ছয়শত বছর আগে বাংলার উত্তর পূর্বাঞ্চলের জনপদ সিলেটি প্রচলন হয়, সিলেটি নাগরীলিপি। এই লিপি ছিল এই অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবন চর্চা ও সাহিত্যে গৃহীত লিপি বা লিখনরীতি। দুর্ভাগ্য, এই লিপি ও সাহিত্যের এখন আর চল নেই সিলেটেই। এই লিপি সিলেটের ইতিহাস ও প্রাণে মিশে আছে। নাগরীলিপি সিলেটিদের অনন্য প্রতীক। কালের বিবর্তনে এই লিপির প্রচলন নেই, চর্চাও শুধু গবেষকদের আঙিনায় সীমাবদ্ধ। ‘নাগরীলিপি আড়াই দিনে হিখা যায়’-এই প্রবাদ অনেকটা কাজে লাগবে যদি ‘সিলেটি নাগরীলিপি শিক্ষা’ বইটি শুধু পড়ায় সীমাবদ্ধ না রেখে চর্চার স্তরে নিয়ে যাওয়া যেত।

২০১৪ সালের দিকে আমি এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে চোখ যায় বুকশেলফে সাজানো হলদেটে মলাটের অনেকগুলো বইয়ের দিকে। বইগুলোর নামের ভিন্নতা আমাকে ভাবায়। দু-একটি বই খুলে জানতে পারি এগুলো নাগরীলিপিতে লেখা, বাংলাতেও সেগুলো অনুবাদিত ছিল। তবে লিপিগুলোর পরিচয় সেসময় ক্ষুদ্রজ্ঞানে বের করা সম্ভব হয়নি। তবে এই লিপির অনেকগুলো বই চোখে পড়ায় মনে হয়- নিশ্চয় এটি দামি ও কঠিন। সেই ধারণা টিকেছিল এরপর আরও দেড় দশক। সিলেটভিউ২৪ডটকম-এ নাগরীলিপি সংশ্লিষ্ট অনেক সংবাদ, নিবন্ধ আমাদের প্রকাশ করতে হয়। এসব লেখনীতে উঠে আসতো নাগরীলিপি নিয়ে অমূল্যবার্তা। সংবাদ প্রকাশের কাজ ধীরে ধীরে আশ^স্থ করে নাগরীলিপি সিলেটের অলংকার। বিশ^বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির তাকে সাজানো নাগরীলিপির বেশ কয়েকটি বই-এর বহুল চর্চার জানান দেয় আমাকে।


স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সিলেটভিউ প্রকাশ করে ‘সুবর্ণযাত্রা’ নামের স্মারকগ্রন্থ। সেই স্মারকগ্রন্থ প্রকাশে স্নেহ ও সহযোগিতা পাই মোস্তফা সেলিমের। মোস্তফা সেলিম-যিনি নাগরীলিপির বিনিদ্র এক গবেষক। নাগরীলিপির শুধু গবেষণা নয়, এই লিপির পুনর্জাগরণ আরও বিস্তৃতি ও ব্যবহারের প্রচেষ্টায় অদ্বিতীয়। দেশে-বিদেশে গবেষণার ধারাবাহিকতায় এই লিপি নিয়ে তিনি অসংখ্য নিবন্ধ লিখেছেন, সেগুলো অবশ্যই অমূল্য। তবে শুধুমাত্র এই লিপি কেন্দ্র করে অক্লান্ত সাধনায় তিনি যতগুলো গ্রন্থ রচনা করেছেন-সেগুলো নাগরীলিপিকে বয়ে নিয়ে যাবে অনন্তকাল। মোস্তফা সেলিম ও তার সৃষ্টি নিয়ে জানান দিতে গেলে হয়তো অনেককিছু বাদ পড়ে যাবে তাই এই প্রচেষ্টা থেকে স্বেচ্ছায় বিরতি নিচ্ছি। তাকে জানান দেবে অন্তর্জালে থাকা অসংখ্য আয়োজন। গুগল, ইউটিউব, উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া আরও কত কি।

ফিরে আসি ‘সিলেটি নাগরীলিপি শিক্ষা’ বইয়ের সংক্ষিপ্ত আলোচনায়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এই বইটির প্রকাশক। মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের এই প্রকাশনার মাধ্যমে সিলেটি নাগরীলিপির জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক এক স্বীকৃতি হল। বইটির মুখবন্ধে সংক্ষেপে ভাষা, নাগরীলিপি ও মোস্তফা সেলিম সম্পর্কে হৃদয়গ্রাহ্য এবং প্রাণবন্ত কথা তুলে ধরেছেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ। প্রসঙ্গ-কথায় নাগরীলিপির ইতিহাস ও চর্চার বিষয় আকর্ষণীয় করে তুলেছেন মোস্তফা সেলিম। তিনি জানান দিয়েছেন, এই লিপির পরিচয়, প্রয়োগ ও বিস্তৃতির কথা। কিভাবে এটি চর্চা হতো, একসময় যেটি হয় সিলেটিদের প্রাণের লিপি। তিনি বলেছেন এই লিপি নিয়ে আরও গবেষণা ও গবেষকদের প্রাণান্তের কথা। প্রায় হারিয়ে যাওয়ার মতো ছিল নাগরীলিপি। তবে যা শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আবেগের সেটি হারিয়ে যাওয়ার নয়। তবে সত্যিকার অর্থে তার পুনর্জাগরণ হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে মোস্তফা সেলিম গবেষণা, প্রকাশনা ও নানা আয়োজনের মাধ্যমে এর নবজাগরণে কাজ করে চলেছেন। নাগরীলিপির বইপত্র প্রকাশের মাধ্যমে প্রায় নাগরীলিপির নমুনা ও সাহিত্য দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন নিরলসভাবে। প্রতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তাঁর ভূমিকা নন্দিত। তিনি এর নবজাগরণে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে চলেছেন। মোস্তফা সেলিমের এই ধারার কাজের একটি অনন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ এই বইটি। নাগরীলিপির বর্ণের সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক সেতুবন্ধন রচনা করলেন তিনি।

‘সিলেটি নাগরীলিপি শিক্ষা’ আমাদের ছোট্টবেলার আদর্শলিপির মতো। বইটি মোট পয়তাল্লিশ পাতার। সূচিপত্রের পর ১১ ও ১২ নম্বর পাতায় নাগরীলিপির স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ ও যুক্তবর্ণগুলো হৃদয়ঙ্গম করে নিতে পারলে বাকি পাতায় নাগরীলিপিতে লেখাগুলো অধিকাংশ পড়তে পারা যায়। সহজসাধ্য করে তুলতে লিপির সাথে ছবি জুড়ে দেওয়া আছে। তবে লিখতে গেলে অবশ্যই চর্চা ও সময়ব্যয় প্রয়োজন। যেটি আমি অনুধাবন করেছি।

সময়ের ব্যবধানে নাগরীলিপি একইসময় প্রায় হারাতে বসেছিল। সেটি চর্চা ও গবেষণায় পুনর্জাগরণ করেছেন মোস্তফা সেলিমদের মতো গুনীজনরা। তবে নাগরীলিপি শুধু গবেষণায় আটকে থাকবে-এটি গবেষকদেরও কাম্য নয়। চর্চায় এগিয়ে আসতে হবে অসংখ্যজনকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের অনেককে। যারা এই অমূল্য ইতিহাস ও আবেগের ধনকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় উজ্জীবিত হবেন। তাদের প্রতি অনুরোধ ‘সিলেটি নাগরীলিপি শিক্ষা’ বইটি সংগ্রহ করবেন এবং ইতিহাস রক্ষায় এগিয়ে আসবেন।


লেখক: পিংকু ধর, সহকারী সম্পাদক, সিলেটভিউ২৪ডটকম।