স্ত্রী আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সাথে অভিমান করে ৪৮ বছর আগে দেশ ছেড়ে ভারত চলে গিয়েছিলেন আমজাদ আলী। এরপর জীবনের নানা বাঁক পেরিয়ে থিতু হন আসামের তেজপুরে। সংসারও পাতেন সেখানে। দুই ছেলে, দুই মেয়ে আর নাতী-নাতনী নিয়ে চলছে জীবন।

কিন্তু ভারতে আবাস গড়লেও মন পড়ে থাকে বাংলাদেশের ময়মনসিংহের তারাকান্দায় ফেলে আসা স্ত্রী হাজেরা খাতুন আর ৬ মাস বয়সী ছেলে কালা মিয়ার কাছে। কিন্তু দেশান্তরি আমজাদের তখন আর দেশে ফেরার সুযোগ-সামর্থ্য নেই। কেউ খোঁজও দিতে পারেনি স্ত্রী ও ছেলের। কিন্তু আমজাদের বিশ্বাস ছিল- একদিন তিনি ঠিকই ফিরে পাবেন হারিয়ে ফেলা স্ত্রী ও ছেলেকে। শেষ পর্যন্ত ৪৮ বছর পর অনেকটা অলৌকিকভাবে ছেলে কালা মিয়াকে ফিরে পেয়েছেন তিনি। কিন্তু ছেলেকে পেলেও স্ত্রী হাজেরার সাথে দেখা হয়নি। পাচারের শিকার হয়ে স্ত্রী এখন পাকিস্তানে। মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো স্ত্রী হাজেরাকে দেখে মান ভাঙাতে চান আমজাদ, এটাই এখন তার শেষ চাওয়া। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস- ছেলের মতো স্ত্রীকেও একদিন তিনি ফিরে পাবেন।


১০১ বছর বয়সী আমজাদ আলীর সাথে দেখা হয় তার ছেলে কালা মিয়ার বাসায়। অটোরিকশা চালক কালা মিয়া থাকেন সিলেট নগরীর বাগবাড়ি মদিনা আবাসিক এলাকায়। আমজাদ জানালেন, শ্বশুরবাড়ির লোকজন ও স্ত্রীর উপর অভিমান করে ৬ মাস বয়সী ছেলেকে রেখে তিনি চলে যান ভারতের আসামে। আসামের তেজপুরে দিনমজুরের কাজ করতেন তিনি। প্রচন্ড অভিমানী আমজাদের মন স্ত্রী ও ছেলের জন্য কাঁদলেও জেদ ধরে থেকে যান সেখানে। একসময় একই এলাকার তরুণী সমরজান বিবিকে ভালোবেসে ফেলেন তিনি। প্রেম গড়ায় পরিণয়ে। প্রায় ১৫ বছর আগে মারা গেছেন সমরজান। ওই স্ত্রীর গর্ভে আমজাদের দুই ছেলে দুই মেয়ে। 

আমজাদ জানান, ময়মনসিংহে ফেলে যাওয়া স্ত্রী ও ছেলের জন্য তার মন কাঁদতো। অনেক রাত কেঁদে কেটে কাটিয়েছেন। কিন্তু তাদের কোন সন্ধান পাননি। বাংলাদেশের কাউকে পেলে ময়মনসিংহের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে সন্ধান চাইতেন। কিন্তু কেউই খোঁজ দিতে পারেনি। স্ত্রী ও সন্তানের খোঁজে গত ৫ জানুয়ারি সিলেটের তামাবিল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন আমজাদ। ময়মনসিংহ গিয়ে খোঁজে পান পুরনো কিছু আত্মীয়-স্বজনের। তারা সন্ধান দেন ছেলে কালা মিয়ার। ফোনে কথা হয় বাপ-ছেলের। পরিবারের সবাইকে নিয়ে পরদিনই কালা মিয়া ছুটে যান ময়মনসিংহে। নিয়ে আসেন বাবাকে। আমজাদ আলীকে ঘিরে কালা মিয়ার পরিবারে এখন ঈদের খুশি। কালা মিয়া জানান, বাবাকে ফিরে পাওয়ার পর ভিডিও কলে ভারতে থাকা তার সৎ ভাই-বোনদের সাথে কথা হয়েছে। তারা সেখানে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করছে। তাদের দেখতে যাওয়ার জন্য তিনি পাসপোর্ট তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কালা মিয়া জানান, জন্মের ৬ মাস পরই বাবা অভিমান করে চলে যান ভারত। ৮ বছর বয়সে পাচারকারী দলের কবলে পড়েন তার মা। ভারত হয়ে মায়ের আশ্রয় হয় পাকিস্তানে। এসব কিছুর জন্য তিনি দায়ি করতেন বাবাকে। বাবার প্রতি তার প্রচন্ড অভিমান ছিল। কিন্তু কাছে পেয়ে বাবার প্রতি সকল অভিমান ভুলে গেছেন। এখন রাতে তিনি বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমান। 

কালা মিয়া জানান, তার বয়স যখন ১৮-২০ বছর, তখন মা হাজেরা খাতুন পাকিস্তান থেকে চিঠি লিখেছিলেন। জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানের করাচি থাকেন তিনি। এরপর আরও কয়েকবার চিঠি এসেছিল। কিন্তু যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন থাকেনি। এখন আর মায়ের সাথে তার কোন যোগাযোগ নেই। তবে ৪৮ বছর বয়সী বাবাকে ফিরে পাওয়ায় তিনি আশাবাদী একদিন মাকেও ফিরে পাবেন। 

কালা মিয়ার স্ত্রী আকলিমা বেগমও শ্বশুরকে ফিরে পেয়ে দারুণ খুশি। বাবা-মা হারা আকলিমা মনে করেন আমজাদ আলীই তার বাবা। আর একদিন শ্বাশুড়ি ফিরে এসে তার মায়ের অভাব পূরণ করে দেবেন, এমন আশায় বুক বেঁধেছেন আকলিমা।

আমজাদের বড় নাতী সুজন মিয়া পেশায় সিএনজি অটোরিকশা চালক। গাড়ি চালানো বাদ দিয়ে এখন ব্যস্ত দাদার সেবায়। নিজের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করতে গিয়ে সুজন বলেন, ‘আমার বাবা ছোটবেলা কাউকে বাবা ডাকতে পারেননি। আমি সেই কষ্টটা অনুধাবন করতে পারছি। এখন আমার বাবা তার বাবাকে খুঁজে পেয়েছেন। এর চেয়ে বড় আনন্দের কিছু নেই। দাদাকে দেখতে পাওয়াটা আমাদের পরিবারের কাছে রীতিমতো অবিশ্বাস্য।’
ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি ভারত ফিরে যাবেন আমজাদ মিয়া। তবে খুব দ্রুতই তিনি আবারও ফিরবেন ছেলে ও তার পরিবারের কাছে।  


সিলেটভিউ২৪ডটকম / শাদিআচৌ / ডি.আর