বিশ্বাস করো শংকর দা, গায়ের লোম এখনো কাঁটা দিয়ে উঠে। যুূদ্ধদিনের সেই দুর্দান্ত আর রক্ত হিমকরা জীবন, মারণাস্ত্র কিংবা শত্রুর সামনে বুক চিতিয়ে দেওয়ার গল্পগুলো যখন বলতে, তখন সেগুলোকে থ্রিলার সিনেমার চেয়েও বেশি কিছু মনে হতো। অনায়াসেই তুমি রাতের অন্ধকার ভেদ করেছো, পড়ন্ত বিকেলের লাল টুকটুকে সূর্যটাকে নিজের রক্তের রঙে রঙিন করেছো।

 


দিনের প্রখর রোদে জ্বলে উত্তাপ ছড়িয়েছো হাজারো তরুণের দেহে। বনে-বাদাড়ে, খোলা মাঠে তোমার স্টেনগান জ্বলসে উঠেছে একেবারে খেলনা অস্ত্রের মতোনই। তোমার তামাটে শরীর পুড়ে পুড়ে একেকটা বেয়োনেট হয়েছে, শত্রুমনে ভীতি ছড়িয়েছে।

 

তুমি ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সবুজ ভূখণ্ডটাকে বুকের পাঁজর দিয়েই আগলে রেখেছো। শত্রুবাহিনী খুবলে খেতে চেয়েছে তোমার প্রিয় স্বদেশকে, কিন্তু তুমি প্রাচীর হয়ে উঠেছো। ধূলিকণায় আড়াল হয়ে তুমি শত্রুর চোখ ফাঁকি দিয়েছো। তোমার শরীরে ক্ষতচিহ্ন এঁকেছে মারণাস্ত্র, তুমি তাতে একবারের জন্যও বিচ্যুত হওনি। অটল-অতন্দ্র প্রহরী হয়েছো আরো দুর্বার গতি নিয়ে, দুর্বীনিত হয়ে দাঁড়িয়েছো শত্রুর চোখ রাঙানী উপেক্ষা করে।

 

শংকর দা, রাতের পর রাত গল্প করেছি তোমার সাথে। কী সহজ করে কঠিন দিনগুলোকে তুলে ধরতে তুমি। আমি তখন শ্যামল সিলেটে। প্রতিরাতেই আমাদের দেখা হতো। তোমার শরীর লেপ্টে থাকতো একসেট রং উঠা উর্দির সাথে। "নাইটগার্ড" তুমি। হাতে টর্চলাইট আর বগলের নিচে লাঠি। দু'ঠোটের ফাঁকে জড়িয়ে থাকতো কর্কশ একটা হুইসেল। প্রহরী হয়ে চোর-ডাকাত তাড়াতে। ভীষণ কষ্ট হতো তোমার এরকম অবয়ব দেখে। শত্রু তাড়িয়েছো, আর এখন তাড়াচ্ছো চোর-ডাকাত।

 

কয়টামাত্র পয়সার জন্যই তো! তুমি হারোনি শংকর দা। একটা মানচিত্র এনে দেওয়া যোদ্ধা হারে না। হৃদয় থেকে হৃদয়ে তোমাদের ছড়িয়ে দেয়া সৌরভ জড়িয়ে থাকবে। যেখানেই লাল-সবুজের নিশান উড়বে, বলতে পারবো, এই পতাকা দিয়েছেন আমার শংকর দা।


স্যালুট শংকর দা, স্যালুট লড়াকু।

 

(উল্লেখ্য, এই বীর মুক্তিযোদ্ধা শনিবার রাতে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়েছে।

আমার সাথে গভীর এক বন্ধন ছিলো তার। কখনো বড়ভাই-ছোটভাই, কখনো বন্ধুর মতো। আমার বাড়ির পাশেই ছিটা গোটাটিকরে তাঁর বাড়ি।)

 

লেখক : উপ সম্পাদক, দৈনিক একাত্তরের কথা।