প্রতীকী ছবি।

ফুটবলে সিলেটের অতীত ইতিহাস সমৃদ্ধ। কিন্তু বর্তমানের প্রসঙ্গ এলেই শোনা যায় হায়-হুতাশ। এ অঞ্চলের একাধিক ফুটবলার জাতীয় দলের ত্রিসীমানায় থাকলেও স্থানীয় ফুটবলের করুণ দশা যেন কাটতেই চায় না। বহু বছর পর প্রিমিয়ার ডিভিশন ফুটবল লিগ মাঠে গড়ালেও অব্যবস্থাপনার বেড়াজাল স্পষ্ট। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ লিগে অংশগ্রহণকারী ক্লাব কর্মকর্তা, ফুটবলার সবাই।

সিলেটের ফুটবলে হতাশার চিত্র কতোখানি প্রকট, তা ফুটে ওঠে দু-একটি তথ্যে। স্থানীয় ফুটবলে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম বিভাগ লিগ সর্বশেষ হয় ২০১৮-১৯ মৌসুমে। তিন বছর ধরে এই লিগের কোনো দেখা নেই। সুখবর নেই দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লিগেও। এই লিগ সর্বশেষ মাঠে গড়িয়েছিল ২০১৯-২০ মৌসুমে।


আর প্রিমিয়ার ডিভিশন ফুটবল লিগের অবস্থা তো আরও করুণ! এ বছরের আগে সর্বশেষ এই লিগ হয়েছিল সেই ২০১৭ সালে। পাঁচ বছর পর এবার লিগের আসর শুরু হয়েছে।

কিন্তু অবিশ্বাস্য বিষয় হচ্ছে, সেই ২০১৭ সালের লিগের যৌথ চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়েছে এবারের লিগ শুরুর ঠিক আগে! সেবার সিলেট ইউনাইটেড ক্লাব ও গ্লোরিয়ার্স স্পোর্টিং ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড়ে সমানতালেই ছিল। তখন তাই কাউকেই চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়নি। এবারের লিগের আগমুহূর্তে উভয় দলকেই চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করেছে লিগ কমিটি। তবে কোনো দলকেই প্রাইজমানি কিংবা কোনো ধরনের পুরস্কার প্রদান করা হয়নি।

এবারের প্রিমিয়ার ডিভিশন শুরু হওয়ার কথা ছিল গত সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখ থেকে। তবে সেখান থেকে পিছিয়ে এসে শুরুর তারিখ ৬ অক্টোবরে নেয় লিগ কমিটি। তখন লিগ কমিটি জানায়, ‘কয়েকটি ক্লাবের অনুরোধের প্রেক্ষিতে’ লিগ শুরুর তারিখ পেছানো হয়েছে।

৬ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে লিগ। সিলেট ইউনাইটেড ক্লাব, আবাহনী ক্রীড়াচক্র, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, গ্লোরিয়ার্স স্পোর্টিং ক্লাব, কসমস ক্লাব, জনতা স্পোর্টিং ক্লাব (কুচাই), টিলাগড় স্পোর্টিং ক্লাব, সিলেট স্পোর্টিং ক্লাব, লাউয়াই স্পোর্টিং ক্লাব ও বীর বিক্রম ইয়ামিন ক্রীড়াচক্র খেলছে লিগে।

লিগ শুরু হলেও রয়ে গেছে অব্যবস্থাপনা। বৃষ্টির বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে লিগ শুরুর পর মাঝপথে স্থগিত করা হয়েছে। গত ১১ অক্টোবর স্থগিত করা লিগ আগামী বুধবার (১৯ অক্টোবর) থেকে ফের মাঠে গড়ানোর কথা রয়েছে।

এবারের লিগে নেই কোনো অংশগ্রহণ ফি। অর্থাৎ, ক্লাবগুলো লিগে অংশগ্রহণ করলেও কোনো ফি পাচ্ছে না। লিগে কোনো ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরস্কারও রাখা হয়নি!

প্রিমিয়ার ডিভিশনের প্রথম আসরে ক্লাবগুলোর অংশগ্রহণ ফি ও ম্যাচসেরার পুরস্কার দুটোই ছিল। এবার দ্বিতীয় আসরে এসে ঘটেছে ‘অবনমন’!

লিগে যে দল দুটি চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ হবে, তারা প্রাইজমানি কতো করে পাবে, তাও জানে না অংশগ্রহণকারী ক্লাবগুলো। প্রাইজমানি বিষয়ক কোনো তথ্যই ক্লাবগুলোকে জানানো হয়নি।

অব্যবস্থাপনার শেষ এখানেই নয়। যেকোনো লিগেই লিগ কমিটি ম্যাচের দিন খেলোয়াড়দের জন্য ন্যুনতম পানির ব্যবস্থা রাখে। কিন্তু সিলেটে প্রিমিয়ার ডিভিশন ফুটবল লিগে ক্লাবগুলো পানিও পাচ্ছে না। নিজেদের ব্যবস্থাপনায় ক্লাবগুলো বাইরে থেকে পানি নিয়ে আসে।

এইসব অব্যবস্থাপনা ও ঘাটতি নিয়ে ক্লাবগুলোর মধ্যে আছে অসন্তোষ।

সিলেট ইউনাইটেড ক্লাবের ম্যানেজার পলাশ মিয়া সিলেটভিউকে বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে প্রিমিয়ার ডিভিশনের প্রথম আসর শেষ হয়। চলতি মাসের শুরুর দিকে আমাদেরকে যৌথ চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় সিলেটের ফুটবল কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হলেও আমাদেরকে কোনো ধরনের প্রাইজমানি বা পুরস্কার প্রদান করা হয়নি। এবারের লিগও চলছে নানা অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে।’

টিলাগড় স্পোর্টিং ক্লাবের ম্যানেজার ইমরাজ আহমদ সিলেটভিউকে বলেন, ‘সিলেটের সর্ববৃহৎ ফুটবল আসর শুরু হয়েছে অগোছালোভাবে। এতো বড় আসর, অথচ ন্যুনতম জাঁকঝমকপূর্ণ কোনো আয়োজন আমরা দেখিনি। আমরা যে খেলছি, আমাদের কোনো অংশগ্রহণ ফি নাই। পুরস্কার কী দেবে নাকি দেবে না, সেটাও জানি না। খাবার পানিও পাওয়া যায় না।’

জনতা স্পোর্টিং ক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল আলম সুকন সিলেটভিউকে বলেন, ‘লিগে বেশ কয়েকটি ম্যাচ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন অবধি আমরা জানি না, চ্যাম্পিয়ন, রানার্সআপ হলে প্রাইজমানি কতো, পুরস্কারইবা কী! ফুটবল লিগ মানেই হচ্ছে অংশগ্রহণ ফি থাকবে। কিন্তু আমাদের জন্য সেটাও বরাদ্দ নেই। ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরস্কার দেওয়া হয় না, পানিও পাই না। মাঠের অবস্থাও খারাপ। ডাগআউটের যে আউটলাইন থাকে, সেটাই দেখা যায় না! এখন কোচ, ম্যানেজার দাঁড়াবে কোথায়?’

তিনি বলেন, ‘রেফারিং কতোটা মানসম্মত হচ্ছে, সেটাও বড় প্রশ্ন।’

সুকন প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘প্রত্যেকটি ক্লাব লাখ লাখ টাকা খরচ করে লিগে অংশ নিচ্ছে। বিনিময়ে কী পাচ্ছে? এভাবে চললে সিলেটের ফুটবল আগাবে না।’

প্রিমিয়ারে খেলা এক ফুটবলারের কণ্ঠে হতাশা ঝরছিল এভাবে, ‘সবচেয়ে অভিজাত আসরের খেলা চলছে। অথচ ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরস্কারটা পর্যন্ত নাই! একজন খেলোয়াড় ভালো খেলার তাড়না, তাগিদ কোথা থেকে পাবে? তাকে তো উৎসাহ দিতে হবে। সেই উৎসাহ পাচ্ছি না লিগে। মাঠে আসি, খেলি, চলে যাই, ব্যস!’

এদিকে, প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগের মূল স্পন্সর ফ্যাশন হাউস ‘মাহা’। কো-স্পন্সর হিসেবে আছে বারাকা গ্রুপ, কুশিয়ারা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন হল এবং হোটেল স্টার প্যাসিফিক। কিন্তু এসব স্পন্সর কতো টাকা দিচ্ছে, সেই তথ্যও প্রকাশ করেনি লিগ কমিটি।

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট প্রিমিয়ার ডিভিশন ফুটবল লিগের সদস্যসচিব মিলাদ আহমদ জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের (ডিএফএ) সভাপতি ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাহি উদ্দিন আহমদ সেলিম দেশে না থাকাকে কারণ হিসেবে সামনে আনছেন।

মিলাদ সিলেটভিউকে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট (সেলিম) দেশে নাই, আমরা আসলে কিচ্ছু জানি না। তিনি না থাকায় আসলে গ্যাঞ্জাম হয়ে গেছে।’

দু-তিনদিনের মধ্যে সেলিম দেশে ফিরবেন এবং এরপর বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন মিলাদ আহমদ।

লিগ কমিটির সদস্যসচিব আরও জানান, লিগের গত আসরে ক্লাবগুলোকে অংশগ্রহণ ফি হিসেবে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। এবারও একটা ফি দেওয়া হতে পারে। তবে সব ঠিক হবে ডিএফএ সভাপতি দেশে আসার পর।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে