বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উৎপাদনশীল খাতে প্রবাসীগণের বিনিয়োগের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পায়নের স্বার্থে প্রবাসীগণকে দেশে বিনিয়োগে উৎসাহ প্রদান করা প্রয়োজন। প্রবাসীগণের উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্প কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। দেশে প্রবাসীগণের উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে যে সুবিধাগুলো পাওয়া যাবে সেটিকে কয়েকটি দিক থেকে পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

প্রথমত, উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্রতা হ্রাস পাবে এবং সম্পদের সুষম বন্টন সম্ভব হবে।


দ্বিতীয়ত, প্রবাসীগণের সাথে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক অটুট থাকবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ইতিমধ্যেই প্রবাসীগণের পরবর্তী প্রজন্মের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক হ্রাস পেয়েছে। দেশে বিনিয়োগ, অর্থপ্রদান, যোগাযোগ ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রেই প্রবাসীগণের পরবর্তী প্রজন্মের আগ্রহ হ্রাস পেয়েছে। তারা অনেকেই যে দেশে অবস্থান করছেন সেখানেই ব্যবসা বাণিজ্য, বাড়ী নির্মাণ অথবা ক্রয়, বিনিয়োগ ইত্যাদি করতে আগ্রহী। প্রবাসীগণকে উৎসাহ প্রদান এবং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশে উপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করানো গেলে দেশের সাথে পরবর্তী প্রজন্মের সম্পর্ক অটুট থাকবে এবং বৃদ্ধি পাবে আশা করা যায়। এতে শক্তিশালী হবে দেশের অর্থনীতি। সুতরাং বাংলাদেশের স্বার্থে বিষয়টি বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, দেশে শিক্ষিত বেকার শ্রেণীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। দেশে প্রচুর সংখ্যক কর্মহীন শিক্ষিত যুবক রয়েছেন। পড়ালেখা শেষ করে দীর্ঘদিন যাবৎ আশানুরূপ কর্মসংস্থান না হবার ফলে অনেকেই হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। কয়েকজন ছাত্রের কাছে জানা গেলো, বিগত ১২ বছরে সিলেট অঞ্চলের দুটি কলেজ থেকে চারটি বিষয়ে স্মাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেছেন প্রায় ৬,৫০০ জন। আরও জানা গেলো স্কুল-কলেজে শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, ব্যাংকে চাকুরী, ছোট-বড় বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী, বিদেশগমন ইত্যাদি মিলে প্রায় ৫০% ছাত্র-ছাত্রীর কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। শিক্ষিত বেকারের মধ্যে অনেকেই গ্রামে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছেন। অনেকেই দিয়েছেন মুদি দোকান, কাপড়ের দোকান, স্টুডিও ইত্যাদি। অনেকেই কম্পিউটার সংক্রান্ত কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। অনেকেই মোটর সাইকেল শেয়ারিং করে আয়-উপার্জন করেন। কেউ কেউ গ্রাফিকসের কাজ করছেন, পার্টটাইম কাজ করছেন, টিউশনি করছেন। জানা গেলো, অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে হোটেলে কাজ এবং গ্রামে গিয়ে ছোট-খাটো কাজ করছেন। শিক্ষিত বেকার হয়ে গ্রামে ফিরে ছোট-খাট কাজ করলে অনেক ক্ষেত্রেই শুনতে হচ্ছে কটু কথা। এসবই হচ্ছে বাস্তবতা। প্রবাসীগণের মাধ্যমে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হলে অসহায় শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি এর উদ্যোগে “সিলেট অঞ্চলে প্রবাসী বিনিয়োগ: একটি সামগ্রিক পর্যালোচনা” নামক একটি গবেষণামূলক কার্যক্রমে গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত হবার সুযোগ হয়েছিলো। গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে সিলেট অঞ্চলে রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিলো যথাক্রমে ১২.৮৯৯.৫৫ কোটি টাকা এবং ১১,৩২৩ কোটি টাকা। এসব অর্থের বড় অংশ ব্যয় হয় পারিবারিক ব্যয় নির্বাহে ও ভোগ বিলাসে এবং এর ফলে দ্রব্যমূল্য এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সিলেট অঞ্চলের ব্যাংকগুলোতে ঋণ আমানতের পরিমাণ মাত্র প্রায় ২৫%। অর্থাৎ প্রাপ্ত আমানতের মাত্র প্রায় ২৫% বিনিয়োগ হচ্ছে। শিল্প ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬%। গবেষণা রিপোর্টে ২০টি খাতকে সিলেট অঞ্চলে সম্ভাব্য বিনিয়োগের খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।। খাতগুলো হলো আগর আতর শিল্প, সিরামিক শিল্প, রাবার শিল্প, কৃষিজাত শিল্প, পর্যটন শিল্প, কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনশীল শিল্প, ব্যাটারী ও টায়ার উৎপাদন, ইট উৎপাদন, প্লাস্টিক শিল্প, ক্যাবল ইন্ডাষ্ট্রি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, জৈব সার কারখানা ইত্যাদি। রিপোর্টে প্রবাসী বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, জমি সংক্রান্ত সমস্যা, প্রারম্ভিক মূলধনের অভাব, অনুন্নত সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ, ঝুঁকিগ্রহণের অনীহা, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার অভাব ইত্যাদিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকারী হিসেবে ১ কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশী প্রবাসে থাকেন। বাংলাদেশের স্বার্থেই সরকারী এবং বেসরকারী উদ্যোগের মাধ্যমে প্রবাসীগণের উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ এবং এর সফল বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

২০২০ সালে বাংলাদেশে প্রাপ্ত মোট রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিলো প্রায় ১,৮৬,৫০০ কোটি টাকা যা দেশের জি.ডি.পি এর প্রায় ৬.৬%। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে সর্বমোট রপ্তানির পরিমাণ ছিলো ৪,০৩,৫৬০ কোটি টাকা। ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে বাংলাদেশের বাজেট ধরা হয়েছে ৬,০৩,৬৮১ কোটি টাকা। এসকল তথ্য থেকে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে রেমিটেন্সের গুরুত্ব এবং প্রভাব অনুমান করা যায়। বিশ্বে প্রবাসীগণের মাধ্যমে রেমিটেন্স প্রাপ্তির দিক থেকে প্রথম অবস্থানে আছে ভারত। ২০২০ সালে ভারতের মোট রেমিটেন্স প্রাপ্তির পরিমাণ ছিলো প্রায় ৭,১০,৫০৫ কোটি টাকা। দ্বিতীয় স্থানে আছে চীন এবং চীন এর রেমিটেন্স প্রাপ্তির পরিমাণ ২০২০ সালে ছিলো প্রায় ৫,০৮,৭২৫ কোটি টাকা। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে মেক্সিকো এবং রেমিটেন্স প্রাপ্তির পরিমাণ ছিলো ২০২০ সালে প্রায় ৩,৬৬,৭৯৫ কোটি টাকা। চতুর্থ এবং পঞ্চম অবস্থানে আছে ফিলিপাইন এবং মিশর এবং ২০২০ সালে ফিলিপাইনের রেমিটেন্স প্রাপ্তির পরিমাণ ছিলো প্রায় ২,৯৮,৩৯৫ কোটি টাকা এবং মিশরের রেমিটেন্স প্রাপ্তির পরিমাণ ছিলো প্রায় ২,৫৩,০৮০ কোটি টাকা। ষষ্ঠ স্থানে ছিলো পাকিস্তান এবং ২০২০ সালে পাকিস্তানের প্রাপ্ত রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিলো প্রায় ২,২৩,১৫৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে রেমিটেন্স প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো অষ্টম। ২০২০ সালে প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল, ভুটান এবং মালদ্বীপের রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিলো যথাক্রমে প্রায় ৬৯,১৯৬ কোটি টাকা, ৯৯২ কোটি টাকা এবং ৮৩০ কোটি টাকা।

২০২০-২০২১ অর্থবছরের রেমিটেন্স বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশে মোট রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিলো প্রায় ২,১৩,০০ কোটি টাকা। রেমিটেন্স পাঠানোর দিক বিবেচনায় প্রথম অবস্থানে আছেন সৌদিআরবে অবস্থানরত প্রবাসীগণ। সৌদিআরবে অবস্থান করছেন প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশী প্রবাসী। গত অর্থবছরে সৌদিআরব থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে এসেছে প্রায় ৪৮,৯২৩ কোটি টাকা যা দেশের মোট রেমিটেন্সের প্রায় ২২.৯৭%। গড়ে প্রতি মাসে সৌদিআরবে অবস্থানরত প্রবাসীগণ পাঠিয়ে থাকেন জন প্রতি প্রায় ১৬,৫০০ টাকা। রেমিটেন্স পাঠানোর দিক বিবেচনায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন আমেরিকায় অবস্থানরত প্রবাসীগণ। গত অর্থ বছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে আমেরিকা থেকে এসেছে ২৯,৫৯২ কোটি টাকা যা মোট রেমিটেন্সের প্রায় ১৩.৯%। আমেরিকায় অবস্থান করছেন প্রায় ৮ লাখ বাংলাদেশী। গড়ে প্রতি মাসে আমেরিকায় অবস্থানরত প্রতি প্রবাসী পাঠিয়েছেন প্রায় ৩৭,০০০ টাকা। রেমিটেন্স পাঠানোর দিক দিয়ে গত অর্থবছরে তৃতীয় স্থানে ছিলো সংযুক্ত আরব-আমিরাতে অবস্থানরত প্রবাসীগণ। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে প্রায় ২০,৮৬২ কোটি টাকা। প্রায় ১০.৬ লাখ প্রবাসী রয়েছেন সংযুক্ত আরব-আমিরাতে। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে গড়ে প্রতি মাসে প্রতি জন প্রবাসী পাঠিয়েছেন প্রায় ১৯,০০০ টাকা। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে প্রায় ১৭,৩০৫ কোটি টাকা। প্রায় ৯ লাখ প্রবাসী যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন এবং গড়ে প্রতি মাসে প্রতি জন পাঠিয়েছেন প্রায় ১৯,৩০০ টাকা। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত প্রবাসীগণের সাথে দেশের সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত ১০ লাখ প্রবাসীগণের মাধ্যমে গত অর্থবছরে দেশে এসেছে প্রায় ১৭,১১৭ কোটি টাকা এবং গড়ে প্রতি জন প্রবাসী প্রতি মাসে পাঠিয়েছেন প্রায় ১৪,৩০০ টাকা। ৭ লাখ প্রবাসীগণ ওমান থেকে প্রেরণ করছেন প্রায় ১৩,১৩৩ কোটি টাকা এবং গড়ে প্রতি জন প্রতি মাসে পাঠিয়েছেন প্রায় ১৫,৬৫০ টাকা। ৩.৫ লাখ প্রবাসীগণ কুয়েত থেকে পাঠিয়েছেন ১৬,০৮৩ কোটি টাকা এবং গড়ে প্রতি জন প্রতি মাসে প্রায় ৩৮,৩০০ টাকা পাঠিয়েছেন। ৪ লাখ প্রবাসীগণ কাতার থেকে পাঠিয়েছেন প্রায় ১২,৩৯৮ কোটি টাকা এবং গড়ে প্রতি জন প্রতি মাসে পাঠিয়েছেন প্রায় ২৫,৮৫০ টাকা। ইতালীতে অবস্থানরত ৪ লাখ প্রবাসী ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠিয়েছেন প্রায় ৬,৯৩৪ কোটি টাকা এবং গড়ে প্রতি জন প্রতি মাসে পাঠিয়েছেন প্রায় ১৪,৫০০ টাকা। বাহরাইনে অবস্থান করছেন প্রায় ২ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশী। গত অর্থ বছরে এসেছে প্রায় ৪,৯৪২ কোটি টাকা এবং প্রতি জন গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ২০,৬০০ টাকা পাঠিয়েছেন। সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত ১.৫ লাখ প্রবাসী পাঠিয়েছেন প্রায় ৫,৩৪৪ কোটি টাকা। গড়ে প্রতিমাসে প্রতি জন পাঠিয়েছেন প্রায় ২৯,৭০০ টাকা। অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন ৪২ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশী। গত অর্থবছরে পাঠিয়েছেন ১২১৪ কোটি টাকা এবং গড়ে প্রতি জন প্রতি মাসে পাঠিয়েছেন প্রায় ২৪,১০০ টাকা। জাপানের ৪০ হাজার প্রবাসী পাঠিয়েছেন ৬৮৪ কোটি টাকা। প্রতি জন প্রতি মাসে গড়ে ১৪,৩০০ টাকা পাঠিয়েছেন। জার্মানিতে অবস্থানরত ১৭ হাজার প্রবাসী পাঠিয়েছেন প্রায় ৫৭৩ কোটি টাকা। প্রতি জন প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ২৮,১০০ টাকা পাঠিয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থানরত প্রায় ১৩,২০০ জন প্রবাসী পাঠিয়েছেন ১৭৯৬ কোটি টাকা। প্রতি জন প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১,১৩,৫০০ টাকা পাঠিয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থানরত প্রবাসীগণ দক্ষিণ কোরিয়ায় স্থায়ী ভাবে বসবাসের সুযোগ না থাকায় দেশে প্রচুর পরিমাণ অর্থ প্রেরণ করে থাকেন।

যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন প্রায় ১৭ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশী। এছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রয়েছেন প্রচুর সংখ্যক প্রবাসী। বাংলাদেশে উৎপাদনশীল খাতে বৃহৎ আকারে প্রবাসী বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বৃহৎ প্রবাসী বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিকল্পনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সহ ইউরোপের শিল্পে উন্নত বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রায় ১৮ লাখ প্রবাসী হাতে পারেন “টার্গেট গ্রুপ”। প্রবাসী বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিকল্পনার জন্য সম্ভাব্য প্রবাসী বিনিয়োগকারীগণকে “সম্ভাব্য বৃহৎ বিনিয়োগকারী গ্রুপ” এবং “সম্ভাব্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী গ্রুপ” এই দুইভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। পৃথিবীর যে কোন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী প্রবাসীগণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী গ্রুপ এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী গ্রুপ এর প্রবাসীগণ কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য মূলধন সরবরাহ করতে পারেন।

প্রবাসী বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে “সম্ভাব্য বৃহৎ বিনিয়োগকারী গ্রুপ”-এর বিষয়ে পর্যালোচনা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আছেন প্রায় ১৮ লাখ প্রবাসী। ইংল্যান্ড এর জনপ্রিয় চ্যানেল এস এর চেয়ারম্যান জনাব আহমেদ উস-সামাদ চৌধুরী কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেলো, ইংল্যান্ড প্রায় ১৩ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশী আছেন যাঁরা ১০ কোটি টাকার অধিক বিনিয়োগ করতে সক্ষম। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে অনুমান করা যায় আমেরিকাতে প্রায় ২৭ হাজার প্রবাসী আছেন যাঁরা ১০ কোটির অধিক বিনিয়োগ করতে সক্ষম। ইউরোপের অন্যান্য দেশে এবং অস্ট্রেলিয়ায় ও জাপানে অবস্থান করছেন এবং ১০ কোটি টাকার অধিক বিনিয়োগ করতে সক্ষম এই সংখ্যা প্রায় ৪,০০০ জন প্রবাসী। ধরি, প্রতি জন যদি কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন। তাহলে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৪,৪০,০০০ কোটি টাকা। মোট বিনিয়োগযোগ্য অর্থের যদি কমপক্ষে ১০% বিনিয়োগ করাও সম্ভব হয়, তবে দেশে সম্ভাব্য বৃহৎ বিনিয়োগকারী গ্রুপের মাধ্যমে প্রায় ৪৪,০০০ কোটি টাকা প্রবাসী বিনিয়োগ সম্ভব। প্রবাসীরা যদি এ পর্যন্ত বিনিয়োগ করেন তবে সন্দেহ নেই এতে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অনেকাংশে কমে আসবে। বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য অঞ্চল ভিত্তিক সম্ভাব্য বিনিয়োগের খাত সনাক্ত করা প্রয়োজন। বিভিন্ন অঞ্চলের চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি এতে ভূমিকা রাখতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসীগণ তাঁদের নিজ এলাকায় বিনিয়োগের আগ্রহী হন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীগণ অনেক ক্ষেত্রে সিলেট অঞ্চলে বিনিয়োগে আগ্রহী থাকেন। সিলেট শহরের বিলাস বহুল হোটেল নির্মাণে এবং বিভিন্ন শপিং মল তৈরীতে ইতিমধ্যে প্রবাসীগণ কর্তৃক প্রেরিত অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে অবস্থিত বারাকা পাওয়ার লিমিটেড কোম্পানী, সিলেট শহরের রোজ ভিউ হোটেল, হবিগঞ্জের বাহুবলে অবস্থিত দি প্যালেস রিসোর্ট, সিলেটের খাদিমপাড়ায় অবস্থিত এক্সেলসিয়র হোটেল এন্ড রিসোর্ট- এ প্রবাসীগণের বিনিয়োগ রয়েছে।

বিদেশে অবস্থানরত সম্ভাব্য বৃহৎ বিনিয়োগকারীগণকে সনাক্ত করা এবং উদ্যোক্তাগণের সাথে তাঁদের যোগাযোগ প্রয়োজন। চেম্বার ও সরকারের উদ্যোগে বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত সম্ভাব্য বৃহৎ বিনিয়োগকারীগণের সাথে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন সম্ভাব্য বৃহৎ বিনিয়োগকারীগণের সাথে সম্ভাব্য উদ্যোক্তাগণের যোগাযোগ ও সংযোগ ঘটানো এবং রক্ষা করা। সম্ভাব্য উদ্যোগতাগণ প্রবাসী বিনিয়োগের জন্য প্রবাসীগণকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে সফল উদ্যোগতাগণের তাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন ব্যবসায়ের উদ্যোগের জন্য প্রবাসী বিনিয়োগকারীগণকে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে উদ্যোগতাগণের ভাবমূর্তি, বিশ্বাসযোগ্যতা ও সক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসীগণের প্রেরিত অর্থের অপব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় লক্ষ্য করা যায়। দেশে প্রবাসীগণের সম্পর্ক রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির জন্য নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির অভাব একটি সমস্যা। অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসীগ বিশ্বস্ত ব্যক্তির অভাবে প্রতারিত হন। সিলেট শহরের কয়েকটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্য নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের একটি বিরাট অংশ বিদেশে অবস্থানরত অভিভাবক ও আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে পাঠানো অর্থ দিয়া শিক্ষা সংক্রান্ত ব্যয় মিটিয়ে থাকেন। প্রবাসীগণের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো নিরসনের জন্য সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিটেন্স, রেমিটেন্সের সঠিক ব্যবহার এবং প্রবাসীগণের উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিকল্পিত উপায়ে রেমিটেন্সের সঠিক ব্যবহার ও বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন সম্ভব।

লেখক: অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।