ক্ষমতার সুবিধাভোগী ছাত্র সংগঠনের একটি জেলা কমিটির সভাপতি গতকাল রাত আটটায় ফোন দিলেন। উনার আবার সময়ের খুবই তাড়াহুড়ো। শুরুতেই পরিচয় দিয়ে বললেন, একটা নিয়োগ বিষয়ে কথা বলতে চান। আমি বললাম নিয়োগ বিষয়ে কথা বলার দায়িত্বপ্রাপ্ত একটা বিভাগ রয়েছে সংস্থায়। উনি উত্তরে জানালেন, একজনকে নিয়োগ দেয়ার জন্য ফোন দিয়েছেন আমাকে। বললাম, একটা ছাত্রসংগঠনের সভাপতির জানা উচিত একটা সংস্থা কিভাবে চলে আর জানা না থাকলে পড়াশোনা করতে এই বিষয়ে। ফোন রেখে দিলাম।
 

সরকারের একটা অধিদফতরের অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক যিনি বর্তমানে একটা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি। একটা নিয়োগের সুপারিশ করতে ফোন দিয়েছেন। দারুণ ব্যবহার। তিনি জানালেন, আমার নির্বাহী পরিচালককে ফোন দিতে চেয়েছিলেন। উনাকে না পেয়ে আমাকে ফোন দিয়েছেন। উনাকে জানালাম, নির্বাহী পরিচালক দেশের বাইরে আছেন আর উনাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাওয়া যাবে। আধাঘন্টার সময় ব্যবধান মাত্র। ভদ্রলোককে স্মরণ করিয়ে দিলাম, এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরকে ফোন দিলেই যে উনি আমাকে নিয়োগ দিয়ে দিতে বলবেন ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম নয়।


রংপুরে আছি। দেখলাম বন্ধুজন উমর ফারুক টক অব দ্যা কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছেন। তিনি একটা ন্যায্য প্রতিবাদ করেছেন। উনার কাছে স্যার ডাক শোনার অভিপ্রায় জানিয়েছেন একজন ডিসি। তবে ঐ জেলার ডিসি মহোদয়ও দারুণ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদমূখর ছাত্র শিক্ষকের মাঝে গিয়ে হাজির হয়েছেন। পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেছেন। আমার অনেক কনিষ্ঠ ভাইবোন সরকারের মাঠ প্রশাসনে কর্মরত আছেন। তাদের কাছে যাই নানান প্রয়োজনে। পূর্বের তুই-তোকারি বা ঘনিষ্ঠ সম্বোধন এড়িয়ে চলি। একটা সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করেছে তাই কাউকে বিব্রত না করে নিজের অহমের জায়গাটা ঠিক রেখে আমি ইউএনও মহোদয় বা ডিসি মহোদয় বলে সম্বোধন করে থাকি।
 

একবার একটা জেলায় সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলাম এক অনুষ্ঠানে। এক যুগেরও আগের ঘটনা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করছিলেন ঐ জেলার ডিসি। অনুষ্ঠান সঞ্চালনার ভার পড়েছিল আমার উপর অতর্কিত। উনাকে মাননীয় না বলে সম্বোধন করায় আমার উপর চটেছিলেন। সম্ভবত সম্মানিত বলায় উনি অসম্মানিতবোধ করেছিলেন।

এক জেলার অতিরিক্ত ডিসিকে এক অনুষ্ঠানের সমাপনী দিনে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছি। সেও প্রায় চৌদ্দবছর আগের ঘটনা। আমার সাথে বেশ ভালই সম্পর্ক। একবার একটা স্কুলে গিয়েছিলাম উনার সাথে। দেখি উনার চশমা ঘোলা হয়ে যায় আর স্কুলের শিক্ষিকাদের দিয়ে কয়েকবার চশমাটা মুছিয়ে নিয়েছিলেন। রসিক মানুষ। উনার দফতরে গিয়েছি ঐ দাওয়াত দিতে। একজন নবনিযুক্ত সহকারী কমিশনারও আছেন ওখানে। ভদ্রমহিলা যেতে চাইলেন কয়েকবার। রসিক ঐ উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে বসিয়ে রাখলেন। আমার কাছে জানতে চাইলেন, অনুষ্ঠানটির উদ্বোধন কে করেছিলেন। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ওটা করেছিলেন জেনে আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, আমার এই দু:সাহস দেখে তিনি অবাক। তিনি জানিয়েছিলেন যে, ঐ কর্মকর্তাদের উনি উনার দফতরের দারোয়ানও মনে করেন না। যে অনুষ্ঠান একজন 'দারোয়ান' উদ্বোধন করে সেটার সমাপনীতে ঐ মহারাজ তো যেতে পারেননা! সদরের ইউএনওকে আমার সামনেই ফোন দিয়েছিলেন আর এর ফলে অনুষ্ঠানটির আয়োজকেরা হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন।
 

আমার কাছে একটা প্রশ্ন, ডেপুটি কমিশনারের বাংলা জেলা প্রশাসক লিখে কি আমরা একটা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা তৈরি করেছি? আমার ধারণা ছিল, ইদানীং সরকারের প্রশাসন যন্ত্রে ব্যাপক গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। আমি যাদের কাছে যাই তাদের আচরণেও আমি সেরকম আশাব্যঞ্জক একটা ব্যাপার লক্ষ্য করি। 
তারপরেও স্যার না বলায় হেনস্থা করা, ক্যাডার সার্ভিসের অন্য ক্যাডারের উপর চড়াও হওয়া, দলবল নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাকে মারধর করা এরকম ঘটনা ইদানীং খুব বেশি দেখা যাচ্ছে সরকারের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে। সরকারের উচিত মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তার জন্য আচরণবিধির উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে তারপর পদায়ন করা। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়াটিকে ঢেলে সাজানো দরকার।

সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তা খুবই গুরুদায়িত্ব পালন করেন। তাদের ব্যস্ততা অকল্পনীয়। কাজের পরিধি বিশাল। গণহারে সমালোচনা না করে তাদের অবদানকেও প্রশংসা করা দরকার। বগুড়ার ডিসি যে দারুণ ভূমিকা পালন করলেন জেলা স্কুলের ঘটনায় সেটা প্রশংসার দাবি রাখে। বগুড়ার এক বিচারিক কর্মকর্তা যে আচরণ করলেন সেটার প্রতি অনুতপ্ত হয়ে ঐ বিচারিক কর্মকর্তার উচিত হবে পেশা পরিবর্তন করা। এই পেশাটিকে কলংকিত করে এখানে থাকার আর নৈতিক অধিকার উনার নেই বলেই মনে করি।
আমি বিস্মিত হয়েছি ঐ বিচারিক কর্মকর্তার পারিবারিক শিক্ষার বিষয়টি ভেবে। উনার মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বিদ্যালয়ের নিয়ম অনুসারে রোটেশনে সবাই শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দেয়। উনার কন্যার টার্ন আসলে সে তা করতে অস্বীকার করে এই বলে যে, সে জজের মেয়ে। এই কাজ তার নয়। সে নাকি এও বলেছে যে, বাকীরা বস্তির মেয়ে। তার সাথে লড়তে হলে আগে জজের মেয়ে হয়ে আসতে! কি ধরণের পারিবারিক শিক্ষা পেলে মেয়ে এমন কথা বলতে পারে তা ভেবে শংকিত হয়েছি।
 

ঘটনাটা এখানে থেমে গেলে আমি শুধু বলতাম, এই শিশুটির সামাজিকীকরণে ভূমিকা রাখুন। অভিভাবকদের বলতাম, সন্তানের সামনে নিজেদের পেশাগত দম্ভ দেখাবেননা, প্লিজ।

কিন্তু দূর্ভাগ্য যে, জজ সাহেব বিদ্যালয়ে গেছেন। উনার মেয়ের সহপাঠীদের অভিভাবকদের তলব করেছেন। আশ্চর্য ব্যাপার ঐ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এই কাজে সহযোগিতা করেছেন। আর ঐ অভিভাবকদেরকে বাধ্য করেছেন মাহামতি জজ নিজের সম্মানিত পা ধরে মাফ চাইতে। আইসিটি আইনে মোকদ্দমা করে জেল খাটানোর হুমকিও দিয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমে জেনেছি।

আচ্ছা, ১৪ বছর বয়সী শিশুর কি ফেইসবুক চালানোর কথা? আইসিটি ব্যবহারের এই কান্ডজ্ঞান কি জজসাহেবের নেই? সেই ফেইসবুকের কমেন্টের প্রতিক্রিয়ায় তিনি কিভাবে এই কান্ড করলেন?

প্রশানের প্রতিটা পর্যায়ে কেমন জানি একটা দম্ভ বিরাজ করছে। মাঝেমধ্যেই এর কদর্য রুপ বেরিয়ে আসছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতাই কি এর জন্য দায়ী?
 

নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের দায়িত্ব ভুলে যাচ্ছি। স্বেচ্ছায় নিজেরা পরাজয় বরণ করছি অথবা নিজেদেরকে পরাজিত ভেবেই স্বস্থি পাচ্ছি। ভেবে কুল কিনারা পাই না। এক ই দিনে আমি আর অধ্যাপক উমর ফারুক প্রতিবাদি নাগরিক দায়িত্ব পালিন করছে ভেবে পুলকিত হচ্ছি।
 


লেখক: মুহম্মদ আব্দুস সামাদ, লোকসংস্কৃতি গবেষক, লেখক, উন্নয়ন কর্মী, একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি সংস্থায় পরিচালক হিসেবে কর্মরত।