শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টা। সিলেট মহানগরের সেলফি ব্রিজ খ্যাত কাজিরবাজার সেতুর ফুটপাত দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন জসিম উদ্দিন নামের এক কলেজছাত্র। পাশ দিয়ে হঠাৎ বিকট শব্দে সাঁ করে চলে গেলো একটি মোটরসাইকেল। চোখের পলকে হারিয়ে গেলো দৃষ্টির আড়ালে। কিন্তু ‘বধির’ করে দিয়ে গেলো জসিমকে।

এসময় তার মনে হয়েছিলো- পুরো পৃথিবীই যেন শব্দহীন। প্রায় ২ মিনিট পর ফিরে আসে জসিমের স্বাভাবিক শ্রবণশক্তি।


শুধু যানবাহনেরই মাত্রাতিরিক্ত শব্দ নয়, পিকনিকের নামে ট্রাকে উচ্চশব্দের মাইক বাজিয়ে রাস্তায় চলাচল, কনসার্টের নামে পাড়া-মহল্লায় লাউড স্পিকারে গভীর রাত অবধি শব্দসন্ত্রাস, খেলাসহ বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে গভীর রাতেও ক্ষতিকারক উচ্চশব্দের ভুভুজেলা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়া ও সাইলেন্সার খুলে বিকট শব্দে সড়ক কাঁপিয়ে মোটরসাইকেল চালানোসহ নানাভাবে শব্দদূষণের মধ্য দিয়ে শুক্রবার (৩ মার্চ) সিলেটে কাটছে ‘বিশ্ব শ্রবণ দিবস’।

এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘সবার জন্য কানের ও শোনার যত্ন’। শব্দদূষণের মাত্রা স্থানভেদে কেমন হবে তার নির্দেশনা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাদের হিসাব অনুযায়ী- কোনো এলাকায় ৬০ ডেসিবেল মাত্রার বেশি শব্দ হলে তা দূষণের পর্যায়ে পড়বে। শব্দদূষণের গুরুত্ব বিবেচনায় ১৯৯৭ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে পরিবেশগতভাবে বিভিন্ন এলাকাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে; নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, শিল্প এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকা। এসব এলাকায় দিন ও রাতভেদে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শব্দদূষণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু এসবের কোনো কার্যকারিতা নেই।

নীতিমালা অনুযায়ী- অফিসকক্ষ ও শ্রেণিকক্ষে শব্দের মাত্রা হবে ৩০-৪০ ডেসিবেল, হাসপাতাল এলাকায় ২০-৩৫ ডেসিবেল, রেস্তোরাঁয় ৪০-৬০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা সহনীয়। ৬০ ডেসিবেলের বেশি শব্দে মানুষের সাময়িক শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে এবং ১০০ ডেসিবেল শব্দে মানুষ চিরতরে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে।

কিন্তু সিলেটে এ নিয়ম মানার বালাই নেই। শব্দদূষণ রোধে সিলেটে মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন মহাসড়কে যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন খুলে নেওয়ার পাশাপাশি চালকদের জরিমানা করে ট্রাফিক পুলিশ, এই পর্যন্তই। এর বাইরে আর কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে যেখা যায়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।

জানা গেছে, সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্স’র উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের রাজপথে শব্দদূষণ এবং শব্দদূষণের কারণে রাজপথে কর্মরত পেশাজীবীদের শ্রবণ সমস্যা’ নিয়ে এক গবেষণা জরিপ করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে- সিলেটে দিনের বেশিরভাগ সময় সড়কে কাটানো ৩১ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস হয়েছে শব্দদূষণের কারণে। এর মধ্যে সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকার পেশাগত দায়িত্ব পালনে সড়কে থাকা ট্রাফিক পুলিশের ৩১ শতাংশ এই সমস্যায় ভুগছেন। আর প্রায় ৪২ শতাংশ রিকশাচালকের শ্রবণজনিত সমস্যা রয়েছে এই শব্দদূষণের কারণে।

গবেষণা জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে- রিকশাচালক এবং ট্রাফিক পুলিশ ছাড়াও ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক, ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ দোকানদার, ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ বাস-ট্রাক চালক, ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাইভেটকারচালক এবং ১২ দশমিক ৫ শতাংশ মোটরসাইকেল চালক শ্রবণজনিত সমস্যায় ভুগছেন।

জরিপে অংশ নেওয়াদের প্রতি চারজনে একজন কানে কম শোনার সমস্যায় ভুগছেন বলে জরিপের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এ বিষয়ে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কার্যক্রমের পরিচালক ডা. নুরুল হুদা নাঈম সিলেটভিউ-কে বলেন, শব্দদূষণে শ্রবণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে বধির হচ্ছে মানুষ। যারা জন্মগতভাবে কানে শোনে না তারা কথাও বলতে পারে না। বধিরতা প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা যাবে সচেতনতার মাধ্যমে।

তিনি বলেন, জন্মবধির ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ, শব্দদূষণ, আঘাত এবং বয়সজনিত কারণে হয়ে থাকে। এ ছাড়া কিছু ওষুধ (অটোটক্সিক ড্রাগস) ডায়াবেটিস টিউবারকিউলোসিসের কারণেও বধিরতা আসতে পারে। ন্যাশনাল প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সিস্টেমে ‘ইউনিভার্সাল হিয়ারিং কেয়ার’ পদ্ধতি চালু করলে অনেকাংশে বধিরতা রোধ করা সম্ভব। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারির মাধ্যমে ইতোমধ্যে আমরা বহু জন্মবধির শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।’

শব্দদূষণে শিশুদের বেশি ক্ষতি হয় উল্লেখ করে ডা. নুরুল হুদা নাঈম আরও বলেন, শিশুদের ওপর শব্দদূষণের প্রভাব মারাত্মক। কারণ, তাদের মস্তিষ্ক গঠনের পথে থাকে। শব্দদূষণ এই গঠন বাধাগ্রস্ত করে। শিশুর শেখার ক্ষমতা কমে যায়। কথা বলতে দেরি হয়। আচরণেও প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া শব্দদূষণ বড়দের স্ট্রোকের ঝুঁকি ৩০ ভাগ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। শব্দদূষণের কারণে মানুষ অবসাদে ভোগে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, সহিংসতার প্রবণতা বাড়ে।
 

সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডালিম / এসডি-১৩