ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্থে এখনও টিকে আছে শত শত বছরের পুরোনো অনেক বিল্ডিং, স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের প্রতিটি দেশেরই রয়েছে এমন কিছু আইকনিক স্থাপনা, যা সেই জাতির ইতিহাসের অমূল্য রত্ন, ঐতিহ্যের স্মারক।

বাঙালি জাতির ভাষা, স্বাধীকার ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের স্বাক্ষি হিসেবে বাংলাদেশের ভেতরে যেমন রয়েছে অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন, তেমনি বহির্বিশ্বেও রয়েছে তেমনি কিছু স্থাপনা, যা দেশটির ইতিহাস ঐতিহ্যের স্বাক্ষি হিসেবে এখনও টিকে আছে স্বগৌরবে। প্রশ্ন হলো, ইতিহাসের এই অমূল্য নিদর্শনগুলোর স্বীকৃতি ও সংরক্ষনে রাষ্ট্র কি যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে, অন্তত বহির্বিশ্বের ঐ নিদর্শনগুলোর বিষয়ে?


পূর্ব লন্ডনের ঐতিহাসিক দিলচাঁদ রেষ্টুরেন্টের ৬০ বছরপূর্তীর অনুষ্ঠানে এসে বিলেতের বাংলা মিডিয়ার সাংবাদিকরা উপরোক্ত প্রশ্নটিই তুলেছেন।

৬০ বছরপূর্তী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন শফিকুর রহমান চৌধুরী। যুক্তরাজ্যের পূর্ব লন্ডনের ওয়াইডগেইট ষ্ট্রীটস্থ দিলচাঁদ রেষ্টুরেন্টে বিলেতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, পঞ্চাশের দশকে ব্রিটেনে আসা আব্দুল মতলিব চৌধুরী আজ থেকে ষাট বছর আগে যে রেষ্টুরেন্টটির যাত্রা শুরু করেছিলেন, তা বাঙালি জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু, দুনিয়া কাঁপানো জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিলেতে বাঙালী কমিউনিটির উত্তাণের স্মৃতিধন্য স্বাক্ষি হয়ে প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের দ্বারা সফলভাবে এখনও পরিচালিত হচ্ছে।

১/১১ এর সময় দেশে ফিরতে গিয়ে বাঁধার সম্মুখীন হওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিলচাঁদ-এ অনুষ্ঠিত তাঁর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করছেন।
 
১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত স্মৃতি জাগানিয়া এই রেষ্টুরেন্টটির ৬০ বছরপূর্তী উপলক্ষে মঙ্গলবার, ৬ই ডিসেম্বর স্থানীয় সাংবাদিকদের নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান পরিচালকরা আয়োজন করেন একটি ছোট্ট উদযাপন অনুষ্ঠান। প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্ম, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সাবেক সদস্য,  মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সিলেট জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনির সাবেক সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে কেক কেটে উদযাপিত হয় ‘দিলচাঁদ’ এর ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বাংলা মিডিয়ার স্থানীয় সাংবাদিকরা ছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, বিলেতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও কমিউনিটি উত্তান সময়কালীন বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের দুজন স্বক্রিয় কর্মী নুরুল হক লালা মিয়া ও সাবেক কাউন্সিলার আকিকুর রহমান।

সাংবাদিক আহাদ চৌধুরী বাবুর পরিচালনায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, কমনওয়েলথ জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশনের সহসভাপতি সৈয়দ নাহাস পাশা, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি ইমদাদুল হক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ, সত্যবাণী সম্পাদক সৈয়দ আনাস পাশা, ডেইলী স্টারের লন্ডন করেসপন্ডেন্ট আনসার আহমেদ উল্লা, সিনিয়র সাংবাদিক মতিয়ার চৌধুরী, হামিদ মোহাম্মদ, রহমত আলি, রানার টিভি’র আসম মাসুম, ওয়ানবাংলার জাকির হোসেন কয়েস, বাংলা টিভির একিউ চৌধুরী মুরাদ, সাংবাদিক শাহ শামীম, সারোয়ার কবির, সোয়েব কবির, আকরাম হোসেন, তানভির হাসান, মুস্তাক আলি বাবুল, খালেদ মাসুদ রনি এবং ‘দিলচাঁদ’ এর বর্তমান পরিচালকবৃন্দ ও প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম সদস্য সিলেটের অনলাইন গন মাধ্যম সিলেট ভিউয়ের উপ সম্পাদক মশিউর  রহমান চৌধুরী, মুহিবুর রহমান চৌধুরী তপু  ও মুস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী লিটন প্রমূখ।

একটি দেশের মুক্তি সংগ্রাম ও ভিন্ন একটি দেশে অবস্থানরত সেই সংগ্রামী মানুষগুলোর কমিউনিটি আন্দোলন ইতিহাসের কেন্দ্রে যে একটি রেষ্টুরেন্ট অবস্থান করে নিতে পারে ‘দিলচাঁদ’ ছাড়া এমন নজির মনে হয় কোথাও নেই। বাঙালির ৬ দফার স্বাধিকার আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ৭৫ পরবর্তী দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, বিলেতে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সাহসি রুখে দাঁড়ানো, কমিউনিটি উত্তাণের নায়ক তাসাদ্দুক আহমেদ এমবিই, গৌস খান- কোন ইতিহাস বুকে ধারন করেনি দিলচাঁদ? আর তাইতো ‘দিলচাঁদ’ কে বাঙালির ইতিহাসের অংশ, ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি তুলেছেন বিলেতে বাংলা মিডিয়ার সাংবাদিকরা।
 
‘দিলচাঁদ’ এর ৬০ বছরপূর্তী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে রেষ্টুরেন্টটির প্রতিষ্ঠাতা শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন,  জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাসহ বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক, সাংবাদিক এবং বিলেতের বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের শীর্ষনেতাদের পদস্পর্শে ধন্য আমাদের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘দিলচাঁদ‘। বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিলেতের কমিউনিটি আন্দোলনে দিলচাঁদ এর রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। আর একারনেই আমাদের তৃতীয় প্রজন্মও এখনও এই প্রতিষ্ঠানটি স্বগৌরবে চালিয়ে যাচ্ছে। শফিক চৌধুরী বলেন, লাভ-লোকসানের বিষয় নয়, একটি জাতির ইতিহাসের পরিপূর্ণতা এবং একটি  কমিউনিটির মূলধারায় নিজেদের সুদৃঢ় অবস্থান তৈরীর দীর্ঘ  বিরামহীন সংগ্রামের ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌছে দিতেই আমাদের পরিবার দিলচাঁদ কে বাচিয়ে রাখতে সচেষ্ট। দিলচাঁদ পরিবারের বর্তমান পরিচালক তৃতীয় প্রজন্মের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শফিক চৌধুরী বলেন, দেশের বাইরে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের অধিকাংশই শিকড় ভূমির ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়না। এদিক থেকে মতলিব চৌধুরী পরিবার ভাগ্যবান। আমাদের সন্তানরা যতটা না ব্যবসায়ী দৃষ্টিকোন থেকে, তাঁর চেয়ে বেশি শিকড় ইতিহাসকে গুরুত্ব দিয়ে দিলচাঁদ পরিচালনা করে যাচ্ছে। পরিবারের পক্ষ থেকে আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

তিনি বলেন, বিলেতে বাঙালি কমিউনিটির সর্ববৃহত পুরোনো সংগঠন ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের স্থায়ী ভবন ক্রয়ে জামানত হওয়া থেকে শুরু করে বিলেত-বাংলাদেশের আন্দোলন সংগ্রামে দিলচাঁদ যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, ঠিক তেমনি আমার আজকের অবস্থানের পেছনেও রয়েছে দিলচাঁদ এর ভূমিকা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর বঙ্গবন্ধুর বিলেত আগমন ও দিলচাঁদ এ মিটিং করা, ৭৫ পরবর্তী ও ১/১১ এর দুঃসময়ে দিলচাঁদে সংবাদ সম্মেলন করে বঙ্গবন্ধু কন্যাদের বিশ্বাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষন, ব্রিটেনে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের দিলচাঁদ  নেতাকর্মীদের আশ্রয়স্থলে পরিগনিত হওয়া, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ট্রাফালগার স্কোয়ারসহ লন্ডনের বিভিন্ন আন্দোলন স্পটে যাওয়ার আগে নেতাকর্মীদের দিলচাঁদে পরামর্শ করা, এমনসব ঘটনার ইতিহাস জেনে জেনে এবং কোন কোন ঘটনায় নিজের সম্পৃক্ততা থেকেই মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আমি সম্পৃক্ত হই। সেদিক থেকে বিচার করলে আমার বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়ার পেছনেও রয়েছে দিলচাঁদ এর ভূমিকা। আজকের এই দিনে দিলচাঁদ এর প্রতি তাই আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা।


সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডি.আর