ছবি : রুবেল মিয়া

বীর বাঙালি জাতি বিজয়ের স্বাদ পেয়েছে দীর্ঘ ৫২ বছর আগে। তবে অর্ধশত বছর আগে একাত্তরের লড়াকু দিনে মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে নিয়ে পাকহানাদারদের চালানো নির্মম নির্যাতন এবং হত্যাযজ্ঞের ক্ষতচিহ্ন আজও বয়ে বেড়াচ্ছে সিলেট ক্যাডেট কলেজের পেছনের টিলার পদদেশ। নির্জন দুপুর বা সুনসান মধ্যরাতে সেই বধ্যভূমি থেকে যেন আজও ভেসে আসে হানাদারদের হাতে নির্দয়ভাবে প্রাণ হারানো মুক্তিপাগল বীর যুদ্ধাদের আর্তনাদ।

জীবন দিয়ে জাতিকে বিজয় উপহার দেওয়া সেই অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধাভরে স্বরণ করতে এবার সিলেটের সবচেয়ে বড় এই বধ্যভূমিতে স্থাপন করা হয়েছে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহিদ স্মৃতি উদ্যান, সিলেট’। শনিবার (৩ মার্চ) বিকেলে ‘শহিদ স্মৃতি উদ্যানটি’র উদ্বোধন করা হয়। ফিতা কেটে এর উদ্বোধন করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী। 


এসময় এখানে গণকবর হওয়া বীর শহিদদের স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন এবং উদ্বোধনের পর শহিদদের কবরে ফুল দিয়ে গভীর শ্রদ্ধা জানান তারা। এসময় স্বজনরা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন এবং তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াতে থাকে।

সিলেট সেনানিবাসের সহযোগিতা ও সিলেটের দুটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের উদ্যোগ এবং অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহীদ স্মৃতি উদ্যান, সিলেট’।

গৌরবান্বিত পরিবার দুটি হচ্ছে- শহিদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আব্দুস সালাম বীরপ্রতীক। 

আব্দুস সালাম এ বিষয়ে জানান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসজুড়ে যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল সেখানে এখন রয়েছে সিলেট ক্যাডেট কলেজ। কলেজের পেছনে পূর্বদিকের টিলার পাশে মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে নিয়ে পাকহানাদাররা নির্যাতন চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে, ওই জায়গাটিই বধ্যভূমি। বধ্যভূমি সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় গত বছর এখানে শহিদদের স্মরণে ‘স্মৃতিসৌধ’ নির্মাণ করে সিলেটের গণপূর্ত বিভাগ। আজ নতুনভাবে পরিচিতি পেলো এই বধ্যভূমি। ভয়াল একাত্তরে এখানে যাদের কবর দেওয়া হয়েছিলো তাদের নামে (যাদের নাম পাওয়া গেছে) নামফলক স্থাপন করা হয়েছে।

আব্দুস সালাম বলেন, সিলেট সেনানিবাসের সহযোগিতায় শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদের ছেলে ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ ও আমার পরিবারের অর্থায়নে এবং সবার সহযোগিতায় শহীদ স্মৃতি উদ্যান নির্মাণ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান- ওই বধ্যভূমিতে গণকবর দেওয়া শহিদদের পরিচয় পেতে সিলেটের স্থানীয় পত্রিকাতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।  প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে স্মৃতি উদ্যানে ৬৬ জন শহিদের নামফলক বসানো হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরও শহীদের সন্ধান পাওয়া গেলে তাদের নামও ফলকে যুক্ত করা হবে। 

এর আগে ২০০৭ সালে সিলেট ক্যাডেট কলেজ কর্তৃপক্ষ পুরো জায়গাটি চিহ্নিত করে। গত বছর এখানে বধ্যভূমি সংরক্ষণের এগিয়ে আসেন কর্নেল আব্দুস সালাম এবং ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ। সিলেট সেনাবাহিনীর অনুমতি নিয়ে এবং সিলেট এরিয়া কমান্ডের সহযোগিতায় ‘শহিদ স্মৃতি উদ্যান’ তৈরির পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও সাংবাদিক অপূর্ব শর্মাকে সঙ্গে নিয়ে নিয়ে শহীদ স্মৃতি উদ্যান নির্মাণ বাস্তবায়ন কমিটি করেন এই দুজন।

শহিদদের পরিচয় অনুসন্ধানের দীর্ঘ প্রক্রিয়াটি ছিলো বেশ কঠিন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী পত্র-পত্রিকা, গবেষণাগ্রন্থ এবং মাঠ পর্যায়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে প্রতিটি শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে এ পর্যন্ত ৬৬ জনের নাম সংগ্রহ করা হয়েছে। নতুন কোনও শহিদের তথ্য পেলে আগামীতে তা উদ্যানে সংযুক্ত করা হবে।

ওই বধ্যভূমিতে কবর হওয়াদের মধ্য থেকে এখন পর্যন্ত যাদের শনাক্ত করা গেছে তারা হলেন- নারায়াণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার মোসলেহ উদ্দিন ভুঁইয়ার ছেলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ড. এ এফ জিয়াউর রহমান, হবিগঞ্জ জেলার আউশকান্দি এলাকার সৈয়দ সাজিদ আলীর ছেলে সৈয়দ সিরাজ আবদাল, সিলেট নগরীর পুরাণ লেন এলাকার উপেন্দ্র কিশোর সেনগুপ্তের ছেলে বিমলাংশু সেন, ছড়ারপাড় এলাকার আব্দুন নুরের ছেলে বাছির মিয়া, সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার দেউল গ্রামের মন্তাজ আলীর ছেলে নুরুল হুদা গউস, ইপিআর ক্যাপ্টেন আলাউদ্দিন, সিলেট নগরীর মুগলটুলা এলাকার মশরফ আলীর ছেলে সোনাওর আলী, মিরাবাজার এলাকার শারদাচরণ দেবের ছেলে শুভেন্দু শেখর দেব শংকর, একই এলাকার গিরিধারী চক্রবর্তীর ছেলে গির্বানী কান্ত চক্রবর্তী, তার ছেলে গকুলানন্দ চক্রবর্তী ও গঙ্গোত্রী চক্রবর্তী, খাদিমপাড়া দত্তগ্রাম এলাকার ইয়াকুব আলীর ছেলে সিদ্দিক আলী, একই গ্রামের আব্দুল লতিফের ছেলে আব্দুর রব হীরা, মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার খলাগ্রামের সূর্যকুমার ধরের ছেলে সুরতিমোহন ধর, একই গ্রামের দীনরাম দেবের ছেলে নরেন্দ্র দেব, সিলেট মহানগরের জল্লারপাড় এলাকার বলেনদ্র চন্দ্র রায়ের ছেলে শুভন্দ্র শেখর রায়, সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার ছোটদেশ এলাকার আছদ্দর আলীর ছেলে তোতা মিয়া, সিলেট সদর উপজেলার মহালদিক গ্রামের আনোয়ার পাত্রের ছেলে কুমেদ পাত্র, একই গ্রামের কানতুর পাত্রের ছেলে ফরছন পাত্র, রবাই মিয়ার ছেলে ইসরাইল আলী, সৈয়দ আলীর ছেলে আব্দুর রহমান, কনাই মিয়ার ছেলে আব্দুল গনি, মুছন আলীর ছেলে রমজান আলী, সিলেট সদর উপজেলার ধোপাগুল এলাকার হামিদ উল্লার ছেলে হাজী আমজদ আলী, সিলেট মহানগরের আখালিয়া ব্রাহ্মণশাসন এলাকার করুণাময় ভট্টাচার্যের ছেলে কালিপদ ভট্টাচার্য, তার ছেলে হীরেন্দ্র ভট্টাচার্য, নগরীর নয়াটিলা এলাকার সদাই নমঃশুদ্রের ছেলে সুখাই নমঃশুদ্র, সিলেট সদর উপজেলার উমদারপাড়া গ্রামের আলাই মিয়ার মেয়ে ছুরেতুননেছা, একই গ্রামের ওয়াহাব উল্লার মেয়ে রহিমা বেগম ও খলিলা বেগম, দক্ষিণ সুরমা উপজেলার খোজারখলা গ্রামের সুরুজ আলীর ছেলে তজমুল আলী, সিলেট সদর উপজেলার মহালদিক গ্রামের আব্বাস আলীর মেয়ে ময়না বিবি, গোয়াইনঘাট উপজেলার বীরকুলি গ্রামের ছমেদ আলীর ছেলে আব্দুল খালিক, সিলেট সদর উপজেলার লাখাউড়া গ্রামের হায়দার মিয়ার ছেলে আব্দুল মজিদ, একই উপজেলার পোড়াবাড়ি গ্রামের রামচরণ উড়াংয়ের সন্তান দূর্গা উড়াং ও ভাদুয়া উড়াং, একই গ্রামের লিব উড়াংয়ের সন্তান ঘাটমা উড়াং, একই উপজেলার বাবার হাট এলাকার কিশোরপাত্রের ছেলে শচীন্দ্রপাত্র, মহালদিক গ্রামের ছফর আলীর ছেলে আব্দুল গণি, সিলেট সদর উপজেলার লালবাগ এলাকার আব্দুল আলীর ছেলে জহির আলী, একই গ্রামের ইয়াকুব আলীর ছেলে জফুর আলী। সিলেট সদর উপজেলার বালিয়াকান্দি গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে আব্দুল ছোবহান, দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বরইকান্দি গ্রামের সৈয়দ আহমদের ছেলে আব্দুল আলী, সিলেট সদর উপজেলার জৈনকারকান্দি গ্রামের ইব্রাহিম আলীর ছেলে সাজিদ আলী, একই উপজেলার বাউয়ারকান্দি গ্রামের সফর আলীর ছেলে আব্দুল গনি, গোয়াইনঘাট উপজেলার কচুয়ারপাড় গ্রামের উমেদ আলীর ছেলে আকবর আলী, একই গ্রামের ফুরকান আলীর ছেলে ইউসুফ আলী, সিলেট সদর উপজেলার দাফনাটিলা গ্রামের ইসরাইল আলীর ছেলে কুটি মিয়া, একই উপজেলার কালাগুল এলাকার কেয়ামত আলীর ছেলে সুরুজ আলী, সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার সিরাজপুর গ্রামের ফজল খানের ছেলে নুরুল হক খান, সিলেট সদর উপজেলার মহাজনপট্টি এলাকার গুরুচরণ মিত্রের ছেলে গজেন্দ্রলাল মিত্র, একই এলাকার মদনমোহন বণিকের ছেলে প্রাণ গোবিন্দ বণিক, শুধাংশু শেখর দত্তের ছেলে সুনীল দত্ত, সিলেট নগরীর সুবিদবাজার নয়াবস্তি এলাকার নারায়ন সিংহের ছেলে আনন্দ সিংহ, তার ছেলে খগেন্দ সিংহ, বড়বাজার রায়হোসেন এলাকর গরবা সিংহের ছেলে গৌরমোহন সিংহ, সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার কর্মকলাপতি গ্রামের বৃন্দাবন চন্দ্র দেবের ছেলে বসন্ত কুমার দেব, সিলেট নগরীর তাঁতীপাড়া এলাকার বংকেশ দাশ, সিলেটের ওসমানীনগর উপজলার তাজপুর রবিদাশ এলাকার গজেন্দ্র কুমার দেবের ছেলে মিহির লাল দেব এবং মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার নন্দনগর গ্রামের আব্দুল গণি চৌধুরীর ছেলে আব্দুল আহাদ চৌধুরী, সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণবাঘার মসিউদ্দিন চৌধুরী ছেলে সাইফুদ্দিন চৌধুরী এবং ইপিআরের মেজর আব্দুল্লাহ, ক্যাপ্টেন খালেদ ও মেজর চৌধুরী। তবে শেষের ৩ জনের বাবার নাম ও পূর্ণ ঠিকানা জানা যায়নি।


সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডালিম