‘বাধা’ আসবেই, আগেই ধারণা করেছিলেন বিএনপি নেতারা। কিন্তু সেই ‘বাধা’ কিভাবে পেরোনো যাবে, এটাই ছিল তাদের চ্যালেঞ্জ। সঙ্গে ছিল ব্যাপক লোকসমাগম নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ। তবে ‘বাধা’ পেরিয়ে ‘সফল সমাবেশ’ করে সিলেট বিএনপিতে এখন চ্যালেঞ্জ জয়ের উচ্ছ্বাস। সুশৃঙ্খলভাবে সমাবেশ শেষ করতে পারায় দায়িত্বশীল নেতাদের মধ্যে আছে উৎফুল্লতা।

বিএনপি নেতারা বলছেন, যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাঁরা গণসমাবেশে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, সিলেটের মানুষ সেটা পূরণ করেছেন।


সিলেটে বিএনপির গণসমাবেশ ছিল গতকাল শনিবার (১৯ নভেম্বর)। নগরীর চৌহাট্টাস্থ আলিয়া মাদরাসা মাঠে এই গণসমাবেশের আয়োজন করা হয়। বিএনপির মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নেতারা সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।

বিএনপি এই গণসমাবেশ ২০ নভেম্বর, অর্থাৎ আজ রোববার করতে চেয়েছিল। তবে আজ এইচএসসি পরীক্ষা আছে এবং পুলিশ পরীক্ষার দিনে সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। ফলে একদিন এগিয়ে নেওয়া হয় সমাবেশ।

বিএনপি নেতারা জানান, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে চট্টগ্রাম থেকে বিএনপির গণসমাবেশ শুরু হয়। এ ছাড়া ময়মনসিংহ, ফরিদপুর (বিএনপির সাংগঠনিক বিভাগ), খুলনাসহ ছয়টি স্থানে গণসমাবেশ করে দলটি। এসব সমাবেশে পুলিশী বাধা ছাড়াও হামলা-মামলার শিকার হতে হয়েছে দলীয় নেতা-কর্মীকে। সঙ্গে সরকারের ‘মদদে’ ছিল পরিবহন ধর্মঘট।

কিন্তু বাধা পেরিয়ে সব জায়গাতেই সফলভাবে সমাবেশ করে বিএনপি এবং সেগুলোতে ব্যাপক লোকসমাগমও হয়।

অন্য জায়গায় যেহেতু প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে সফল সমাবেশ করা হয়েছে, সেহেতু সিলেটেও সেরকম করার অদৃশ্য চাপ ছিল এখানকার দায়িত্বশীল নেতাদের ওপর। ফলে বাধা আসবে ধরে নিয়েই সে কৌশলে কাজ করেছেন তারা।

বিএনপি সূত্র জানায়, সিলেটে পরিবহন ধর্মঘট যাতে না হয়, সেজন্য তারা চেষ্টা চালিয়েছেন। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সাথে কথা বলা হয়েছে কয়েক দফায়। তবে ‘উপরের চাপে’ গত বুধবার সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন বাস মালিক সমিতি বিএনপির সমাবেশের দিন তথা শনিবার ধর্মঘটের ডাক দেয়।

এ ছাড়া সিলেটজুড়ে ক্ষমতাসীনদের হামলা এবং পুলিশের হয়রানি ও মামলার অভিযোগও আছে বিএনপির। দলটির নেতারা জানান, সমাবেশের প্রচারণা চালানোর সময় সিলেটের ওসমানীনগরে বিএনপি নেতা ‘নিখোঁজ’ ইলিয়াস আলীর স্ত্রীর গাড়িতে হামলা হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা বাদী হয়ে বিএনপির ৩০০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেন। পুলিশ গ্রেফতার করে কয়েকজনকে। সিলেটের বিয়ানীবাজারে প্রচারণায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এ ঘটনায়ও বিএনপির ৫০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়, বাদী স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ কর্মী। হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে বিএনপির প্রচারণা সভায় বাধা দেয় পুলিশ। পরে শতাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। হবিগঞ্জের লাখাইয়ে বাধা দেয় পুলিশ, সেখানে হয় সংঘর্ষ। মৌলভীবাজারেও বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। এ ছাড়া সমাবেশের দিন সিলেটের বিভিন্ন প্রবেশপথে পুলিশ বাধার সৃষ্টি করে বলেও অভিযোগ আছে।

এদিকে, পরিবহন ধর্মঘট শুধু সিলেট জেলায় আটকে থাকেনি। বিভাগের অন্য তিন জেলাতেও ডাক দেওয়া হয় ধর্মঘটের। ফলে সমাবেশে নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি নিয়ে আরও চাপের মুখে পড়ে বিএনপি।

বিএনপির একাধিক নেতা জানান, বাধার বিষয়টি মাথায় রেখে কৌশল কী হতে পারে, তা নিয়ে আগেই ভেবে রেখেছিলেন তারা। ফলে ধর্মঘট আসার পরপরই সিলেটজুড়ে নেতা-কর্মীদের কাছে ‘বার্তা’ পৌঁছে যায়। সে কারণেই গত বৃহস্পতিবার থেকেই বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ভিড় জমে সমাবেশস্থল আলিয়া মাদরাসা মাঠে। বিশেষ করে আগের দিন, শুক্রবারে হাজারো নেতা-কর্মীর ঢল নামে সিলেটে। শুক্রবার রাতেই কানায় পূর্ণ পূর্ণ হয়ে যায় সমাবেশস্থল। যানবাহন না পেয়ে নৌকাযোগে, ট্রেনে, মোটরসাইকেলযোগে নেতা-কর্মীরা যোগ দেন।

অগ্রিম চলে আসা নেতা-কর্মীদের জন্য মাঠের মধ্যেই ‘ক্যাম্প’ বানিয়েছিল বিএনপি। সেখানেই তারা অবস্থান নেন। মাঠের মধ্যেই চলে রান্নাবান্না ও খাওয়ার কাজ। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি কমিউনিটি সেন্টারও ভাড়া করে বিএনপি। সেগুলোতে রাতযাপন করেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা।

সমাবেশের দিন, শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, সমাবেশস্থল আলিয়া মাদরাসা মাঠ ছাড়িয়ে জনসমাগম আশপাশের প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

বিএনপির দাবি, কয়েক লাখ মানুষের উপস্থিতিতে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সমাবেশ হয়েছে সিলেটে।

জানতে চাইলে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী সিলেটভিউকে বলেন, ‘এতো বাধা, এতো বিপত্তি উপেক্ষা করে লাখ লাখ মানুষ সমাবেশে উপস্থিত হয়েছিলেন। চ্যালেঞ্জ ছিল, সেই চ্যালেঞ্জ দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করেছেন বিএনপির প্রতিটি নেতা-কর্মী। কোনো বাধা, হামলা, মামলায় ভয় পাননি নেতা-কর্মীরা।’

তিনি বলেন, ‘বিএনপি যে জনগণের দাবি নিয়ে, গণমানুষের দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে, তা প্রমাণ করে দিয়েছেন সিলেটবাসী। আমরা গোটা সিলেটবাসীর কৃতজ্ঞ। আমরা যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাদেরকে সমাবেশে আহ্বান করেছিলাম, স্বতস্ফূর্তভাবে উপস্থিত হয়ে তারা তা পূরণ করেছেন। সিলেটবাসীকে আমাদের অভিভাবদন।’

কাইয়ুম চৌধুরী আরও বলেন, ‘গোটা সিলেটের প্রতিটা নেতা-কর্মী দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। বিএনপির পরিবারের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সমাবেশ হয়েছে।’

বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন সিলেটভিউকে বলেন, ‘আমাদের নেতা তারেক রহমানের নির্দেশনায় এবং জাতীয় স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তে আমরা গোটা দেশজুড়ে গণসমাবেশ করছি। দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহ ঊর্ধ্বগতি, ভোটাধিকার হরণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত, ওলামা মাশায়েখদের আটক, মিথ্যা মামলা, হয়রানি, হামলা এসবের প্রতিবাদে জনগণকে সম্পৃক্ত করে জনদাবি নিয়েই আমাদের আন্দোলন। ফলে গোটা দেশে সর্বস্তরের মানুষ বিএনপির আন্দোলনে একাত্ম হচ্ছেন। সিলেটেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘সমাবেশের আগে এক সপ্তাহ ধরে সরকারের বাধা-বিপত্তি ছিল। সরকারের চাপে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়। সিলেটজুড়ে ক্ষমতাসীনরা হামলা করেছে, মিথ্যা মামলা দিয়েছে, পুলিশ হয়রানি করেছে। কিন্তু বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে জনতার ঢল নেমেছিল আলিয়ার মাঠে।

সাখাওয়াত হাসান জীবন আরও বলেন, ‘বানিয়াচংয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা প্রচারণা শেষ করে একটি দোকানে বসে চা খাচ্ছিল। সেখানে গিয়ে হয়রানি করে পুলিশ। গ্রেফতার করা হয়। লাখাইয়ে, ওসমানীনগরে, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জে, মৌলভীবাজারে সবখানে বাধা এসেছে, পুলিশ হয়রানি করেছে। কিন্তু কোনো কিছুই সাধারণ মানুষ এবং বিএনপি নেতা-কর্মীদের দমিয়ে রাখতে পারেনি।’

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘সফল গণসমাবেশের মধ্য দিয়ে সিলেট বিভাগে বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি অনেক বেড়ে গেছে।’

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে