বায়ে আহতদের দেখতে সিলেটে শেখ হাসিনা, ডানে হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেড। ফাইল ছবি।

সিলেট নগরীর তালতলাস্থ গুলশান সেন্টারে গ্রেনেড হামলার দেড় যুগ পূর্তী হচ্ছে আজ রোববার (৭ আগস্ট)। ২০০৪ সালের ৭ আগস্ট ওই সেন্টারে আওয়ামী লীগের কাযর্করী সভা শেষে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। ওই হামলায় নগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রচার সম্পাদক ইব্রাহিম আলী নিহত হন। গ্রেনেডের স্পি­ন্টারের আঘাতে আহত হন ২০ জন নেতাকর্মী।

আহত সেই নেতাকর্মীদের অনেকেই এখনো ফিরতে পারেননি স্বাভাবিক জীবনে। স্প্লিন্টার শরীরে বয়ে চলেছেন তারা। এদিকে, ওই হামলার ঘটনায় বিচারকার্য শেষ হয়নি এখনও। সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আটকে আছে বিচার। ফলে ভুক্তভোগীদের হতাশা বাড়ছে।


জানা গেছে, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দেশব্যাপী আলোচিত ওই হামলার ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহের চেষ্টা হয়েছিল। হামলার পর তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনাকে ‘আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধের ফল’ বলে উল্লেখ করা হয়। ওই সময় প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা নুনু মিয়া, সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের তৎকালীন আহŸায়ক হাবিবুর রহমান, যুগ্ম আহ্বায়ক ইলিয়াসুর রহমান, তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা বিধান কুমার সাহা, রণজিৎ সরকারসহ কয়েকজনকে আটকও করা হয়।

ঘটনার পরদিন সিলেট কোতোয়ালী থানার তৎকালীণ এসআই এনামুল হক বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামী করে হত্যা মামলা ও বিস্ফোরক মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সিআইডি’র তৎকালীন পরিদর্শক জুবায়ের আহমদ নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি)-এর নেতা মুফতি হান্নান, মুহিবুল্লাহ, শরীফ সাহেদুল আলম ওরফে বিপুলসহ ৬ জঙ্গিকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। আদালতে হামলার দায় স্বীকার করে শরীফ সাহেদুল আলম।

এদিকে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালেল ২ আগস্ট আদালতে মামলা পরিচালনাকারী আওয়ামী লীগ নেতা ও পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ মামলার পুনঃতদন্তের আবেদন জানান। আদালত আবেদন আমলে নেন। অধিকতর তদন্ত শেষে সিআইডি’র সিলেট অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ সহকারি পুলিশ সুপার রওনকুল হক চৌধুরী ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। তাজ উদ্দিন ও আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাটকে যুক্ত করে ৮ জঙ্গির বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। সম্পূরক অভিযোগপত্রের নম্বর ১৭৮।

মামলার নথি অনুসারে, ওই হামলায় ব্যবহৃত হওয়া আর্জেস গ্রেনেড পাকিস্তানি এক নাগরিকের কাছ থেকে চট্টগ্রামে সংগ্রহ করেছিলেন পাকিস্তানি জঙ্গি নেতা আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ। ঢাকায় মুহাম্মদপুরস্থ নিজের বাসায় সেই গ্রেনেড সংরক্ষণ করেন তিনি। পরে জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানের মাধ্যমে সেই গ্রেনেড আসে সিলেটে।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, গুলশানে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে দায়েরকৃত মামলায় ৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয় ২০১৫ সালের ৭ মে। মামলার সাক্ষগ্রহণ করা হয় সিলেট অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে। ২০১৫ সালের ১৫ জুন এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর এখন অবধি ৬৪ সাক্ষীর মধ্যে প্রায় অর্ধেক সাক্ষ্য দিয়েছেন। এদিকে, ওই ঘটনায় দায়েরকৃত হত্যা মামলাটিও বর্তমানে বিচারাধীন। সিলেটের জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর এ মামলায় ৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।

মামলার ৮ আসামিদের মধ্যে তিনজনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে ভিন্ন মামলার রায়ে। মুফতি আবদুল হান্নান, শরীফ সাহেদুল আলম ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল কার্যকর হয়। সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার মামলার রায়ে তাদের ফাঁসি হয়।

গুলশান সেন্টারে গ্রেনেড হামলার অপর তিন আসামি মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ ওরফে খাজা, মো. মফিজুল ইসলাম ওরফে মফিজ ওরফে অভি ওরফে মহিব উল্লাহ ও আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ কারাগারে রয়েছেন। অপর দুই আসামি মাওলানা তাজ উদ্দিন ও হুমায়ুন কবির হিমু পলাতক।

মামলার বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সিলেট অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পিপি জুবায়ের বখত জুবে বলেন, করোনার আগে সর্বশেষ সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছিল। এরপর লকডাউনে আদালত বন্ধ হয়ে যায়, সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। পরবর্তীতে আদালতের কার্যক্রম শুরু হলেও ধার্য দিনে দেখা যায় সাক্ষী এলে আসামি হাজির হয় না। ফলে আর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পিপি সৈয়দ শামীম আহমদ বলেন, করোনার সময়ে আদালতে বন্ধ থাকায় চাঞ্চল্যকর এই মামলার বিচারকার্যে তেমন অগ্রগতি হয়নি।

এদিকে ওই গ্রেনেড হামলায় আহতদের অনেকেই এখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। শরীর বিদ্ধ থাকা স্প্লিন্টারের নির্মম যন্ত্রণা সহ্য করে চলেছেন তারা।

হামলায় আহতদের মধ্যে ছিলেন- সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, আওয়ামী লীগ নেতা মফুর আলী, এনামুল হক, তুহিন কুমার দাস, ফয়জুল আনোয়ার আলোয়ার, অধ্যাপক জাকির হোসেন, এডভোকেট রাজ উদ্দিন, কবীর আহমদ, তপন মিত্র, জুবের খান, শেখ মখলু মিয়া, প্রদীপ পুরকায়স্থ, এটিএম হাসান জেবুল, ফাহিম আনোয়ার, আজম খান, সোবহান আহমদ, মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী, আনোয়ার হোসেন রানা ও জামাল চৌধুরী।

এঁদের অনেকেই এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। কেউ কেউ খুড়িয়ে চলেন, কেউ কেউ ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলেন।

গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়া আওয়ামী লীগ মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ সিলেটভিউকে বলেছিলেন, ‘দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারি না। কিভাবে যেন বেঁচে গেলাম! তবে এখনো শরীরে স্প্লিন্টার বিদ্ধ। চলাফেরা করতে পারলেও স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা প্রায়ই কাতর করে তুলে।’

সেদিন কার্যকরী সভা শেষে তৎকালীন সিটি মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বেরিয়ে যাওয়ার পরই গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া গেল বছর কামরান করোনায় মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে ওই হামলা প্রসঙ্গে তিনি সিলেটভিউকে বলেছিলেন, ‘সিলেটে আওয়ামী লীগের নেতাদের নিশ্চিহ্ন করতেই হামলা করা হয়েছিল। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যর্থ হয়েছে।’

এদিকে, ৭ আগস্ট ওই গ্রেনেড হামলার পর, ১২ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা আহতদের দেখতে সিলেট এসেছিলেন। এর কয়েকদিন পর, ২১ আগস্ট ঢাকায় তাঁর জনসভাতেই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান শেখ হাসিনা।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে