যেদিকে চোখ যায়, ঠাঁইহীন থৈ থৈ পানি। কখনো নিশ্চল, কখনো পুবাল কিংবা দখিনা হাওয়ায় উত্তাল। পূর্বাকাশে সূর্যের লাল আলোর ঢেউগুলো সাদা রং ছড়ানোর আগেই এই জলরাশি পেরিয়ে একদল কোমলমতিকে যেতে হয় সেখানে। আগে যেখানে টিনের শরীরে অসংখ্য ছিদ্র নিয়ে কোনোমতে দাঁড়িয়ে ছিলো ছোট্ট একটি ঘর। দেওয়ালের পুরোটাও টিন ছিলো না, উপরদিকে পলিথিনঘেরা।

কাদাপানিতে মাখামাখি মেঝে, উপরে ফুটা চালা। সতেজ সকালে কর্দমাক্ত মেঝেতে পলিথিনের উপর বসে কোমলমতিরা কোরাস কণ্ঠে পান করতো বেহেশতি সিরাজি। দিনে ৫ বার ওই কাদাপানির মেঝেতেই স্রষ্টার সান্নিধ্য পেতে সেজদায় লুটিয়ে পড়তেন একদল স্বর্গ-খোঁজা মানুষ।


সেই কোমলমতির ঝাঁক আর স্বর্গসন্ধানী মানুষদের কষ্ট একসময় ছুঁয়ে গেলো কিছু মানবতার ফেরিওয়ালাকে। ওরা তাদেরকে উপহার দিলেন ‘জলের বুকে এক টুকরো স্বর্গের হাসি’। এখন আর নেই সেই কাদাপানির মেঝে, দেওয়ালে নেই ছিদ্র- চালার ফুটাও উধাও। দুধসাধা চার দেওয়ালের ভেতরে, সিমেন্ট-ঢালাই মেঝেতে দাঁড়িয়ে নামাজ শেষে মুসল্লিদের দুচোখ বেয়ে এখন ঝরে শুকরিয়ার অশ্রু।

সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের হাওরবেষ্টিত গ্রাম রাজধরপুর। চারদিকে হাওর বলে ‘হাওরে আলিপুর’ নামেই গ্রামটিকে সবাই চিনে। উপজেলাসদর থেকে ইঞ্জিন নৌকায় এক ঘণ্টার দূরত্বে দ্বীপের মতো এ গ্রামে ৩৫টি পরিবারের বসবাস। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে গ্রামবাসীর একটি জমাট দুঃখ- বিভিন্ন এলাকায় পাকা মসজিদে মাঝে-মধ্যে নামাজ পড়ার সৌভাগ্য হলেও নিজেদের উপসনালয়টি ধুঁকছে। টিনের বেড়া, মেঝেতে কাদাপানি। চারদিকে পানি, মাঝখানে যেন বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে একটি নড়বড়ে ঘর; গ্রামবাসীর মসজিদ বলতে এটিই।

বিষয়টি নজরে আসে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চ্যারিটি সংগঠন ‘রুরাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন গ্লোবাল (আরডিএফ)’-এর। তাদের একটি টিম কয়েক মাস আগে এ গ্রাম পরিদর্শন করে এবং নড়বড়ে ঘরটি ভেঙে সেখানে পাকা মসজিদ নির্মাণের আশ্বাস দিয়ে আসে রাজধরপুরের বাসিন্দাদের। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একসময় সেই কাঁচা ঘর ভেঙে তৈরি হয় পাকা মসজিদ। মসজিদ আল-জামান। গত ৩ সেপ্টেম্বর নফল নামাজের মাধ্যমে পাকা মসজিদটির উদ্বোধন করা হয়।

স্বপ্নের পাকা মসজিদে প্রথম নামাজ আদায় করে রাজধরপুর গ্রামের বাসিন্দা আউয়াল মিয়া অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। জানান, এটি কষ্টের নয়- পরম আনন্দের কান্না। আউয়াল মিয়া ধরা গলায় বলেন- ‘জীবদ্দশায় এমন একটি মসজিদে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারবো স্বপ্নেও ভাবিনি। অনেক সময় নামাজের সময়ই বৃষ্টি চলে আসতো, ফুটো চালা বেয়ে পানি পড়তো মসজিদের ভেতরে। বেড়ার উপরিভাগ দিয়ে বৃষ্টি ঢুকে মসজিদের ভেতর হয়ে পড়তো বেহাল। আমাদের সন্তানরা সকালে অত্যন্ত কষ্ট করে আরবি পড়তো। এখন আমাদের এসব কষ্ট নেই। যারা আমাদের এমন বেহেশত উপহার দিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট সবাইকে আল্লাহ এর বিনিময়ে জান্নাত দান করুন।’


গ্রামটির আরেক বাসিন্দা রাজ্জাক মিয়া। তিনি বলেন- ‘স্বাধীনতার পর থেকে কেউ আমাদের এই দুঃখ বুঝেনি। আরডিএফ নামক সংস্থাটি আমাদের কষ্ট দূর করেছে। মজসিদের ইমাম সাহেবও থাকতেন আমাদের সঙ্গে কষ্ট ভাগাভাগি করে। তার জন্যও আলাদা থাকার ঘর (হুজরা) তৈরি করে দিচ্ছে আরডিএফ। আমরা সংস্থাটির প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।’

৩ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টার দিকে পাকা মসজিদ উদ্বোধনকালে সেখানে উপস্থিত হন গ্রামের বাসিন্দারা। সবারই চোখে-মুখে ছিলো তৃপ্তি-কৃতজ্ঞতার ছটা। সবাই ছিলেন আরডিএফ’র প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

উদ্বোধনকালে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্য থেকে আসা আরডিএফ’র স্বেচ্ছাসেবক জুবের আহমদ চৌধুরী, বাংলাদেশ টিমের জুহের আহমদ চৌধুরী ও  জুনেদ আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ।

উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে গঠিত চ্যারিটি সংস্থা ‘আরডিএফ’ সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র মানুষকে ঘর দেওয়া, গভীর ও সাধারণ নলকূপ প্রদান, দুর্যোগকালীন সময়ে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, শীতবস্ত্র প্রদান, ঝরে পড়া শিশুদের নিয়ে ‘স্যুপ চিকেন’ (আড্ডা, খাবার-দাবার, বিনোদন) এবং কুরবানির পশু বিতরণসহ নানা উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে আরডিএফ। সংস্থাটির কার্যক্রমে আগামীতে আরও বাড়ানোর প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। 


সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডালিম