ব্যাংকের সামনেই ওৎ পেতে থাকে কয়েকজন। টিমে থাকে নারীও। নজর রাখা হয়, কোনো সহজ-সরল বয়স্ক লোক- বিশেষ করে কোনো নারী ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে বের হন কিনা। এমন কাউকে পেলে ব্যাংক হতে বের হওয়ামাত্র টাকা উত্তোলনকারীর সামনেই আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা চক্রটি একটি ছোট্ট নাটক মঞ্চস্থ করে।

টিমের নারী সদস্য (কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষও) তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটি টাকার বান্ডিল বের করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দরবেশ বেশের একজনের কাছে দিয়ে ‘ফু’র মাধ্যমে টাকায় ‘বরকত’ বাড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। সে অনুরোধে ‘দরবেশ’ টাকার বান্ডিলে ‘ফু’ দেন। অভিয়ন শেষ হওয়ামাত্র ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনকারী ভিকটিমকে উদ্দেশ্য করে চক্রের সদস্য বা ‘দরবেশ বাবা’ বলেন- ‘আপনার টাকাও কি ফু-এর মাধ্যমে বাড়িয়ে নেবেন? তাহলে টাকাগুলো দিন।’ প্রলোভনে পড়ে ভিকটিম যখন টাকাগুলো ‘দরবেশ বাবা’র হাতে দেন, ঠিক তখন কৌশলে ফু দিয়ে টাকাসহ উধাও হয়ে যান ‘দরবেশ বাবা’। কিছুক্ষণ পরই প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে ভিকটিম হায় হায় করে উঠেন, তবে ততক্ষণে ভয়ংকর প্রতারক ‘ফু’ চক্রের সদস্যরা চলে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। 


সিলেট বিভাগে সম্প্রতি এমন কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়েছে ‘ফু’ চক্র। এতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে মানুষের মাঝে। সর্বশেষ ৫ অক্টোবর হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে এই চক্রের খপ্পরে পড়ে ৬০ হাজার টাকা খুইয়েছেন আফিয়া বেগম (৪৫) নামের এক নারী। তবে এখন পর্যন্ত এ চক্রের কাউকে আটকের খবর পাওয়া যায়নি। উদ্ধারও হয়নি খোয়া যাওয়া কোনো টাকা।

সিলেটভিউ’র হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জাকারিয়া আহমদ জানান- জেলার বানিয়াচং উপজেলার দাউদপুর গ্রামের বাসিন্দা আফিয়া বেগমের পুত্রবধূ সৌদি আরব থেকে গত সপ্তাহে ব্যাংকের মাধ্যমে ৬০ হাজার টাকা পাঠান। বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) দুপুরে আফিয়া সেই নবীগঞ্জ শহরের ইসলামি ব্যাংক শাখা থেকে ৬০ হাজার টাকা উত্তোলন করেন। টাকা নিয়ে ব্যাংক থেকে বের হওয়ামাত্র সেখানে আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা প্রতারক ‘ফু’ চক্রের কবলে পড়েন তিনি। এসময় হুজুরবেশি এক লোক আফিয়াকে বলেন- ‘আপনার টাকায় ফু দিয়ে দিলে বরকত হবে, টাকা বেড়ে যাবে।’ এই বলে হুজুরবেশি ওই লোক আফিয়ার হাত থেকে টাকা নিয়ে ‘ফু’ দিয়েই টাকাসহ উধাও হয়ে যান।

আফিয়া বলেন- ‘আমার টাকায় ফু দেওয়ার আগে ওই লোক অন্য আরেক মহিলার টাকায় এভাবে ফু দিতে দেখেছি। সেটি দেখে আমার বিশ্বাস জন্ম হয় এবং আমি টাকাগুলো ওই হুজুরবেশি লোকের হাতে দেই।’

ঘটনা জানাজানি হলে ব্যাংকের সামনে জনতার ভিড় জমে। এসময় পুত্রবধূর দেওয়া ৬০ হাজার টাকা খুইয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন আফিয়া। কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসময় তিনি বলেন- আমার পুত্রবধূ ধার-দেনা করে এই টাকাগুলো পাঠিয়েছিলো জরুরি প্রয়োজনে। এখন আমরা কী করবো?

ঘটনার পর নবীগঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন আফিয়া। কিন্তু শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এখন পর্যন্ত ওই ‘দরবেশ বাবা’ বা তার চক্রের কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। 

এর আগে ৩ অক্টোবর মৌলভীবাজারের জুড়ীতে একই পন্থায় এক প্রবাসীর স্ত্রীর কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় ‘ফু’ চক্র। জানা যায়- ৩ অক্টোবর দুপুরে উপজেলার সদর জায়ফরনগর ইউনিয়নের কালিনগর গ্রামের দুবাই প্রবাসী আব্দুল মতিনের স্ত্রী শাহিদা বেগম (৪৫) তার মেয়েকে এইচএসসিতে ভর্তি করানোর জন্য পূবালী থেকে ৩১ হাজার টাকা উত্তোলন করেন। এ সময় প্রতারক চক্র ফু দিয়ে টাকায় বরকত বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। শাহিদা এসময় টাকাগুলো প্রতারক চক্রের হুজুরবেশি লোকের হাতে তুলে দেন। টাকার বান্ডিল থেকে ১ হাজার টাকার একটি নোটে ফু দিয়ে ওই প্রতারক শাহিদার হাতে দিয়ে বাকি ত্রিশ হাজার টাকা নিয়ে কৌশলে মুহুর্তে লাপাত্তা হয়ে যায়।

কিছুক্ষণের মধ্যে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে শাহিদা ব্যাংকের সামনেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। তবে এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ দায়ের করেননি তিনি।

এ ঘটনার আগে ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে বড়লেখা পৌরশহরে একই কায়দায় এক কাতার প্রবাসীর স্ত্রীর কাছ থেকে ৭৩ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় ভয়ংকর চক্রটি। পুরো ঘটনাটি সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে।

জানা যায়, উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের বড়থল গ্রামের কাতার প্রবাসী ছুয়াব আলীর স্ত্রী ছাবিয়া বেগম ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটের সময় পূবালী ব্যাংক বড়লেখা শাখা থেকে ৭৫ হাজার টাকা উত্তোলন করেন। টাকা উত্তোলনের পর তিনি ব্যাংক থেকে বের হয়ে বড়লেখা পৌরশহরের লক্ষ্মী মিষ্টি ঘরের সামনে পৌঁছালে ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি হঠাৎ ছাবিয়ার মাথা ও মুখে হাত বুলিয়ে বলেন- ‘আমি নামাজ পড়তে আসছি।’ এসময় ছাবিয়া ওই ব্যক্তির পাশ কাটিয়ে একটু এগিয়ে গেলে এক যুবক তার পথ আগলে বলে- ‘ওই বাবা কী বলেছেন? উনি অনেক বড় পীর।’

পরে ওই যুবক ছাবিয়াকে ওই ব্যক্তির নিকট নিয়ে যায়। এসময় ছাবিয়া দেখতে পান- ৫০ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তির টাকা হাতে নিয়ে ফু দিয়ে ফেরত দিচ্ছেন। তখন ওই ব্যক্তি ছাবিয়াকে বলেন- ‘তোমার নিকট টাকা আছে। টাকাটা দেও। টাকা পড়ে (ফু) দেই। টাকায় বরকত হবে।’

তখন ছাবিয়া সম্মোহিতের মতো তার কাছে থাকা ৭৫ হাজার টাকা ওই ব্যক্তির হাতে তুলে দেন। পরে ওই ব্যক্তি টাকাগুলোর মধ্য থেকে দুটি নোট  ছাবিয়ার ভ্যানিটি ব্যাগে দিয়ে বলেন- ‘পেছন দিকে তাকাবি না, হাটতে থাক।’

কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পরই ছাবিয়ার যেন হুশ ফিরে। পেছন ফিরে দেখতে পান- ওই ‘দরবেশ বাবাও’ নেই, তার ভ্যানিটি ব্যাগে ২ হাজার টাকা ছাড়া আর কোনো টাকাও নেই।

ছাবিয়া বেগমের ছেলে আব্দুজ আজিজ স্থানীয় সাংবাদকিদের বলেন- আমরা থানায় লিখিত অভিযোগ করেছি। পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ আটক হয়নি, টাকাও উদ্ধার হয়নি।


সিলেটভিউ২৪ডটকম / ডি.আর