শমশের বক্স। সিলেট মহানরীর ১৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ও জিন্দাবাজার মুক্তিযোদ্ধা গলি ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি। আমার আপন খালাতো ভাই। অত্যন্ত হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল, একজন বন্ধুবৎসল মানুষ। তার হাসিটা ছিল দারুণ চমৎকার। এখনও তার হাসিমাখা মুখটি আমার চোখে ভাসে।

জিন্দাবাজারের দিকে গেলে আমাকে তার চোখে পড়লেই চিৎকার করে আমার নাম ধরে ডাক দিতো। ডাক তো নয় যেন ‘হায়দরি হাঁক’। তার ‘শের’ এর মত হুংকার উপেক্ষা করার সাধ্য আমার ছিল না। অগ্যতা তার দোকানে গিয়ে বসতেই হতো। শুরু হতো ম্যারাথন গল্পের আসর। গল্পে গল্পে সে হো হো করে হেসে উঠতো, মনে হতো পুরো দোকানটাই যেন ঝনঝন করে কেঁপে উঠছে।


গল্পের ফাঁকে ফাঁকে চলতো চা আর পান। আমি একটা পান খেতে খেতে সে ৩-৪ টা পান সাবাড় করে দিত। পানের প্রতি ছিল তার প্রচন্ড আসক্তি। একদিন বলেছিলাম-এত পান খাওয়া তো ঠিক না। উত্তরে সে বলেছিল-আরে ধুর! ভাত না দিয়েও কেউ যদি আমাকে পানদান সাজিয়ে দেয়-তাতেই আমি খুশি। জর্দা দিয়ে পান খেয়ে সে যখন কথা বলতো-তখন দোকানের ভেতরটা জর্দার ঘ্রানে ভরে যেত।

এই কিছুদিন আগেও সিলেটের ঐতিহাসিক কোর্ট পয়েন্টে শোভা পেতো সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের ফিরিস্তি সম্বলিত ডাউস সাইজের বিলবোর্ড। আওয়ামী লীগের অনেক নামিদামী নেতারা দল ক্ষমতায় থাকার সুবাদে বিভিন্নভাবে লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক হলেও সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের প্রচারে একটি টাকাও তাদের খরচ করতে দেখা যায়নি। অথচ কারো কোন সহযোগিতা ছাড়াই নিঃস্বার্থভাবে এক্ষেত্রে নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করতো শমশের বক্স। মাসে মাসে নিত্য নতুন বর্ণনায় নিজের মত করে প্রাঞ্জল কথামালা দিয়ে সাজানো বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের প্রশংসাসূচক এই বিলবোর্ড স্থাপন করতেন। যার মাধ্যমে জনগণের কাছে সরকারের ভাবমুর্তি উজ্জল করার অদম্য ভূমিকা পালন করতেন বঙ্গবন্ধু অন্তপ্রাণ এই কর্মী ।

মানুষের প্রশংসা করার অসাধারন একটি গুন ছিল তার । ২০১২ সালে যখন আমরা গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে মতবিনিময় করতে যাই তখন সেও ১৪ নং ওয়ার্ড থেকে সেই সভায় উপস্থিত ছিল। এর কিছুদিন পর তার দোকানে গেলে সে তার আশেপাশের ব্যবসায়ীদের ডেকে এনে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে স্বগর্বে বলেছিল-“এটা আমার আপন খালাতো ভাই, আওয়ামী লীগ নেতা, গণভবনে ফাটাফাটি বক্তৃতা করে প্রধানমন্ত্রীকে অবাক করে দিয়েছিল।” ঐ সময় তার প্রশংসায় সাময়িক বিব্রতবোধ করলেও অন্যের প্রশংসা করার তার অসাধারন ক্ষমতা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।

অনাথ শিশুদের প্রতি ছিল তার অসাধারন মমতা। বছরে ৩-৪ বার সে প্রান্তিক শিশুদের দাওয়াত করে খাওয়াতো। হঠাৎ একদিন দেখা যেত ভাত-মাছ-মাংসের আয়োজন চলছে এবং কোথা থেকে ৫০/৬০ জন ছিন্নমূল শিশু এসে খাওয়া শুরু করেছে। এলাকার ঐসব ছিন্নমূল শিশুরা তাই তাকে প্রাণভরে ভালবাসতো আর শ্রদ্ধা করে ‘ভাইয়া’ বলে ডাকতো। কখনো রাস্তাঘাটে দেখা যেত কোন ছিন্নমূল শিশু তাকে সালাম দিয়ে বলছে-“ভাইয়া খবর উবর আছে নি? সেও মুচকি হেসে জবাব দিত-“অইবো-অইবো….।’’

জনদরদী, দুঃখী মানুষের পরম বন্ধু আমার এই ভাইটি দীর্ঘ দেড় বছর দূরারোগ্য ব্যধি ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে গত ২২ অক্টোবর (শুক্রবার) রাত সাড়ে দশটায় সবাইকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে গেল । তাঁর মৃত্যুতে আত্নীয়রা হারালেন তাঁদের প্রিয় স্বজনকে, এলাকাবাসী হারালেন তাঁদের বিপদের বন্ধু একজন প্রিয় প্রতিবেশীকে। আওয়ামী লীগ হারালো তাদের একজন একনিষ্ট কর্মীকে আর অনাথ শিশুরা হারালো তাঁদের পরম প্রিয় ‘ভাইয়া’কে।

দোয়া করি মহান রাব্বুল আলামীন যেন আমাদের এই ভাইটিকে পরম শান্তিতে বেহেশতে ঠাঁই দেন। আমীন।

 

লেখক: ইসমাইল মাহমুদ সুজন, সাধারণ সম্পাদক, ২১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ।