সিলেট শহর থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকে মহাসড়ক ধরে এগোলে কিছু সময় পরেই দক্ষিণ সুরমা উপজেলার শেষপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া যায়। এই প্রান্তে থাকা লালাবাজার এলাকায় নিজের বসতবাড়িতে নলকূপ বসাচ্ছিলেন কটাই মিয়া। মিস্ত্রি তাকে মাটির নিচে তিনশ ফুটের মধ্যে ভালো পানি পাওয়া যাবে বলে আশ্বস্ত করেছিল। কিন্তু ‘ভালো’ দূরে থাক, তিনশ ফুটের মধ্যে ব্যবহারযোগ্য পানিও পাননি তিনি! শেষমেশ পাঁচশ আশি ফুটে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত পানি পেয়েছেন কটাই মিয়া। এজন্য তার খরচ বেড়েছে অনেক, সাথে আছে দুশ্চিন্তাও যে ভূগর্ভে পানির এই স্তর থেকে কতোদিন তিনি পানি উত্তোলন করতে পারবেন।

এই দুশ্চিন্তা একা শুধু কটাই মিয়ার নয়। প্রায় গোটা সিলেটজুড়েই এখন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া নিয়ে আছে মাথাব্যথা।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আশঙ্কাজনকভাবে সিলেট নগরী ও বিভিন্ন উপজেলায় পানির ভূগর্ভস্থ স্তর নিচে নামছে। ফলে সাধারণ নলকূপ (টিউবওয়েল) বসিয়ে এখন সুপেয় পানির সন্ধান মিলছে না, বসাতে হচ্ছে গভীর নলকূপ। শুধু তা-ই নয়, কোনো কোনো উপজেলায় আগে স্থাপিত নলকূপ দিয়ে এখন পানি উত্তোলন কঠিন হয়ে পড়েছে।

দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লালাবাজারের ৬১ বছর বয়সী কটাই মিয়া সিলেটভিউকে বলছিলেন, “সম্প্রতি আমি বাড়িতে নতুন নলকূপ বসিয়েছি। আশা ছিল তিনশ ফুটের মধ্যে ভালো পানি পাবো। কিন্তু পানির স্তর এতোটাই নিচে নামছে যে প্রায় ছয়শ ফুটে আমাকে যেতে হয়েছে।”

সাম্প্রতিক সময়ে এমন পরিস্থিতি ঘন ঘন দেখছেন বলে উল্লেখ করলেন এই বৃদ্ধ, “আগে তো এরকম ছিল না। সাধারণ নলকূপ দিয়ে পানি পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন আশপাশের যে বা যারাই সাধারণ নলকূপ বসাচ্ছেন, তারা সুপেয় পানি পাচ্ছেন না। গভীর নলকূপ ছাড়া যেন গত্যন্তর নেই। এভাবে কতোদিন চলা যাবে, সেটা নিয়েও আছে দুশ্চিন্তা।”

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সিলেটের সদর, দক্ষিণ সুরমা, বিশ্বনাথ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাটসহ বিভিন্ন উপজেলায় এবং মহানগরীর বেশকিছু এলাকায় পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। ফলে পুরনো নলকূপগুলোতে এখন পানির প্রবাহ কমে গেছে। বাধ্য হয়ে এসব এলাকার বাসিন্দারা গভীর নলকূপের দিকে ঝুঁকছেন। গভীর নলকূপ বসিয়ে সাবমারসিবল পাম্প বসিয়ে পানি তুলছেন তারা।

বিশ্বনাথ উপজেলার কামালপুর গ্রামের সাবেক কলেজ শিক্ষক বাবরুল হোসেন সিলেটভিউকে বলেন, “বাড়িতে সাধারণ নলকূপ বসিয়ে সুপেয় পানি পাইনি। বাধ্য হয়ে গভীর নলকূপ বসাতে হয়েছে। আমার বাড়ি থেকে দুইশ গজ দূরে আমার চাচাতো ভাইকেও গভীর নলকূপ বসিয়ে সাবমারসিবল মটর দিয়ে পানি তুলতে হচ্ছে।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গভীর নলকূপের ব্যবহার বৃদ্ধি, সাবমারসিবল পাম্প দিয়ে পানি উত্তোলন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তন, খরার আধিক্য প্রভৃতি কারণে পানির স্তর নিচে নামছে। সিলেটের কোনো কোনো এলাকায় বিগত কয়েক বছরে পানির স্তর ৩০-৪০ ফুট নিচে নেমেছে। এই নামার ধারা প্রতিনিয়তই চলছে।

সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) সূত্র থেকে জানা গেছে, মহানগরীর পুরনো ওয়ার্ড ২৭টি। সঙ্গে নতুন যুক্ত হয়েছে ১৫টি। এসব ওয়ার্ডে প্রায় ২০ লাখ মানুষের বাস। কিন্তু সিসিক তাদের সবাইকে পানি সরবরাহ করতে পারছে না। ৪১টি গভীর নলকূপ বসিয়েও কূল পাচ্ছে না সিসিক। বর্তমানে প্রায় পাঁচ কোটি লিটার পানির চাহিদা থাকলেও সরবরাহ করা যাচ্ছে অর্ধেকের মতো।

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান সিলেটভিউকে বলেন, “ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে, এটা সত্য। এর প্রকৃত কারণ বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। আমাদের আওতাধীন এলাকাগুলোতে আমরা পানি সরবরাহ নিশ্চিতের চেষ্টা করছি। এজন্য সিলেট ওয়াসা গঠন করা হয়েছে, এর কার্যক্রম শুরু হবে শিগগিরই।”

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আলমগীর হোসেন সিলেটভিউকে বলেন, “পানির স্তর কয়েক বছর ধরেই নিম্নমুখী। এটা শুধু সিলেটেই নয়, সারাদেশেই।”

তিনি বলেন, “সিলেটে পানির সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে গভীর নলকূপের ব্যবহার বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে সাবমারসিবল মটরের ব্যবহারও। কিন্তু সাবমারসিবল মটর দিয়ে যে হারে পানি তোলা হচ্ছে, এটাও বিপজ্জনক। কারণ, ভূগর্ভ থেকে যে হারে পানি ওঠছে, সে হারে পুনর্ভরণ হচ্ছে না।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূগর্ভস্থ পানি স্তর নেমে যাওয়ার ফলে একটি শূন্যস্থান দেখা দিতে পারে, যাকে ভূতত্ত্বের ভাষায় ‘কম্পাউন্ড কোন অব ডিপ্রেশন’ বলা হয়।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কাজী মতিন আহমেদ বলেন, “ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ অসীম নয়। সরকারকে অবশ্যই জাতীয় অগ্রাধিকার বিবেচনায় এর ব্যবস্থাপনা করতে হবে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনার একটি আদর্শ নিয়ম হলো, পানি উত্তোলনের পরিমাণ কখনোই রিচার্জের (পুনর্ভরণ) পানির চেয়ে বেশি হতে পারবে না।”

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “প্রতিবছর পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, যা প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে। নলকূপনির্ভরতা কমিয়ে ভূ-উপরিভাগের পানির উৎপাদন বাড়ানোয় জোর দেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে সংকট কাটবে না।”

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে