বিশ্বের বৃহত্তম মহাদেশ এশিয়ার বিভিন্ন অংশে যেভাবে ফোস্কাপড়া তাপ প্রবাহ শুরু হয়েছে, তাতে চলতি ২০২৩ সাল পৃথিবীর উষ্ণতম বছর হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন জলবায়ুবিদরা।
 

এল নিনো ধরনের আবহাওয়ার প্রভাবে ২০২৩ সালের শীত শেষ হতে না হতেই তাপমাত্রার পারদ যেভাবে চড়ছে, তা বিশ্বের উত্তর গোলার্ধের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর জন্য রীতিমতো অশনি সংকেত বলে মত বিশ্বের জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের।
 


রবিবার ভিয়েতনামের গড় তাপমাত্রা ছিল ৪৪ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার এই দেশটির ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড। তাপমাত্রার প্রভাবে বিদ্যুতের চাহিদায় আকস্মিক উল্লম্ফন এবং তার জেরে ভিয়েতনামে প্রায় ভেঙে পড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা। প্রতিবেশী দেশ লাওসেও এ দিন রেকর্ডভাঙা তাপমাত্রা ছিল। দক্ষিণপূর্ব এয়িশার অপর দেশ ফিলিপাইনে প্রায় প্রতিদিন তাপমাত্রার সূচক ‘বিপজ্জনক’ পর্যায়ে থাকায় স্কুলের সময়ঘণ্টা কমাতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
 

তাপপ্রবাহ থেকে থেকে মুক্তি পাচ্ছেনা ফিলিপাইনের দুই প্রতিবেশী থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়াও। গত সপ্তাহে প্রতিদিনই থাইল্যান্ডের উত্তর ও মধ্যাঞ্চালে তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর। তাপপ্রবাহের কারণে স্বাভাবিকভাবেই বেড়েছে বিদ্যুতের চাহিদাও। থাই জলবায়ুবিদরা সরকারের উদ্দেশে সতর্কবার্তা দিয়ে জানিয়েছেন, সামনের তিন বছর দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে খরা দেখা দিতে পারে; সরকারের উচিত আসন্ন এই দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখা।
 

খরার আশঙ্কায় আছে মালয়েশিয়াও। দেশটির আবহাওয়া দপ্তর এক পূর্বাভাসে জানিয়েছে, চলতি বছর মালয়েশিয়ায় বৃষ্টিপাত কমে যেতে পারে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। যদি সত্যিই এমন হয়, সেক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পাম ওয়েল উৎপাদনকারী এই দেশটির ভোজ্যতেলের মূল কাঁচামাল পামের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বৈশ্বিক জলবায়ুবিদদের মতে, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু হতে যাওয়া এল নিনো আবাহাওগত প্যাটার্ন এই দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রাবাহের জন্য মূলত দায়ী এবং একে আরও অসহনীয় করে তুলছে মানবসৃষ্ট কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ব্যাপারটি।
 

স্প্যানিশ ভাষার দুই শব্দ ‘এল নিনো’ এবং ‘লা নিনা’র আক্ষরিক বাংলা অর্থছোটো খোকা ও ছোটো খুকী। তবে গত কয়েকশ’ বছর ধরে এই শব্দ দু’টি দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলের জলবায়ুগত অবস্থা বা চক্রকে বোঝানো হয়। এই চক্রের একটি অংশের নাম ‘এল নিনো’ অপরটির নাম ‘লা নিনা’।
 

কোনো কোনো বছর প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চলীয় দেশ পেরু, ইকুয়েডর ও চিলির উপকূলে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে এক প্রকার উষ্ণ সমুদ্র স্রোতের প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়। গড়ে প্রতি ৬ থেকে ৭ বছর অন্তর অন্তর বিশেষ এই ব্যাপারটি ঘটে।
 

এই উষ্ণ স্রোতের কারণে দক্ষিণ থেকে উত্তরমুখী শীতল সামুদ্রিক স্রোতের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন অঞ্চলের সমুদ্রে বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, উদ্ভিদ প্ল্যাংকটনের পরিমাণ হ্রাস পায় এবং মাছের উৎপাদন কমে যায় এবং স্থলভাগের তাপমাত্রা বাড়ে।
 

এল নিনোর প্রভাবে প্রশাসন্ত মহাসাগরের উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে খরা বা অনাবৃষ্টি দেখা দেয়। কোনো কোনো অঞ্চলে অতিবর্ষণও ঘটে থাকে।

সাধারণত ২ থেকে ৪ বছর স্থায়ী হয় এল নিনো। তারপরই আসে ‘লা নিনা’। সে সময় এল নিনোর বিপরীত অবস্থা দেখে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলবর্তী বিভিন্ন দেশ।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের জলবায়ু মডেলগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছর প্রশান্ত মহাসাগরে লা নিনা আবহাওয়া প্যাটার্ন ছিল। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ থাকা সত্ত্বেও খানিকটা কম ছিল বৈশ্বিক তাপমাত্রা; কিন্তু চলতি বছরের মাঝামাঝি বা তার কিছু পর থেকে লা নিনা শেষ হবে, শুরু হবে এল নিনো প্যাটার্ন।
 

গত প্রায় তিন বছর ধরে খরা চলছে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশভুক্ত আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাংশে। বৈশ্বিক জলবায়ুবিদদের মতে, এল নিনো’র প্রভাবে হয়ত চলতি বছরই এই খরার অবসান হবে, কিন্তু একই সময়ে তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়তে থাকবে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়াসহ অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল।

আর এসব জায়গায় টানা ও দীর্ঘমেয়াদী তাপপ্রবাহের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কফি, চিনি,পাম তেল ও কোকোয়ার মতো কৃষিপণ্যের উৎপাদন।


 

সিলেটভিউ২৪ডটকম/ডেস্ক/এসডি-১৫৪


সূত্র : ঢাকাপোষ্ট