সুরমা ও বরাক উপত্যকায় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে সুরমা নদীকে কেন্দ্র করে। এখানকার ভূতাত্ত্বিক গঠন, ভৌগলিক বিন্যাস, অভিবাসন, রাজনৈতিক ছন্দপতন সবকিছুরই আবর্তনের প্রাণভোমরা হচ্ছে সুরমা নদী। ফ্রাঙ্কেনস্টেইনের মতো অকৃতজ্ঞ মানুষরা নিজেদের স্বার্থে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের হাতে সুরমা বন্দি হওয়ার খবর জানলেও পাকিস্তানীদের হাতেও যে সুরমা বন্দী হয়েছিলো, পঙ্গুত্ব লাভ করেছিলো- সেটি কখনো জানা ছিলো না। সিলেটের বিশ্বনাথের খাজাঞ্চি নদীর খোঁজ নিতে জানা গেল সুরমার এক অজানা বেদনার অধ্যায়। উন্নয়নের নামে রেলপথ রক্ষার অজুহাতে  প্রমত্তা সুরমার প্রায় ৩৫ কিমি কিভাবে পঙ্গু করে কৃত্রিমভাবে প্রবাহিত করা হয়েছিল,কিভাবে খাজাংচি নদীকে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেওয়া হলো,  সে অজানা গল্পই এখানে তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে।   

 


সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক ধরে তেমুখী পয়েন্ট থেকে হাউসা পয়েন্ট পর্যন্ত সড়কের দক্ষিণ দিকে বয়ে চলা সুরমার যে প্রবাহ বর্তমানে রয়েছে, সেটি প্রকৃতপক্ষে সুরমার আদি ও প্রাকৃতিক প্রবাহ নয়। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, প্রাকৃতিক প্রবাহ কোন দিকে ছিলো, গেল কই  কিংবা বর্তমান প্রবাহ সৃষ্টি হলো কেমনে? দীর্ঘ অনুসন্ধান, প্রবীণদের অভিজ্ঞতা আর মাঠকর্মের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের খানিকটা  সবার সাথে ভাগাভাগি করা হলো।


সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের তেমুখী পয়েন্টের কাছে হযরত শাহজালাল রহ. (৩য়) সেতুর অবস্থান। তেমুখী পয়েন্ট পরেই টুকের বাজারের ঠিক দক্ষিণে সুরমার ওপারে রয়েছে মাসুকগঞ্জ বাজার। অনেকেই জানেন, সুরমার অন্যতম শাখা বাসিয়া নদী এখান থেকেই তাঁর যাত্রা শুরু করেছে। এটি সিলেট সদরের ১ নং টুলটিকর ইউনিয়নে অবস্থিত। এ বাজারের খানিকটা পশ্চিমে রয়েছে ডোয়ার বা ঢরা নামক স্থান যেখান থেকে মূলত: আদি প্রবাহের যাত্রাপথ ছিল। এরপর দক্ষিণ দিকে উত্তর গোপাল, কান্দিগাম, হরিপুর ইত্যাদি অতিক্রম করে ইউ টার্ণ নিয়ে উত্তর দিকে মোড় নিয়ে খাজাঞ্চিগাও, বাওনপুর হয়ে জাঙ্গাইল পয়েন্টে সুরমার বর্তমান প্রবাহপথে পশ্চিম দিকে খানিকটা অগ্রসর হয়। এরপর এটি ধনপুর পয়েন্টের দক্ষিণে কান্দিগাঁও থেকে দক্ষিণ দিকে ঘাষিগাঁও হয়ে বর্তমান খাজাঞ্চি বাজার পর্যন্ত গিয়ে পশ্চিম দিকে মোড় নেয় । সেখানকার মোড় থেকে সুরমার অন্যতম আরেক শাখা খাজাংচি নদী যাত্রা শুরু করে যেটি  সদর , বিশ্বনাথ ও ছাতকের উপর দিয়ে ২৭ কিমি দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ছাতকের দুলার বাজার ইউপিতে ডাউকা নদীতে পতিত হয়েছে।  সুরমার আদি প্রবাহপথ খাজাঞ্চিগাও থেকে আবার উত্তর দিকে কাবিলপুর, হাজারীগাঁও হাসাউরা পয়েন্টের কাছে আবার পশ্চিমে মোড় নেয়। এটাই সুরমার মূল, প্রাকৃতিক বা আদি প্রবাহপথ। বর্তমানে স্থানীয়দের কাছে এটি পুরাতন সুরমা নামে পরিচিত। 


অর্থাৎ টুকের বাজার থেকে জাঙ্গাইল পয়েন্ট পর্যন্ত সুরমার যে বর্তমান প্রবাহ, সেটি কৃত্রিম। আবার ধনপুর থেকে হাউসা পয়েন্ট পর্যন্ত সুরমার অংশটিও কৃত্রিমভাবে খনন করা। কিন্তু কে কিভাবে কখন নদীর উপর এ জুলুম করলো, তার তালাশ করতে পাওয়া গেল চমৎকার তথ্য। 

১৯৫৪ সালে অক্টোবর মাসে সিলেট-ছাতক রেল যোগাযোগ চালু হয়। এ রেল পথটি খাজাঞ্চি এলাকায় খাজাংচি নদীর উপর নির্মিত সেতু দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক বছর পর দেখা গেল যে, এ অংশে সুরমার ভাঙ্গন খুব বেশি। রেল কর্তৃপক্ষ সে ভাঙ্গন থেকে রেলপথ ও সেতুকে রক্ষার ব্যাপারে সম্ভাব্য বিকল্প খুজঁতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত সুরমা নদী তাঁদের চোখে পড়লো এবং সেটিকে কোরবান দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়। 

অবশেষে ১৯৬২-৬৩ সালের তারা সে কাজ শুরু করে। বলি হতে থাকে সুরমা। মাসুকের বাজার থেকে জাঙ্গাইল পর্যন্ত  খনন করে নদীর বাঁকা অংশকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। আবার ধনপুর থেকে হাসাউরা পর্যন্ত অংশে খনন করে নদীকে আদিপথ থেকে এদিকে প্রবাহিত করা হয়। আদি প্রবাহপথের মুখগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। 


এভাবে একটি রেলপথকে বাঁচানোর নামে সুরমা নদীকে তাঁর প্রাকৃতিক পথ থেকে সরানো হলো অত্যন্ত নির্দয়ভাবে। এতে এখান মূল প্রবাহপথের প্রায় ৩০/৩৫ কিমি পথের ভূপ্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটলো, নদী নির্ভর জীবন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হলো। বর্তমানে ২৭ কিমি দীর্ঘ খাজাংচি নদীর উৎসস্থল সুরমা থেকে বিচ্ছিন্ন। এতে আস্তে আস্তে মরে যাচ্ছে এ প্রমত্তা নদী। অপরদিকে সুরমার আদি প্রবাহপথ বর্তমানে ভরাট করা হয়েছে, দখলের মহোৎসব চলছে। সুরমার বর্তমান প্রবাহ চলুক তবে আদি প্রবাহপথ খুলে দেওয়া সময়ের দাবি।  


ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের হাতে এদেশের নদীগুলোর নিপীড়ণের অনেক গল্প জানতাম, কিন্তু পাকিস্তানীদের নদী ধর্ষণ আর হত্যার গল্পগুলো ছিল অনেকটাই অজানা। সুরমার উপর পরিচালিত নিপীড়ণ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, পাকিস্তানীদের জুলুম আর নিপীড়ণের গল্পগুলো কেবল মানুষের মধ্যেই সীমাবন্ধ ছিলনা , এদেশের প্রাণ, পরিবেশ ও প্রকৃতিকে তারা নির্দয়ভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীনতার প্রায় ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে কিংবা পরাধীন নদীগুলো এখনও মুক্তির স্বাদ পায়নি। পাকিস্তানীদের পরানো শেকল থেকে মুক্তি পাক সুরমা, নবপ্রাণে উদ্বেলিত হোক খাজাংচি নদী।

আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবসে এটাই আমাদের কামনা। 


লেখক - আব্দুল হাই আল-হাদী, লেখক, পরিবেশকর্মী।