ভারতের মেঘালয় রাজ্যের জৈন্তিয়া হিল এলাকায় রয়েছে নারপুহ রিজার্ভ ফরেস্ট বা নারপুহ সংরক্ষিত বন। এটি সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার পূর্ব ও পশ্চিমে লক্ষীপ্রসাদ ইউনিয়নের অত্যন্ত নিকটবর্তী।

 


একদিন মনে হলো, নারপুহ সংরক্ষিত বন সম্পর্কে একটু জানি। নারপুহ সংরক্ষিত বনে হরিণ, বন্য শুকোর, চিতাবাঘ, কাল বাঘ (ব্ল্যাক প্যান্থার), ছোট আকারের মেঘলা চিতা রয়েছে।

 

নারপুহ সংরক্ষিত বনের অত্যন্ত নিকটবর্তী হবার ফলে চিতাবাঘ, কালোবাঘ, মেঘলা চিতা ইত্যাদি প্রাণীর কানাইঘাটে প্রবেশ করা স্বাভাবিক। এ বিষয়ে তেমন কোন তথ্য বা উপাত্ত এখনও নেই। তাই এ সংক্রান্ত কিছু তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করা হলো।

 

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেষ্ট্রি ও এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ কাজী মাসুম জানালেন, ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্য থেকে চিতাবাঘ অনেক সময় সিলেট ও মৌলভিবাজার এলাকার সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে প্রবশ করে।

 

সিলেটের লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেষ্ট্রি ও এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ কামরুজ্জামান চৌধুরী জানালেন কানাইঘাটের লোভাছড়া চা বাগান এলাকায়  অনেক সময় ভারত থেকে চিতাবাঘের আগমন ঘটে এবং গবাদীপশু আক্রমনের ঘটোনা কয়েকবার ঘটেছে। কথা হলো কানাইঘাটের নুনছড়া সরকারী প্রাথমিক বিধ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব দিলীপ কৌরী সাহেবের সাথে।

 

তিনি জানান পুর্ব লক্ষী-প্রসাদ ইউনিয়নের মূলাগুলের জংগলে টেংরা টিলায় চিতাবাঘের আগমন ঘটে থাকে। তিনি আরও জানান, ২০০৭ সালে লোভাছড়া চা বাগানের টেংরা টিলার নীচে এম. ডি বাংলোর নিকটবর্তী স্থানের সড়ক দিয়ে হাঁটার সময় ছোট আকারের মেঘলা চিতার সামনে এসে পড়েন। বাঘটি আক্রমণ না করায় তিনি রক্ষা পান। তাছাড়াও লোভাছড়া চা বাগানের ঝুলন্ত ব্রীজের নীচে তিনি ছোট আকারের মেঘলা চিতা দেখেছেন প্রায় ৫ বছর আগে।

 

বড়্গ্রাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রতাপ চন্দ্র দাস জানান, মুলাগুল চা বাগানের ছড়ারপার, লোভছড়া চা বাগানের অন্তর্গত সীমান্তের পাশ্ববর্তী মানজি পাহাড়ি এলাকায়, বড় গ্রামের পাহাড়ী এলাকা, মুলাগুল চা বাগানে এবং বড়্গ্রাম পাহাড়ী এলাকার পাশ্ববর্তী ৮৩ নামক স্থানের খোলা ময়দানে রাতের আধারে চিতাবাঘ, হরিণ, বন্য শুকরের বিচরণ লক্ষ করা যেত। এক সময় হাতিও দেখা যেত। নুনছড়া চা বাগানেও চিতা এবং মেঘলা চিতা দেখা গেছে।

 

তিনি আরও জানান, বেশ কয়েক বছর আগে বড়্গ্রাম ছড়ারপার কালিজুড়ী ইত্যাদি এলাকায় বাঘের আক্রমনে গরু ছাগল মারা যেত। পাহাড়ি এলাকাগুলোতে বেশীর ভাগ সময় গরু, ছাগল বাঘের আক্রমনের কবলে পড়তো। বাঘ ধরার সময় গ্রাম্য এলাকায় মেলার মত আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হতো। বাঘ ধরাকে কেন্দ্র করে খেলনার বাজার বসতো এবং বিভিন্ন ধরনের খেলার আয়োজন হতো। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসার ফলে আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হতো। স্থানীয় ভাবে বাঘ ধরার প্রক্রিয়াটিকে “বাঘ গড়” বলা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য কানাইঘাটের পুর্ব লক্ষী প্রসাদ ইউনিয়নের ডনা নামক গ্রামের পাশ্ববর্তী ভারত অংশে মেঘালয় রাজ্য এবং আসাম রাজ্য বিভক্ত হয়েছে।

 

লোভাছড়া এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একসময় এম. ডি. বাংলোর কাছাকাছি এলাকায় বেশ কয়েকটি চিতাবাঘ এবং কালোবাঘ বিচরণ করতো। এলাকাবাসীগণ বেশ কয়েকটি চিতা এবং কালোবাঘ ধরতে সক্ষম হয়েছে।

 

কথা হলো কানাইঘাটের ২নং পশ্চিম লক্ষীপ্রসাদ ইউনিয়নের কালীনগর গ্রামের জনাব এবাদুর রহমান সাহেবের সাথে। বেশ কয়েক বছর আগে তিনি মেঘলা চিতার আক্রমনে পতিত হন। তিনি লোভাছড়া এলাকায় ধান কাটতে গিয়েছিলেন। লোভাছড়া থেকে কালীনগর গ্রামে আসার পথে নুনছড়া এলাকার খাল অতিক্রম করার পর চা বাগান এবং টিলার মাঝামাঝি জনবসতীহীন সমতল খোলা স্থানে তিনি চিতাবাঘের আক্রমনে পড়েন। তিনি ছোট আকৃতির মেঘলা চিতাটির সাথে কিছু সময় যুদ্ধ করেন। বাঘটি এবাদুর রহমানকে প্রায় ৪০ ফুট দূরে নিয়ে যায় এবং তাঁর হাতে, মুখে, মাথায় থাবা দেয়। ৯ দিন কানাইঘাট হাসপাতালে থাকার পর তিনি বাসায় ফেরেন। বাঘের সাথে যুদ্ধের এক পর্যায়ে দূর থেকে কিছু মানূষ ছুটে এলে চিতাটি পলায়ন করে। কানাইঘাটের পূর্ব ও পশ্চিমে লক্ষীপ্রসাদ ইউনিয়নের চিতা, মেঘলা চিতা, কালোবাঘগুলো মূলত ভারতের নারপুহ সংরক্ষিত বন এলাকার। খাবারের সন্ধানে মাঝে মধ্যে সিলেটের কানাইঘাট এলাকায় প্রবেশ করে থাকে।

 

তবে সীমান্তয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কাটাতারের বেড়া দেয়ার ফলে চিতাদের আনাগোনা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। তবে মাঝে মধ্যে মূলত শীতকালীন সময়ে গভীর রাতে যে সকল এলাকায় এখনও কাটাঁতারের বেড়া নেই, সেই সব এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে মেঘলা চিতাবাঘের প্রবেশ করার ঘটনা এখনও শোনা যায়। বনবিভাগ ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে সিলেট অ লের বিভিন্ন ধরণের বন্য প্রাণী বিশেষত চিতা বাঘ সংক্রান্ত গবেষণাধর্মী স্টাডি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।


লেখক: অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।