খুব বেশীদিন আগের কথা নয়। মাত্র আট-ন’টি মাস। ছিল একটি সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা ভ‚খন্ড। অথচ আজ সেখানে অনবরত ঘটে চলেছে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ আর ধ্বংসলীলা। তৈরি হচ্ছে নিত্য-নুতন বধ্যভূমি। অনেকের মত দুর্জয়দেরও ছিল একটি ছোট্ট গোছনো সংসার, একটি শান্তির নীড়। পরিবারে সদস্যও খুব বেশি নয়, মা আর দুই ভাইবোন মিলে মাত্র তিন জনের একটি পরিবার।

সে তখন স্থানীয় একটি স্কুলের দশম শ্রেণির একজন মেধাবী ছাত্র। হঠাৎই নেমে এলো এক মহাবিপর্যয়। শুধু তাদের জন্য নয়, সমগ্র দেশজুড়ে। শুরু হলো মানব ইতিহাসের জঘন্য এক হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ, যা এখনও চলছে অবিরাম গতিতে। দিনে-দিনে প্রচণ্ড থেকে প্রচণ্ডতর হচ্ছে ধ্বংসের মাত্রা। তবে বিশ্বে কোন মুক্তিযুদ্ধ বিফল হয় না। স্বাধিকার আন্দোলনে সাফল্য আর বিজয় অবশ্যম্ভাবী।  এযুদ্ধও এগোচ্ছে সেই পথ ধরে,  হয়ত আর বেশিদিন বাকী নেই চূড়ান্ত বিজয়ের। কারন ইতোমধ্যে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে দিশেহারা হয়ে ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেয়া হানাদারের দল পালাতে শুরু করেছে।


সারা দেশজুড়ে দীর্ঘ ন’টি মাস ধরে ওরা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নির্বিচারে হত্যা করেছে দেশের অসংখ্য নিরীহ আর নিরস্ত্র মানুষকে। কিন্ত কি আশ্চর্য! যখন সত্যিকারের যুদ্ধ শুরু হলো, তখন আর লড়াই করার মত সাহস পেলো না ঐসব কাপুরুষের দল। পরাজিত হয়ে অধিকাংশই পালাতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর বন্দুকের খোরাক হয়ে লাশ হয়ে পড়ে থাকছে এখানে-ওখানে।

উনিশ শ’ একাত্তর সনের ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধের একটি দিন। একটি রক্তক্ষয়ী অপারেশন শেষ হলো মাত্র কয়েকঘন্টা আগে। একটু নিরিবিলি জায়গায় বিশ্রামের প্রত্যাশায় বসে পড়ল দুর্জয়। রাস্তার ধারের পুরোনো বটগাছটির ছায়ায় হাতের স্টেনগান নামিয়ে রেখে দুর্জয় ভাবতে বসে। যুদ্ধের যে পরিস্থিতি তাতে বুঝা যায় বিজয় আসন্ন। কিন্তু কেন ওরা তাদের ওপর এরকম একটি অনাহুত যুদ্ধ চাপিয়ে দিল? কেন নিরীহ বেসামরিক মানুষ হত্যা করে সারা দেশটাকে পরিণত করল একটি বধ্যভূমিতে? একজন যোদ্ধার পক্ষে শুধুমাত্র প্রতিপক্ষের আরেক যোদ্ধাই আক্রমণযোগ্য, কোন বেসামরিক লোক হত্যা সমর নীতির বহির্ভূত। সৈনিক হতে গিয়ে কি এ শিক্ষা ওরা পায়নি?

বেশ ভালই চলছিল দুর্জয়ের দিনগুলো। আজ অনেকদিন হয় পিতৃহারা হলেও স্নেহময়ী মা তাকে আঁচল দিয়ে এমনভাবে বড় করেছিলেন যে পিতার অভাব সে বুঝতেই পারেনি। আজ সে দশম শ্রেণির ছাত্র। সবকিছু ঠিকমত চললে এতদিনে মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হতো। তার দুখিনী মায়ের শূন্য খাঁচাটিরও একটি কোণ পূর্ণ হত। আর সেই ছোট বোন মুক্তি! মনে পড়ে, বৃত্তির সামান্য টাকায় কেনা স্নেহসিক্ত মহামূল্যবান উপহারটি হাতে পেয়ে নাচতে নাচতে তার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ঐতো সেদিনের কথা। তার সাথে নববর্ষের মেলায় যাবে বলে বায়না ধরে। দূর্জয় তাকে বুঝাতে চেষ্টা করে যে, সেখানে পাকিস্তানি মিলিটারি আছে, ওখানে গেলে গুলি করে মেরে ফেলবে। তখন সেদিনের সেই অবোধ শিশুটি উত্তরে বলেছিল যে, আমরা যদি ওদের বুঝিয়ে বলি যে, আমাদের কোন দোষ নেই তখন কি ওরা বুঝবে না? তখনো কি সে জানত, যে ওরা তার কথা সত্যিই বুঝবে না ? একদিন ওদেরই বুলেট ওর কচি শরীরটা বিদীর্ণ হবে? ভাবতে ভাবতে তার চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়া কয়েক বিন্দু অশ্রু বটতলার বালি শোষন করে নেয়।

এপ্রিল মাসের একটি দিনের কথা। ততদিনে অসহযোগ আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক, পাক বাহিনির ক্র্যাক-ডাউন সবকিছু মিলিয়ে দুর্জয়দের স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মা তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন বাজার থেকে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনে আনতে। ইতোমধ্যে তাদের থানার ছোট্ট শহরটি পাকবাহিনীর পুরো নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।

আনমনে ভাবতে ভাবতে এক সময় সে বাজারে এসে উপস্থিত হয়। সেখানকার সবচেয়ে বড় রসিক সাহার মনোহারি দোকানটি তার দীর্ঘদিনের পরিচিত। তার পিতাই তাকে পরিচিত করে দিয়েছিলেন। অনেকবার সে নিজেও ঐ দোকানটি থেকে কেনাকাটা করেছে। হাঁটতে হাঁটতে চকিতেই সে সেই দোকানটির সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। অবাক-বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে কিছু সংখ্যক সশস্ত্র লোক দোকানটিতে নির্বিচারে লুটতরাজ চালাচ্ছে। আরও আশ্চর্ষ হয়ে দেখতে পায়, তারই স্কুলের এক সিনিয়র শিক্ষক স্বয়ং লুটপাটে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার সঙ্গে আরও একজন জুনিয়র শিক্ষক। শিক্ষক সাহেব নিজে দাঁড়িয়ে লুটপাটকারীদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। দুর্জয় ভাবে, পরম শিক্ষাগুরু আজ একি অভিযানে অবতীর্ণ হলেন! এতদিন ক্লাসে স্যারের মুখে যেসব নীতিকথা শুনে এসেছে তার সবই কি মিথ্যে, শুধুমাত্র কথার কথা! বাস্তব জীবনে এর বিন্দুমাত্র মূল্য নেই? পাশের অপর একটি দোকান থেকে জরুরি কেনাকাটা শেষ করে নিতান্ত বিষন্ন মনে দুর্জয় বাড়ি ফিরে আসে।

অতি দ্রুত একের পর এক দেশজুড়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে চলছে। রাজধানী ছেড়ে পাকবাহিনী দেশজুড়ে বিস্তৃত হয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে, যে পালাতে না পারছে ঠায় মারা পড়ছে। এমনি দুঃসময়ে একদিন মা ডেকে বললেন একমাত্র নিকটাত্মীয় মামার বাড়ির খোঁজ নিতে। তাদের সাথে পরামর্শ করতে যে, কি করে প্রাণ ও মান-সম্মান রক্ষা হবে। পরদিন সকালে দুর্জয় মামার বাড়ির উদ্যেশে রওয়ানা হয়। ওখানে গিয়ে মামার সাথে জরুরি আলোচনা শেষ করে বাড়ি ফিরতে চাইলেও মামা-মামীর অনুরোধে রাত্রিযাপন করে।

পরদিন বাড়ি ফিরে আসতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। কিন্ত বাড়ি থেকে খানিকটা দূর থেকে তাদের গ্রামটি চোখে পড়তেই তার বুকটা কেঁপে উঠে। ছোট্ট সবুজ শ্যামল ছায়াঘেরা তার প্রিয় গ্রামটিকে যেন চেনাই যায় না। কোন এক অনাহুতপ্রলয় এসে মাত্র একরাতের ব্যবধানে যেন সবকিছু ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে সে দৌড়ে এগিয়ে চলে। কাছে এসে দেখতে পায় এ যেন তার চিরপরিচিত জন্মভুমি নয়, এক ভস্বাচ্ছাদিত জন-মানবশুন্য বাড়ি-ঘর মাত্র। গাছের সবুজশাখাগুলো পর্যন্ত আগুনে ঝলসে গেছে। রুদ্ধশ্বাসে দৌঁড়ে তার নিজের বাড়িতে হাজির হয়। বাড়ির দৃশ্য দেখে তার চক্ষুস্থির, হৃৎপিন্ড থেমে যাবার উপক্রম। মা আর বোনের কথা চিন্তা করে প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়ে যায় সে। স¤ি¦ত ফিরে এলে চিৎকার করে মা আর বোনকে ডাকে। কোথাও কোন সাড়া না পেয়ে এদিক ওদিক আরও দূরে খুঁজতে থাকে। হঠাৎ বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড়ের তলায় বুলেটের আঘাতে রক্তাক্ত অবস্থায় গলাগলি পরে থাকা অবস্থায় মা ও বোনের নিথর দেহ দু’টি দেখতে পায়। হাউমাউ করে দুর্জয় লাশ দু’টি ধরে কাঁদে। তার দু’চোখ বেয়ে শ্রাবণের ধারা বয়ে যায়। অনেকক্ষণ পর ওপাড়ার সহপাঠী বিপ্লবের সাথে তার দেখা হয়। কোনমতে সে পালিয়ে বেঁচেছে। সে জানায় আজ সকালেই পাঞ্জাবী মেজর কিসলু খানের নেতৃত্বে পাকবাহিনীর একটি দল তাদের গ্রামে হামলা চালায়। নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করে। মা-বোনদের নির্যাতন করে এবং ফেরার সময় সারাগ্রাম জ্বালিয়ে দেয়।

দুর্জয় আজ মুক্তিযোদ্ধা। হানাদার পাকবাহিনীকে নিধন করাই আজ তার নেশা ও পেশা। গেরিলা ট্রেনিং শেষ করে প্রথমেই ফিরে গিয়েছিল তার নিজ গ্রামে। প্রতিজ্ঞা করেছিল, প্রথম অপারেশনেই সে মা ও বোনের হত্যাকারী মেজর কিসলুকে দুনিয়া ছাড়া করবে। গোপনে খোঁজ নেয় থানায় মেজর কিসলুর অবস্থান ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার। সুযোগের সন্ধানে সে অপেক্ষায় থাকে। একদিন এসেও যায় সেই প্রত্যাশিত সুযোগ। সেদিন থানায় ছিল অপেক্ষাকৃত কম নিরাপত্তার ব্যবস্থা। কয়েকজন সহযোদ্ধা মিলে গভীর রাতে হামলা চালায় থানায়। তাদের উপস্থিতি টের পেয়েই পাহারাদার খান সেনাদুটি চিৎকার দেয়। কিন্তু তাদের চকিত আক্রমণে ওরা লুটিয়ে পড়ে। আরও দু’একজন অপ্রস্তুত পাক সেনা প্রতিরোধে এগিয়ে এলেও দুর্জয়দের আকস্মিক আক্রমণে তারাও টিকতে পারেনি। মেজর কিসলু তখন মদ-মেয়েমানুষ নিয়ে নেশায় চুর। দুর্জয়ের উদ্যত স্টেনগান দেখে পলকের জন্য তার নিজের হাতিয়ারের দিকে হাত বাড়ায়। ততক্ষনে এক ঝাঁক বুলেট এসে ঝাঝরা করে দেয় মেজর কিসলুর চওড়া বুক।

তারপর দুর্জয় রাতের পর রাত জেগেছে। আক্রমণের পর আক্রমণ চালিয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে কখনও বিন্দুমাত্র ক্লান্তি আসেনি। সমস্ত শক্তি দিয়ে দিনের পর দিন লড়াই করে চলেছে। প্রতিহিংসায় উন্মত্ত হয়ে লড়ছে। যেভাবে মুক্তি ও মিত্র বাহিনির নিকট পাকবাহিনী মার খাচ্ছে, তাতে বড়জোর এক সপ্তাহ লাগবে চুড়ান্ত বিজয় অর্জনে। দেশে আসবে পূর্ণ স্বাধীনতা। বাংলার জনগণ পাবে পরিপূর্ণ মুক্তি।

কিন্তু কোথায় দুর্জয়ের মুক্তি? তার অতি আদরের বেণী-দুলানো ছোট বোন মুক্তি? দেশকে দানবের কবল থেকে মুক্ত করতে তারা  প্রায় সফল হতে যাচ্ছে। কিন্তু তার হাতের এই স্টেনগান কি ফিরিয়ে আনতে পারবে তার স্নেহময়ী জননীকে? তার প্রিয় বোন মুক্তিকে?

লেখক: অধ্যাপক, সেচ ও পানি ব্যবস্তাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।