শুধু সিলেট নয়, পুরো দেশই ইলমে ওহি’র আকাশ থেকে হারিয়েছে এক অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র। বুধবার (১৭ মে) সন্ধ্যায় অসংখ্য শিক্ষার্থী-ভক্ত-শুভান্যুধ্যায়ীসহ পুরো আলেমসমাজকে কাঁদিয়ে মহার রবের সান্নিধ্যে চলে গেছেন মুকুটহীন সম্রাট শায়খুল হাদিস মাওলানা মুফতি মুহিব্বুল হক (গাছবাড়ি)। যিনি সিলেটসহ সারা দেশে ‘গাছবাড়ি হুজুর’ নামে সুপরিচিত। 

মুহিব্বুল হক (গাছবাড়ি) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ক্বওমি মাদরাসা ‘জামেয়া ক্বাসিমুল উলুম দরগাহ’র মুহতামিম, সরকার অনুমোদিত সমন্বিত ক্বওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড ‘আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিয়াতির ক্বওমিয়্যাহ’র সহ-সভাপতি ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণক, ক্বওমি ধারার প্রাচীন শিক্ষাবোর্ড ‘আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশ’র সহ-সভাপতি ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণক এবং বাংলাদেশ উলামা পরিষদের সভাপতির আসন অলংকৃত করে রেখেছিলেন। 


মুহিব্বুল হক ১৯৪৫ সালের ৬ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার ঝিঙ্গাবাড়ি ইউনিয়নের ফখরোচটি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাওলানা ইসহাক রাহ. ছিলেন সেই সময়ের প্রখ্যাত আলেম। স্থানীয় ডাকনাইল দক্ষিণ সরকারি বিদ্যালয়ে ৫ বছর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ‘গাছবাড়ি হুজুর’ নিজ এলাকার প্রসিদ্ধ দ্বিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘গাছবাড়ি মাযাহিরুল উলুম ক্বওমি (আকুনি) মাদরাসায়’ মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমকি স্তরের পড়ালেখা শেষ করেন। 

পরে ১৯৬৩ থেকে ৬৯ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সিলেটের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম কানাইঘাট মাদরাসা, ঢাকা উত্তর রানাপিং আরবিয়া হোসাইনিয়া মাদারাসা এবং দেশের শ্রেষ্ঠ ক্বওমি বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম হাটহাজারি মাদরাসায় বিভিন্ন স্তর ও বিভাগভিত্তিক অধ্যয়ন শেষ করে দাওরায়ে হাদিস (টাইটেল) সমাপ্ত করেন। দাওরা পরীক্ষায় সারা দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধাতালিকায় ১ম স্থান অর্জন করেন ‘গাছবাড়ি হুজুর’।  

শিক্ষাজীবন শেষে মুহিব্বুল হক (গাছবাড়ি)-এর সোনালী কর্মজীবনের সূচনা হয় ১৯৬৯ সালে। সুনামগঞ্জ দরগাহপুর মাদরাসায় তাঁর শিক্ষকতাজীবনের শুরু। সেখানে তিনি ৪ বছর অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে হাদিস শাস্ত্রের বিভিন্ন গ্রন্থ অধ্যাপনা করেন। ফলে তিনি দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ক্বওমি মাদরাসা ‘জামেয়া কাসিমুল উলুম দরগাহ’র সে সময়ের মুহতামিম, সিলেটের আরেক বরেণ্য আলেম মাওলানা আকবর আলির। 

১৯৭৩ সালে দরগাহ মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন ‘গাছবাড়ি হুজুর’। ২০১৯ সালে তিনি মাদরাসাটির মুহতামিমের আসন অলংকৃত করেন।  সেই ৭৩ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় একজন যোগ্যতাসম্পন্ন পারঙ্গম শিক্ষক, মুহাদ্দিস, মুফতি, শায়খুল হাদিস হিসেবে দ্বিনের খেদমতের দ্বারা নিজ কর্মের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন তিনি।

‘গাছবাড়ি হুজুর’র অত্যুজ্জ্বল অধ্যাপনার পাশাপাশি অসম্ভব বিনয়, মার্জিত চরিত্র, নিষ্ঠা ও বিচক্ষণতা সর্বস্তরের মানুষকে আকৃষ্ট করতো। সিলেটসহ সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন এক মুকুটহীন সম্রাট। 

মুহিব্বুল হক (গাছবাড়ি) সিলেট জেলার অনেক ক্বওমি মাদরাসার মজলিসে শুরার সভাপতি ছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময় ‘আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিয়াতির ক্বওমিয়্যাহ’ গঠিত ইফতা বোর্ডের সদস্য, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ সিলেট জেলার সভাপতি, খাদিমুল কুরআন পরিষদের সভাপতি, সিলেট জেলা ফতোয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ বেশ কয়েকটি ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃত্বপর্যায়ে ছিলেন।  

সর্বোপরি ‘গাছবাড়ি হুজুর’ ছিলেন একজন সুবক্তা। তাঁর সাবলিল ও প্রাঞ্জল নহিসত নজর কাড়তো সবার। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও মিষ্টভাষী। এমন এক মহান ব্যক্তির শূন্যতা সিলেটে বহমান থাকবে যুগ যুগ ধরে।

উল্লেখ্য, বুধবার (১৭ মে) মাগরিবের নামাজের পর মুহিব্বুল হক (গাছবাড়ি) দরগাহ মাদরাসায় তাঁর নিজ বিশ্রামকক্ষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে, চার মেয়ে ও ছাত্র-শিক্ষক-মুরিদানসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বুধবার রাত সাড়ে ৭টার দিকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সিলেট মহানগর শাখার সভাপতি মাওলানা খলিলুর রহমান সিলেটভিউ-কে বলেন- ‘বুধবার দিনে কোম্পানীগঞ্জে কয়েকটি মাহফিলে হুজুর অংশগ্রহণ করেন। আছরের নামাজ এসে আদায় করেন দরগাহ মাদরাসায়। আছরের পরে হুজুর তাঁর বিশ্রামকক্ষে ছিলেন। মাগরিবের ওয়াক্তে হুজুরের শারীরিক অবস্থা হঠাৎ খারাপ হয়। মাগরিবের নামাজ শেষে সঙ্গে সঙ্গে হুজুরকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকরা বলেছেন- হুজুর স্ট্রোক করেছেন।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শায়খুল হাদিস মুহিব্বুল হক (গাছবাড়ি)-এর জানাযার নামাজ আজ বৃহস্পতিবার (১৮ মে) বেলা আড়াইটায় মহানগরের শাহী ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হবে। জানাযার নামাজে ইমামতি করবেন তাঁর বড় ছেলে, দরগাহ মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা এনামুল হক জুনাইদ। 

জানাযা শেষে হযরত শাহজালাল রাহ. মাজার কবরস্থানে লাশ দাফন করা হবে। 


সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডালিম