেকে বিতাড়ন করা আল্লাহর মনসায় ছিল না। তাই, জ্ঞাত থাকা সত্বেও আল্লাহ প্রকাশ্য পরীক্ষা নিয়েই ইবলিসকে বেহেশ্ত থেকে বিতাড়িত করলেন। মহা আহ্মক ও মাথা-মোটা ইবলিস এখানে চার’টি বিষয় বুঝতে ভুল করেছেঃ ১/ আগুন জ্বালায় এবং ধ্বংস করে, অপরদিকে, ২/ মাটি ফুটায়, জন্ম দেয়, তাজা রাখে এবং লালন করে। অর্থাৎ, শয়তানের বৈশিষ্ট নষ্ট করা এবং ধ্বস করা, আর, মাটির গুণ তৈরি করা, জন্মানো এবং লালন-পালন করা। ৩/ এখানেই শয়তান মারাত্মক ভুল করেছে। ফলশ্রুতিতে সে হয়েছে অভিশপ্ত-বিতাড়িত শয়তান। এটা হয়েছে তাঁর অহংকারের এবং আল্লাহর নিকট যুক্তি পেশ করার কারণে, কারণ, যুক্তি-তর্ক দিয়ে আল্লাহকে পাওয়া যায় না। ৪/ শয়তান বুঝতে পারে নাই যে, আল্লাহকে পেতে হলে লাগে নিঃশর্ত ও টোটেল সারেণ্ডার, হওয়া লাগে মুসলিম/মুসলিমীন। আর শেষপর্যন্ত বলতে হয়, এ সবকিছুই হয়েছে আল্লাহ পাকের পুর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী। কারণ, আল্লাহর প্ল্যানই ছিল ওরকম, এবং ফাইনাল।
এখানে শয়তান প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি কথা বললে বিষয়টি পূর্ণাঙ্গতা পাবে। তার যে লীডারশিপ কুয়ালিটি ছিল বা কেয়ামত পর্যন্ত যেটা তার বলবৎ থাকবে, তা কিন্তু অনন্য। সে অসম্ভব সাহসী এবং সে স্বয়ং অভিশপ্ত ও বেহেশ্ত থেকে দুনিয়া ও আখেরাতে চিরদিনের জন্য বিতাড়িত জেনেও তার দু’টো দোয়াই আল্লাহর কাছ থেকে সে মকবুল করিয়ে নিয়েছে। অল্লাহর বিরুদ্ধে তার যে বিদ্রোহ, তা আদৌ গোপনে নয়, বরং সম্পূর্ণ প্রকাশ্যে। সে তার কোটি কোটি সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে তার ‘প্যান্ডিমোনিয়াম’ (বিশৃঙ্খলা) সামক সংসদ-ভবনে যত সব মিটিং করেছে বা আজও নিশ্চয় করে, আর সেখানে যে সমস্থ জোরলো ভাষণ দিয়েছিল বা এখনো দেয়, তাতে প্রমানিত হয় যে, প্রকৃতপক্ষেই সে একজন সফল লীডার। কারণ, গোটা মহাবিশ্বের একচ্ছত্র-একমাত্র অধিপতির মিথ্যা দাবী করে নমরুদকেও মরতে হয়েছে, মরতে হয়েছে ২য় নেয়ারকেও, কিন্তু শয়তান আজও বেঁচে আছে এবং কিয়ামত পর্যন্তও বেঁচে থাকবে। কিন্তু নিজেকে সে কখনো আল্লাহর সমকক্ষ ভাবে নি, এবং অল্লাহর সাথে অপর কাউকে সে কখনো শরীকও করে নি। তাই, আমার কথাগুলো হচ্ছেঃ প্রথমতঃ, শয়তান কখনো মুশরিক নয়, সে আল্লাহর একত্ববাদে পুরো বিশ্বসী এবং এজন্য তার দোয়া দু’টিও ছিল একমাত্র অল্লাহরই কাছে। দ্বিতীয়তঃ, সে মোনাফিক্বও নয়। আর তৃতীয়তঃ, সে শুধু কাফের, আল্লাহর দুশমন। আল্লাহ আমাদের সকলকে এ সবকিছু থেকেই আমৃত্যু হেফাযৎ করুন, আমীন।
হাওয়া (আঃ) এর সৃষ্টির ব্যাপারে বলা হয়েছে, আদমের ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর পাজরের একটি হাড্ডি নিয়ে হাওয়া (আঃ)কে সৃষ্টি করা হয়েছে সেটা থেকে। বেহেশ্তে অবস্থানকালিন সময়ে আদম এবং হাওয়ার অসুখ-বিসুখ, মৃত্যু ছিুই ছিল না। পৃথিবীতে আসার সময় তাঁরা এগুলো তাঁদের সাথে করেই নিয়ে আসলেন। ব্যাখ্যায় পাওয়া যায়, নেককার বুজুর্গের সুরত ধরে ইবলিস আদম (আঃ) এর কাছে বার বার আসলেও তাঁকে রাজি করাতে পারে নি নিষিদ্ধ গাছের ফল খেতে। বিফল মনোরথ হয়ে সে শেষপর্যন্ত হাওয়া (আঃ) এর শরনাপন্ন হয়। ওদিকে হাওয়া (আঃ) উদগ্রীব ছিলেন সুন্দর বেহেশ্তে একা একা ঘুরাফেরার জন্যও, যদিও আদম (আঃ) তাঁকে এ সুযোগ কখনো দেন নি।
কিন্তু একদিন হাওয়া (আঃ) নিজেই এ সুযোগ কোনভাবে করে নিতে সক্ষম হয়ে গেলেন। একা একা ঘোরার সময়ের এক ফাঁকেই ইবলিস বড় বুযুর্গের বেশে হাওয়া (আঃ) এর সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়ে গেল। আদম (আঃ) ওখানে উপস্থিত হওয়ার পূর্বেই ইবলিস হাওয়া (আঃ)কে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার ব্যাপারে মোটামোটি রাজি করে ফেলতে সক্ষম হয়ে যায়। আর, এজন্যই আজও আল্লাহর নিকট এটা পছন্দনীয় নয় যে, কোন নারী কখনো একা থাকুন। আদম (আঃ) নিকটে আসতেই শয়তান পুনরায় তার য়ুক্তি আরম্ভ করে এই বলে যে, ১/ এ ফল খেলেই আপনারা অমর হয়ে উঠবেন। বেহেশ্তে কোন জ্বরা-মৃত্যু আপনাদেরকে আর স্পর্শ করতে পারবে না। ২/ আপনাদেরকে আর কখনো বেহেশ্ত থেকে বের হতে হবে না, অমর হয়ে চিরদিন বেহেশ্তের বাগানেই বসবাস করতে পারবেন। ৩/ আপনাদের অমরত্ব রোধ করতেই আপনাদের আল্লাহ আপনাদেরকে এ ব্যাপারে নিষেধ করেছেন। ৪/ এ ছাড়া, আপনাদের প্রতি এ হুকুম কার্যকর ছিল আপনাদের বেহেশ্তে বসবাসের প্রাথমিক অবস্থায়। ৫/ বেহেশ্তে বসবাসের এত দীর্ঘ সময় পার হওয়ার পর ঐ হুকুম আর কার্যকর নহে।
আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, এত দীর্ঘকাল পূর্বের ঐ নিষেধ আদম-হাওয়া নিজেরাই হয়তো অনেকটাই ভুলতে বসেছিলেন। তার চাইতেও বড় সত্য হলোঃ মহান আল্লাহরই ইচ্ছা, আদম-হাওয়াকে শেষপর্যন্ত দুনিয়াতেই পাঠাবেন, এবং এটা করতে গিয়ে একটা ছোঁতুরও প্রয়োজন ছিল। যা-ই হোক, তাঁরা ফল খেলেন, আর সাথে সাথে যে কঠোর শাস্তি তাঁদের উপর এসে পড়ল, তা হল (আল-ক্বোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী), তাঁদের শরীর থেকে বেহেশ্তি পোশাক খসে পড়ল এবং লজ্জাস্থান ঢাকার জন্য তাঁরা উভয়ে বেহেশ্তি গাছের বড় বড় পাতা নিজেদের গায়ে জড়িয়ে লজ্জা-নিবারন করলেন। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ আল-ক্বোরআনে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে, যেটা হল বেহেশ্ত হইতে আদম-হাওয়ার পৃথিবীতে আগমন।
এখন গবেষণার বিষয় হলোঃ আদম ও হাওয়ার দুনিয়াতে আসার ব্যাপারে ইসলাম কী বলে ? ইসলাম যা বলবে, ওটাই হবে ফাইনাল। ইসলামিক ভাষ্য অনুযায়ী, হাওয়া (আঃ) পৃথিবীতে অবতরন করেন সৌদি আরবের জেদ্দায়, আর আদম (আঃ) অবতরন করেন শ্রীলঙ্কায়। তবে, বাইবেল ইংগিৎ দিয়েছে, আদম ও হাওয়া বেহেশ্ত হইতে পৃথিবীতে অবতরন করেছিলেন ভিন্ন দুই দেশের ভিন্ন দুই নদীতে। এক নদী হলো জর্ডানের ‘জর্ডান নদী; আর, অপরটি হলো ইরাকের টাইগ্রিস নদী (ইউফ্রেটিস নদী (ফোরাত নদী) সম্পূর্ণ ছাড়াও, টাইগ্রিস নদীর অধিকাংশই পড়েছে ইরাকে)। তবে অপরাপর ব্যাখ্যায় এসেছে, তাঁরা ঐ দুই নদীতে প্রথমেই অবতরন করেন নি, বরং আদম (আঃ) পরবর্তীতে বিবি হাওয়াকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, আল্লাহর নিকট তাঁদের অনুশোচনা বা তওবা ক্ববুল হওয়ার জন্য তিনি ৪০ দিন থাকবেন জর্ডান নদীতে, আর হাওয়া ৪০ দিন থাকবেন টাইগ্রিস নদীতে। আদম (আঃ) আল্লাহর কাছে তৌবার দোয়া করেছিলেন জর্ডান নদীতে বসবাসকারি সকল প্রাণীকূলকে নিয়ে।
কিন্তু ক্বোরআন-হাদিস ছাড়া বাকি সকল বর্ণনাই নিছক বানানো গল্প। ইসলামিক ভাষ্য অুনুযায়ী, অদম-হাওয়ার নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়া আল্লাহরই মনসায়। তাঁদের বেহেশ্তি লেবাস খসে পড়া আদৌ কোন শাস্তি নয়, এটাও আল্লাহরই মনসা অনুযায়ী, তাঁদেরকে দুনিয়াতে পাঠানো ছিল আল্লাহরই প্ল্যান। তবে আদম-হাওয়ার বেহেশ্তি লেবাসের নমুনা আজও রয়ে গেছে আমাদের গায়ে; আর, তা হল আমাদের হাত-পায়ের স্কীন-টাইট নখ। হতে পারে, আদম-হাওয়ার ক্ষেত্রে ওগুলো ছিল ইলাস্টিক ও নরম।
বাইবেলের এক ভাষ্য অনুযায়ী, আল্লাহ আদম (আঃ)কে সৃষ্টি করেছিলেন আজ থেকে প্রায় ১ লক্ষ বিশ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৫৬ হাজার বছর পূর্বে। তবে, ক্বোরআনিক ভাষ্যে অন্যতা পাওয়া গেলে ওটাই হবে ফাইনাল।
আমরা বিশ্বাস করি যে, আদম-হাওয়া একত্রিত হছিলেন আরাফাত পাহাড়ের ময়দানে। তাঁদেরকে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছিল বিচ্ছিন্ন করে দূর দুই দেশে, আল্লাহর মনসা ছিল, তাঁরা একে অপরকে খুঁজুক। আদম (আঃ) পৃথিবীতে বেঁচেছিলেন ৯৩০ থেকে ১০০০ বৎসরের মধ্যে। তাঁদের সন্তান-সংখ্যা ছিল ৫৬ জন। আবার এরকমও পাওয়া যায়, আজ অবধি মানবজাতির বয়স ১০ হাজার বছরের নিচে, যেহতু আদমের জন্ম হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পৌনে ৮০০০ বছর পূর্বে মাত্র।
বেহেশ্ত থেকে দুনিয়ায় আসার কারণে বাহ্যিক দিক থেকে কেউ ধরে নিতে পারে, আল্লাহ এবং আদম-হাওয়ার মধ্যে দূরত্ব সিৃষ্টি হয়েছে। এ রকম ভাবা মোটেও ঠিক নয়। কারণ, আল্লাহর পরিকল্পনাই ছিল এরকম। পরবর্তীতে আবার আল্লাহই তাঁদেরকে মাফের দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা অনুশোচনা করে দোয়া করেছেন, আল্লাহ ক্ববুলও করেছেন। সুতরাং মহান আল্লাহর সাথে তাঁর নবীর সম্পর্কের আদৌ কোন পরিবর্তন, বা হেফের হয় নি।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) নবীজির হাদিস বর্ণনা করেন যে, আল্লাহর কুদরতি হাতে বেহেশ্তে সৃষ্টির সময় আদম (আঃ) ছিলেন ৬০ হাত লম্বা, (বোখারি-৩৩২৬)। আর, ৪০ দিন পর যখন বিবি হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়, তখন তিনিও আদমের আনুপাতিক হারেই লম্বা ছিলেন, তবে আদম থেকে অবশ্যই খাটো। তবে ইবনে খলদূন (১৩৩২ – ১৪০৬) বলেন, “পৃথিবীতে আসার সময় পৃথিবীর বাসিন্দা হিসেবে আনুপাতিক উচ্চতা নিয়েই উভয়ে পৃথিবীতে পদার্পন করেছিলেন”। কিন্তু, আখেরাতে সকল জান্নাতিই হবেন ৬০ হাত লম্বা এবং শারিরিক আকার- আকৃতির দিক থেকে হবেন আদম-হাওয়ারই মত যুবক- যুবতী।
পৃথিবীতে আগমনের ৬ষ্ট ও ৭ম দিনে তাঁরা উভয়েই খুবই ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলেন। পশুর খাদ্য ছাড়া আর কিছুই তাঁরা কোথাও খুঁজে পেলেন না। হাওয়া আদমকে এ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, “আমি তো ক্ষিধায় মরেই যাব, আর, আপনাকেও এ কষ্টে এবং বিপদে আমিই ফেলেছি”। আদম ঐ মুহুর্তেও হাওয়াকে শান্তনাই দিয়েছিলেন। এর কোন এক সময়ে আল্লাহ ফেরেশ্তা পাঠিয়ে আদমকে কৃষিকাজ, রুটি বানানো ও রান্নাবান্না শিক্ষা দিলেন। তবে দূরের দুই দেশে অবতরন করেও তাঁরা আবার একই সঙ্গে একত্রিত হয়ে কি ভাবে ক্ষুধার্ত হওয়ার ব্যাপারে ও খাদ্য খোঁজার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করলেন, তা-ও আশ্চর্যের বিষয়। ভিতরের রহস্য মহান আল্লাহ পাকই ভাল জানেন। এ সমস্ত সকল ব্যাপারে কোন মন্তব্য করা আমাদের পক্ষে আদৌ ঠিক হবে না। তাই, এ সমস্ত সবকিছুই আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়া আমরা মুসলমানদের জন্য উত্তম।
অপরাপর ব্যাখ্যায় এসেছে, বিচ্ছেদ-পরবর্তী পুণঃমিলনের সময় থেকে আদম এবং হাওয়া (আঃ) পৃথিবীতে ১৮ বছর দুই মাস বসবাস করেছিলেন। এ সময়কালে তাঁরা ৩০ বা ৩২ জন কন্যাসন্তান এবং ৩০ বা ৩৩ জন পুত্রসন্তান জন্ম দেন। প্রতিবারই জমজ এক ভাই ও এক বোন। এরকম হত আল্লাহরই ইচ্ছায়। এক জন্মের ভাইয়ের বিয়ে হত পরবর্তী জন্মের বোনের সাথে, আর ঐ জন্মে বোনের বিয়ে হত পরবর্তী জন্মের ভাইয়ের সাথে। মহান আল্লাহর ইচ্ছা ছিল, এভাবে তাঁর বান্দাদের সংখ্যা-বৃদ্ধি করা।
অপর ব্যাখ্যায় এসেছে, আদমের মাধ্যমে বিবি হাওয়া ১২০ বার গর্ভ ধারণ করেছিলেন। সুতরাং, তাঁদের সন্তান-সংখ্যা ছিল ১২০ঢ২=২৪০ জন। আরও বলা হয়েছে, আল্লাহ-প্রদত্ত শিক্ষায় আদম (আঃ) এর বুদ্ধিবৃত্তির লেভেল ছিল অতিব উচ্চাঙ্গের, আশ্চর্যজনক ও চমক-প্রদ। আল্লাহ আদমকে ২১ বান্ডিল কাগজও দিয়েছিলেন এবং তাতে লিখাও তাঁকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন।
ইহুদি রাব্বানিক সাহিত্য জানায়, আদম-হাওয়া (আঃ) নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়েছিলেন আদমকে সৃষ্টির ৮ম বছরের ২য় মাসের ১৭ নম্বর দিনে। অর্থাৎ, ততদিনের একটু কম সময় তাঁরা উভয়ে বেহেশ্তে বসবাস করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, আদম (আঃ) বেহেশ্তে প্রবেশ করেন তাঁর সৃষ্টির ৪০ দিন পর, আর হাওয়া প্রবেশ করেন তাঁর সৃষ্টির ৮০ দিন পর। অর্থাৎ, বুঝা যায়, হাওয়া ছিলেন আদমের ৪০ দিনের ছোট।
আরেক ব্যাখ্যায় এসেছে, আদম (আঃ) অবতরন করেছিলেন ‘সাফা’ পহাড়ের চুড়ায়; আর, হাওয়া (আঃ) অবতরন করেছিলেন ‘মারওয়াহ’ নামক পর্বতশৃঙ্গে। এবং, এই দুই পাহাড়ের পাথর দিয়েই কাবাঘরের একাংশ প্রথমে নির্মিত হয়েছিল।
হযরত আদম (আঃ) এর মৃত্যুর পর আল্লাহর হুকুমে চন্দ্র এবং তারকারাজি ৭ দিন অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। আদমের ইন্তিক্বালের ৬ দিন পর বিবি হাওয়া মারা যান।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি