সময়মতো কমিটি না হওয়া, মহামারি কোভিড-১৯, রাজনৈতিক মামলা আর অন্তর্দ্বন্দ্বে টানা কয়েক বছর নিষ্প্রভ ছিলো সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপি। তবে গত বছরের মার্চে জেলা বিএনপিতে নতুন নেতৃত্ব আসার পর থেকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন সিলেটের নেতাকর্মীরা। রাজনৈতিক মামলাগুলোর চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে ও নিজেদের মনোমালিন্য অনেকটা আড়াল করে তারা প্রায় এক বছর ধরে সিলেটের রাজপথ নিয়মিত উত্তাল করছেন। আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি মাঠ ছেড়ে না দিয়ে কেন্দ্রনির্দেশিত ছাড়াও জেলা এবং মহানগর ঘোষিত নানা কর্মসূচি পালনেও নেতাকর্মীরা স্বাতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছেন।

তবে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের বক্তব্য- জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি ও মহানগরের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হলে আন্দোলন-কর্মসূচি আরও বেগবান হতো। নেতাকর্মীরা চাঙা হতেন শতভাগ।


সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে- নেতাকর্মীদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হতে যাচ্ছে শীঘ্রই। আগামী মাসের (ফেব্রুয়ারি) ১০ তারিখের মধ্যে কাউন্সিল করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মহানগরের আহ্বায়ক কমিটিকে। আর জেলা শাখার পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা হাই কমান্ডের কাছে প্রেরণ করার পর ইতোমধ্যে ‘চূড়ান্ত’ হয়ে গেছে। এখন কেবল অনুমোদনের অপেক্ষায়। খুব শীঘ্রই তা দেওয়া হবে।

জেলা বিএনপি:
প্রায় ছয় বছর পর গত বছরের ২৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় সিলেট জেলা বিএনপির কাউন্সিল। এতে কাউন্সিলরদের গোপন ভোটে আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী সভাপতি ও ইমরান আহমদ চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ ছাড়া সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন মো. শামিম আহমদ।

এর আগে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিলেট জেলা বিএনপির কাউন্সিল হয়েছিলো। এতে আবুল কাহের চৌধুরী শামীম সভাপতি ও আলী আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয় আহ্বায়ক কমিটি। কামরুল হুদা জায়গীরদারকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তিন মাসের সেই কমিটি পার করে প্রায় আড়াই বছর। সব অচলাবস্থা কাটিয়ে অবশেষে ২০২২ সালের ২৯ মার্চ জেলা বিএনপি পায় নতুন নেতৃত্ব।

জেলা কমিটিতে নতুন নেতৃত্ব আসার পরই যেন প্রাণ ফিরে পান নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন- এ ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় অবদান রাখেন জেলার নেতৃত্বে আসা আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী। জেলা বিএনপির সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বেছে নেন সুক্ষ্ম সব কৌশল। এতে দলের নেতাকর্মীদের চাঙা করার পাশাপাশি মাঠের রাজনীতিতেও প্রতিপক্ষ দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে অনেক সময় ছুঁড়ে দেন মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ।

ঐক্যবদ্ধ হয়ে নেতাকর্মীদের আন্দোলনমুখী করার পাশাপাশি জেলার নতুন নেতৃত্ব শুরু করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া। কিন্তু স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় কমিটি এ কার্যক্রম থমকে যায়। এরপর শুরু হয় বন্যায় দুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো, ত্রাণ সহায়তা ও পুনর্বাসন তৎপরতা। এসব কর্মসূচিতে বিএনপির মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে সম্পৃক্ত করে জেলা বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে যান জেলা বিএনপির নির্বাচিত শীর্ষ তিন নেতা। সিলেটে ৩ দফা বন্যার ধকল কাটানোর পর ফের শুরু হয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন প্রক্রিয়া। গঠন করা হয় জেলার অধীনস্থ উপজেলা, পৌর ও ইউনয়ন কমিটিগুলো।

এদিকে, জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান পেতে হাই কমান্ডের সুনজরে আসার জন্য ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় নিজেদের সমর্থকদের নিয়ে দলীয় চলমান সব কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন পদপ্রত্যাশী নেতারা। পাশাপাশি নিজের অবস্থান মজবুত করতে চালিয়ে যাচ্ছেন জোর লবিং।

সিলেট জেলা বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যান দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ত্যাগী, পরীক্ষিত ও রাজপথে সক্রিয় নেতাদের নিয়ে প্রবীণ-নবীনদের সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেন। এর প্রেক্ষিতে তালিকা করে ইতোমধ্যে জমা দেওয়া হয়েছে।

দলীয় একটি সূত্র বলছে- জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা লন্ডনে থাকা তারেক রহমানের কাছে পাঠানো হয়েছে। তিনি তালিকাটি যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করে ফেলেছেন ইতোমধ্যে।

সার্বিক বিষয়ে জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী সিলেটভিউ-কে বলেন- কাউন্সিলের পরপরই পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু ভয়াবহ বন্যার কারণে তা ব্যাহত হয়। বন্যার পরপরই নিয়মিত সব কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়। কিছুদিন আগে সেই তালিকা শীর্ষ পর্যায়ে দেওয়া হয়েছে এবং সেটি চূড়ান্তও হয়ে গেছে। অতি শীঘ্রই পূর্ণাঙ্গ তালিকা অনুমোদন দেওয়া হবে।

উল্লেখ্য, গত বছর অনুষ্ঠিত জেলা বিএনপির কাউন্সিলে সভাপতি পদে বিজয়ী আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী ৮৬৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আবুল কাহের চৌধুরী পান ৬৭৫ ভোট। সাধারণ সম্পাদক পদে ইমরান আহমদ ৭৯৮ ভোট পেয়ে হন বিজয়ী। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আলী আহমদ পান ৫৭৩ ভোট। সাংগঠনিক সম্পাদক পদে মো. শামিম আহমদ ৬২৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মুজিবুর রহমান পেয়েছিলেন ৪৬৪ ভোট। কাউন্সিলে মোট ভোটার (কাউন্সিলর) ছিলেন ১ হাজার ৮১৮ জন। এর মধ্যে ভোট পড়ে ১ হাজার ৭২৬টি।

মহানগর বিএনপি :
সিলেট মহানগর বিএনপির পুরাতন কমিটি ভেঙে ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এতে আহ্বায়ক করা হয় বিএনপি নেতা আব্দুল কাইয়ূম জালালী পংকীকে। আর সদস্য সচিব হন মিফতাহ্‌ সিদ্দিকী। ৩৫ সদস্যের কমিটিতে রাখা হয় ১৩ জন যুগ্ম আহ্বায়ক। আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর অনেকটা সরবে কাজ শুরু করেন মহানগরের নেতৃবৃন্দ। তবে পরপর তিন দফা বন্যার কারণে সাংগঠনিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। এছাড়াও অন্তর্দ্বন্দ্বে মহানগরের ওয়ার্ড কমিটি গঠনে ধীর গতি লক্ষ্য করা যায়।

এই দ্বন্দ্ব মেটাতে হস্তক্ষেপ করতে হয় দলের হাইকমান্ডকে। দুই মাস আগে মহানগর নেতাদের ঢাকায় ডেকে নিয়ে বৈঠক করা হয়। দেওয়া হয় কমিটি গঠনের সময়সীমাও। হাইকমান্ডের সঙ্গে বৈঠক শেষে সিলেটে ফিরে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন মহানগর নেতারা।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, আগামী ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মহানগর কমিটির কাউন্সিল করার কড়া নির্দেশ দিয়েছে হাই কমান্ড।

মহানগর বিএনপি সূত্র জানায়, শীর্ষের নির্দেশের পর গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে সিলেট নগরের পুরাতন ২৭টি ওয়ার্ডে পাড়া কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রতিটি পাড়ায় ১১ জনকে নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়। এসব পাড়া কমিটির নেতারা ছিলেন ওয়ার্ডের ভোটার। পাড়া কমিটি শেষ হওয়ার পর ওয়ার্ড কমিটির সম্মেলন ও কাউন্সিলের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ পর্যন্ত ২৭টির মধ্যে ১৪ ও ২০ নং ওয়ার্ড ছাড়া বাকি সব ওয়ার্ডে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করে নতুন কমিটি (আংশিক) গঠন করে দেওয়া হয়েছে। ১৪ ও ২০ নং ওয়ার্ডে এভাবে কমিটি গঠনের পর শুরু হবে ২৭টি ওয়ার্ডে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন প্রক্রিয়া।

সিলেট মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুল কাইয়ূম জালালী পংকী সিলেটভিউ-কে বলেন- সিলেট মহানগর বিএনপিকে তৃণমূল থেকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। চলমান ওয়ার্ড কমিটির সম্মেলন ও কাউন্সিল নিয়ে পাড়াভিত্তিক নেতারাও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। যার ফলে সিলেট মহানগর বিএনপি এখন অনেক শক্তিশালী। এখন প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে নেতাকর্মীরা মিছিল সহকারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দলীয় সকল কর্মসূচিতে যোগ দেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখের মধ্যে করতেই হবে- এমন সময়সীমা আসলে বেঁধে দেওয়া হয়নি। তবে শীঘ্রই কাউন্সিল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরপরও মাস-দেড় মাস সময় লেগে যেতে পারে। কারণ- ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৫টির আংশিক করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাকি রয়েছে দুটি। এগুলো করতে হবে। এরপর সব ওয়ার্ডে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে হবে।  সব মিলিয়ে ফেব্রুয়ারি মাস চলে যেতে পারে। তবে সব ওয়ার্ড কমিটি গঠনের পর যত দ্রুত সম্ভব মহানগরের কাউন্সিল হয়ে যাবে বলে আশা করছি।

আসন্ন কাউন্নিলে সভাপতি পদে নিজের প্রার্থিতার বিষয়টি নিশ্চিত করে আব্দুল কাইয়ূম জালালী পংকী সিলেটভিউ-কে বলেন- সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আমি সভাপতি পদে প্রার্থী হবো। কাউন্সিলররা যদি তাদের বান্ধব মনে করেন তবে আমাকে ভোট দিয়ে জয়ী করবেন। তবে বিজয়ী হই আর না হই, প্রার্থী হই আর না হাই- দলের জন্য একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হয়ে আমরণ কাজ করে যাবো।

এদিকে, আগামী কাউন্সিলে মহানগর বিএনপির শীর্ষ দুই পদের মধ্যে সভাপতি পদে ৪ ও সাধারণ সম্পাদক পদে ৩ জন লড়াই করবেন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।

সভাপতি পদে মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নাসিম হোসাইন, বর্তমান আহ্বায়ক আব্দুল কাইয়ূম জালালী পংকী, মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম ও বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব মিফতাহ সিদ্দিকী প্রার্থী হবেন।

আর সাধারণ সম্পাদক পদে মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সিসিক কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, যুগ্ম আহ্বায়ক ও কাউন্সিলর ফরহাদ চৌধুরী শামীম এবং যুগ্ম আহ্বায়ক এমদাদ হোসেন চৌধুরী লড়াই করবেন বলে জানা গেছে।


সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডালিম