:: ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল ::

মুসলমানদের জন্য জাকাত একটি অবশ্যপালনীয় ফরজ বিষয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের অধিকারী হলে সেটি জাকাত পাওয়া যোগ্য ব্যক্তিদের বণ্টন করা মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যকরনীয় আমল। এতে সম্পদ পরিশুদ্ধ হয় এবং মুসলমান হিসেবে আমাদের বিশ্বাস যে আমাদের সম্পদের মধ্যে দুঃস্থ ও অসহায় মানুষের অধিকার রয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে কোন দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি সাথে সাথে সে দেশের ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য হ্রাসকে আলোকপাত করা হয়। জাকাতের মাধ্যমে এ বৈষম্য হ্রাস পায়। মুসলমান হিসেবে আমাদের বিশ্বাস মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তিনি দান করেছেন।


তিনি আমাদের চোখ, হাত, পা, কান মস্তিষ্ক দান করেছেন এবং আমরা কেউই নিজেকে নিজে সৃষ্টি করিনি। আমাদের অর্থ সম্পদ তাঁরই দান। আমরা বিশ্বাস করি তিনি আমাদের পরীক্ষা করছেন এবং আমরা সবাই মহান আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তনকারী, এইসব কিছুর ব্যাপারে একদিন আমরা জিজ্ঞাসিত হব।

আমাদের অর্থ, আমাদের অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ মহান আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যবহার করবো, এটাই আমাদের বিশ্বাস। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভের সুযোগ পাচ্ছি বলে আমরা বিশ্বাস করি। ব্যক্তি জীবনে একজন মুসলমান হিসেবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মানব- সম্পদ উন্নয়ন, মানব-আত্মার উন্নয়ন, চারিত্রিক উন্নয়ন, একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের একাগ্রতার উন্নয়ন ইত্যাদি সবকিছুই কাম্য।

মুসলিম হিসেবে জাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্য সিলেট শহরের আখালিয়ার সুরমা আ/এ ও খুলিয়াপাড়ার তিনটি ঘটনা প্রবাহের আলোচনা করা হলো:

১. সুরমা আবাসিক এলাকা মসজিদে প্রায় ৮০ বছরের একজন দরিদ্র মানুষ নামাজ পড়তেন। পুরাতন তালিযুক্ত কাপড় দেখে তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে অনুমান করা যেতো। তিনি আজ পৃথিবীতে নেই। থাকতেন ছোট একটি কুড়ে ঘরে। একদিন ঘটানাক্রমে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান শরীর দূর্বল হয়ে আসায় তিন বেলা ভাত খাওয়া ছাড়া তিনি চলতে পারেন না এবং গত ৭ দিন যাবত ১০ টাকা দিয়ে ক্রয়কৃত টমেটো ভর্তা দিয়ে তিনি ভাত খাচ্ছেন। ভ্যান চালক সন্তানের পক্ষে (৭/৮ জন সন্তানের পিতা) তার ভরণপোষণ অত্যন্ত কষ্টকর। তিনি জানালেন তাঁকে সাহায্য করার মত কোন আত্মীয় স্বজন নেই। জাকাতের কিছু অর্থ কিছু মাস দেয়া হলে কৌতুহলী প্রশ্ন করেন, “আমাকে যে এত মায়া করার হয় এর উদ্দেশ্য কি?”- উত্তরে জাকাতের কথা বলা হলে তিনি বলেন “এটা তো ধনী মুসলমানদের দিতে হবেই।”

তিনি আজ আর নেই। মৃত্যুর কিছু দিন আগে জানালেন “ যতদিন বেঁচে থাকবো দোয়া করবো।” ধনী এলাকার মুসল্লী হবার পরও কেন তিনি টমেটো ভর্তা দিয়ে ৭ দিন ভাত খাবেন? উল্লেখ্য, পার্ক-ভিউ মেডিক্যাল কলেজের চক্ষু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. জামিল আহমেদ উক্ত দরিদ্র মানুষটিকে জাকাত প্রদান করেন।

২. দরিদ্র ধার্মিক ব্যক্তিটি মৃত্যুবরণ করার পর প্রায় ৭৫ বছর বয়স্কা তাঁর স্ত্রী অসহায় হয়ে গেছেন। বহু সন্তানের জনক ভ্যান চালক পুত্রের জন্য মায়ের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা সত্যিই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। পুত্রবধু শ্বাশুড়িকে জানিয়েছেন শ্বশুর মারা যাবার পর ৪০ দিনের বেশী বৃদ্ধার ভরপোষণের দায়িত্ব নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

৩. খুলিয়াপাড়া আবাসিক এলাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় একজন অসহায় অত্যন্ত দরিদ্র মহিলা আছেন যিনি ভিক্ষার জন্য খুলিয়াপাড়া এলাকায় প্রায়ই আসেন। এলাকার অনেকেই মহিলাটিকে পাগলী বলে ডাকেন। হঠাৎ দেখা হলে বলতেন স্যার আজ দুদিন যাবৎ কিছু খাইনি। আমাকে সাহায্য করেন।

একদিন বললেন “ বাসায় কাজ করার সময় গরম পানি পড়ে আমার পা পুড়ে গেছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। কয়েকদিন যাবৎ মসজিদের সামনে আসছি কিন্তু চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন পরিমাণ সাহায্য পাচ্ছি না।” শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. রেজা সেলিমের জাকাতের ৫/৬ হাজার টাকার খরচ করার মাধ্যমে তিনি সুস্থ হলেন।

অন্যদিনের ঘটনা। ঐ মহিলা খুলিয়াপাড়া মসজিদের সামনে এসে কাঁদছেন। সাথে কিছু কাপড়, বালিশ, হাঁড়ি-পাতিল, কাঁথা ইত্যাদি। বললেন “ করোনার কারণে কলোনীর বাসা ভাড়া বাবদ ৫০০ টাকা দুই মাস যাবৎ দিতে পারিনি। তাই আমাকে বের করে দেয়া হয়েছে।”

শা.বি.প্র.বি এর কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ড. মোঃ শহিদুর রহমান এবং অধ্যাপক ড. রেজা সেলিমের জাকাতের/ সদকার টাকায় এ যাত্রা রেহাই পেলেন। এ ধরনের ঘটনা আমাদের সমাজের নৈমিত্তিক ঘটনা। ধনী ব্যক্তির জাকাতের টাকায় এ ধরনের সমস্যার সমাধান হতে পারে। সবার পক্ষে বিভিন্ন কারণে কাজ করে খাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। অসহায় মানুষের সাহায্যে জাকাতের গুরুত্ব এবং মসজিদ কেন্দ্রিক জাকাত বণ্টন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা হলো নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ জনাব ডা. মুনাজ্জির আলীর সাথে। তিনি সুরমা আবাসিক এলাকা মসজিদের মসজিদ কমিটির সভাপতি। ব্যক্তি পর্যায়ে আলোচনা হলো কিভাবে সুরমা এলাকার জাকাত বণ্টন করা যায় এ বিষয়ে। মসজিদ কেন্দ্রিক জাকাত বণ্টনের জন্য একটি প্রস্তাবিত পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হলো।

পদ্ধতিটির বর্ণনা দেয়া হলো : ধরুন, সুরমা আবাসিক এলাকায় ২০টি পরিবার আছে, যারা যাকাত পাবার যোগ্য। ধরে নিলাম, প্রতিটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫ জন। তাহলে সুরমা আ/এ যাকাত পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তির সংখ্যা (২০দ্ধ৫) = ১০০ জন। ধরে নিলাম চাল-ডাল ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য প্রতি ব্যক্তি মাসে ৬০০ টাকা পেলে কোন রকম চলতে পারেন।

তাহলে প্রতি মাসে জাকাতের অর্থ প্রয়োজন সুরমা এলাকা (৬০০*১০০)=৬০,০০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মাসে জাকাতের ৬০,০০০ টাকা প্রদান করা সম্ভব হলে নিতান্ত দরিদ্র মানুষগুলোর বেসিক প্রয়োজন সমাধান হবে অথবা এই টাকা হলে বেসিক প্রয়োজন মেটাতে কিছুটা হলেও সহায়তা করবে। বছরে অর্থের প্রয়োজন= (৬০,০০০*১২) = ৭,২০,০০০ টাকা।

সুরমা আ/এ মসজিদে নামাজ পড়েন এমন ধনী ব্যক্তি আছেন অনেকেই। ধরে নেয়া যাক, ৭ জন সমমনা ব্যক্তি একমাত্র আলাহর সন্তুষ্টির জন্য জাকাত দিয়ে আগ্রহী। এক্ষেত্রে ধরে নেয়া যাক, প্রথম ব্যক্তি জাকাত দেয়ার জন্য তৈরী ২৫ জনের। ২য় ব্যক্তি দায়িত্ব নিলেন ২০ জনের। ৩য় ব্যক্তি দায়িত্ব নিলে ১৫ জনের, ৪র্থ ব্যক্তি দায়িত্ব নিলেন ১৪ জনের, পঞ্চম ব্যক্তি দায়িত্ব নিলেন ১৩ জনের, ৬ষ্ঠ ব্যক্তি দায়িত্ব নিলেন আরও ১০ জনের এবং ৭ম ব্যক্তি দায়িত্ব নিলেন ৩ জনের। সুরমা আ/এ মসজিদের মুসল্লি সমমনা উক্ত ৭ ব্যক্তি যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য নিজ উদ্যোগে এবং স্বতস্ফূর্তভাবে জাকাত আদায় করেন তবে সুরমা এলাকার দরিদ্র জনগণের দুঃখ লাঘবে ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও দান- সদকাও করা যেতে পারে। তাহলে, ১ম ব্যক্তির প্রয়োজন মাসে (২৫*৬০০) = ১৫,০০০ টাকা. ২য় ব্যক্তির প্রয়োজন (২০*৬০০) = ১২,০০০ টাকা, ৩য় ব্যক্তির প্রয়োজন (১৫*৬০০) = ৯,০০০ টাকা, ৪র্থ ব্যক্তির প্রয়োজন (১৪*৬০০) =৮,৪০০ টাকা, ৫ম ব্যক্তির প্রয়োজন (১৩*৬০০) = ৭,৮০০ টাকা, ৬ষ্ঠ ব্যক্তির প্রয়োজন (১০*৬০০) = ৬,০০০ টাকা এবং ৭ম ব্যক্তির প্রয়োজন (৩*৬০০) = ১,৮০০ টাকা। অর্থ এবং খাদ্যদ্রব্য বণ্টন হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজ উদ্যোগে।

 

মসজিদ কমিটির হয়তো প্রয়োজন নেই। সমমনা ব্যক্তিগণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে জাকাত প্রদান করে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেন। সুরমা আবাসিক এলাকা মসজিদে নামাজ আদায় করেন এমন অনেক ধনী মুসল্লী আছেন যাদের পক্ষে জাকাতের অর্থ প্রদান করা সম্ভব। অন্যান্য মসজিদেও সমমনা মসুল্লির মাধ্যমে এলাকা ভিত্তিক জাকাত বণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব এবং এতে মসজিদের সাথে দরিদ্র জনগণের সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে এবং এটা হতে পারে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে সাফল্য লাভের উপায়।

আমরা অনেকে হয়তো বিলাসী জীবনে অভ্যস্থ। বিলাসবহুল বাড়ী নির্মাণে শতকোটি টাকা ব্যয় করতে সক্ষম এবং অত্যন্ত মূল্যবান গাড়ী ক্রয়ের মাধ্যমে আনন্দবোধ করি। মুসলিম হিসেবে আমরা যদি জাকাত আদায় করি, দান-সদকা করি এবং এর মাধ্যমে যদি দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীর অভাব মোচন হয়, তবে আমরা পেতে পারি এক স্বর্গীয় অনুভূতি।

লেখক : অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।