বাঙালি উৎসব পালনে প্রাণখোলা সবসময়। পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস ইত্যাদি একান্ত বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি, মনিপুরী, গারো ইত্যাদি জাতি ও গোষ্ঠীর মানুষের অনুপম আপন দিবস। এরমধ্যে আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি এখন বিশেষ গুরুত্বের সাথে সারা পৃথিবী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। আমরাও বিশ্বের মানুষের সাথে কিছু বিশেষ দিবস পালন করি। সারা দুনিয়ার সকল মানুষের সাথে আমাদের অন্তর্গত মেলবন্ধন হিসেবে ওইসব দিবস গুরুত্ববহ। শিক্ষা, জ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় সচেতন সারা পৃথিবীর মানুষ জেনে গেছে ইংলিশ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৪ ফেব্রুয়ারী ভ্যালেন্টাইন ডে। এই বিশেষ দিবস এখন বিশ্বের মানুষের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের মানুষও উপভোগ করে থাকেন। ভ্যালেন্টাইন ডে বাংলাদেশের মানুষ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করে আপন সাজে। এ দিবসে বিশেষ আগ্রহী দেখা যায় যারা তরুণ-তরুণী, প্রেমিক-প্রেমিকা এবং সদ্য বিবাহ বন্ধনে জড়িয়ে রঙিন স্বপ্ন কল্পনার রঙে কাল্পনিক ডানায় মেখে কল্পনার আকাশে উড়ে বেড়ানো নবদম্পতি। যারা কবি তারা-তো এমনিতেই প্রেমিক। যারা কোনোদিন একটিও কবিতা লিখে প্রকাশ করতে পারেনি তারাও এই দিবসে কবি হয়ে উঠে। ভালোবাসা দিবসে সকল তরুণ কিংবা তরুণী, সকল প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা, সকল স্বামী ও স্ত্রী প্রেমের ভালোবাসার মনকাড়া সব শব্দ খোঁজে, ফুল খোঁজে, মনের মাধুরি মিশিয়ে নিজেকে সাজায় আলোয় আলোয়, সবুজ পত্র পল্লবে, রঙিন বাহারি ফুলে, রঙিন পোশাকে। এখন এ দিনে শিক্ষিত বয়ষ্ক ও প্রবীণদেরও আগ্রহ দেখা যায় যারা মনের দিকে ভালোবাসার রঙে রঙিন। ভালোবাসা দিবসে মানুষ তার প্রিয় মানুষকে ফুল দিয়ে খুশি করতে চায় এবং নিজেও খুশি হয়ে সুখটুকু পেয়ে আকুল প্রাণের তৃষ্ণা মিটিয়ে হাসি আনন্দে গুনগুনিয়ে গান গায়। এমন দিনে চঞ্চল প্রাণ তৃষিত নয়নে প্রিয় মানুষকে বলতে চায় — আমি তোমাকে ভালোবাসি। 

 


যা ভ্যালেন্টাইন ডে তা-ই বাংলাদেশের বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ভ্যালেন্টাইন ডে'র উৎস নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ পাওয়া যায়। তবে ১৪ ফেব্রুয়ারী এখন ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই দিবসে শহরের পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রে এবং বইয়ের দোকানে ভীড় লক্ষ্য করা যায়। মানুষ তার প্রিয় মানুষকে ফুল, বই, শুভেচ্ছা কার্ড ইত্যাদি উপহার সামগ্রী উপহার দেয় ভ্যালেন্টাইন দিবসে। শহরের ফার্স্ট ফুড দোকানে একেক টেবিলে প্রিয় মানুষগুলো মজা করে খায় এই দিনে।

 

প্রায় দুই হাজার বছরের পুরনো ঐতিয্যবহন করা এই বিশেষ দিবসের উদযাপন পর্যায়ক্রমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে অনেক আগে শুরু হলেও বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইন ডে পালন শুরু হয়েছে বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষ দশকে। নিশ্চয়ই মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে, এতো পুরনো এবং দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠা এই দিবসটি এলো কেমন করে? কেমন করে এবং কখন থেকে ভ্যালেন্টাইন ডে বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন শুরু হলো? আসুন ইতিহাস খুঁজে পিছনে ঘুরে এ সম্পর্কে যতোটুকু পাওয়া যায় সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক। 

 

১৪ ফেব্রুয়ারী ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে যে দিবসটি পালন করা হয় সেটি মূলত সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে। এই নামের মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মর্মান্তিক এক ঘটনা। জানা যায়, ঘটনাটি প্রায় দুই হাজার বছরের পুরনো। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলেন রোম সাম্রাজ্যের একজন খ্রীষ্টান পাদ্রী, পাশাপাশি তিনি চিকিৎসক। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন সুন্দর জীবনের জন্য মানুষের কাছে ধর্ম প্রচার করতেন, মানুষকে শিক্ষা দিয়ে চেতনা জাগিয়ে তুলতেন। তখন রোমে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিলো।  এই অপরাধে অভিযুক্ত করে তৎকালীন রোম সাম্রাজ্যের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস তাকে বন্দী করে কারাগারে রাখেন। এদিকে ঘটনাচক্রে বন্দী অবস্থায় সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন তার এক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন অসুস্থ মেয়েকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। ভ্যালেন্টাইনের প্রতি মেয়েটির কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা বেড়ে যায়। একে-তো পাদ্রী হিসেবে কিছু মানুষের মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা আগেই তৈরি হয়েছিলো। তারপর দৃষ্টিহীন মেয়েকে সুস্থ করে তোলার ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের জনপ্রিয়তা আরও বাড়তে থাকে। বিষয়টিতে সম্রাট ইর্ষায় জ্বলেপুড়ে আর ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এরপর সম্রাটের আদেশে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে ২৬৯ খ্রীষ্টিয় সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এরপর ৪৯৬ খ্রীষ্টিয় সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউ প্রথম জুলিয়াস সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন স্মরণে ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন ১৪ ফেব্রুয়ারিকে। এই মতটির পক্ষে খুব শক্ত ভিত্তির কোনো প্রমাণ মিলেনি। একটি মত চালু আছে এরকম - রোমের সম্রাট ক্লডিয়াস খ্রীষ্টিয় ২০০ সালে তার সাম্রাজ্যে বিয়ে প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তার ধারণা ছিলো, যুবকেরা বিয়ে করে ঘরমুখো হয়ে গেলে যুদ্ধ করার জন্যে সৈন্য পাওয়া যাবে না। তাই তিনি ঘোষণা করেন, বিশেষ করে যুবকরা বিয়ে করতে পারবে না। যুবকরা কেবল যুদ্ধ করবে। তখন সম্রাটের এই ঘোষণার প্রতিবাদ করে ভ্যালেন্টাইন নামক এক যুবক। যুবকরা তাদের ভালোবাসার মানুষকে সময়মতো বিয়ে করতে পারবে না, এটা সে মানতে পারেনি। সাহসী বিদ্রোহী ওই যুবকের প্রতিবাদে ক্ষেপেছিলেন সম্রাট এবং এরপর তাকে রাষ্ট্রদোহী মামলায় দেহ থেকে মাথা বিচ্ছেদ করে মৃত্যুদন্ড দেন ১৪ ফেব্রুয়ারী ভোরে। সেই থেকে ভালোবাসার জন্যে ওই যুবকের আত্মত্যাগের স্মরণে ১৪ ফেব্রুয়ারী তারিখটিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এরকম আরও ভিন্ন মত চালু থাকলেও সর্বজন স্বীকৃত ইতিহাস কোনোটি মিলেনি। তবে লোকমুখে প্রচলিত ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার একটি তারিখের মিল পাওয়া যায়। সেটা হলো ১৪ ফেব্রুয়ারী। 

 

কোনো বিষয় নিয়ে সীমা লঙ্ঘন কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়। ভ্যালেন্টাইন দিবস পালনে কোনো কোনো দেশের মানুষের বাড়াবাড়ির কারণে দিবসটি তার পবিত্রতার চেতনা হারিয়েছে বলে পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশে তা নিষিদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশে প্রশাসনিক ভাবে এই দিবস পালন করা হয় না। তবে, সাধারণের জন্যে ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবস পালনে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। খুব বেশি বছর আগে নয়, বাংলাদেশে বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে সাংবাদিক শফিক রেহমান 'ভালোবাসা দিবস' উদযাপন শুরু করেন। শফিক রেহমান ১৯৯৩ খ্রীষ্টিয় সালে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা 'যায়যায়দিন' এর মাধ্যমে প্রথম এই দিবসকে উপলক্ষ করে বিশেষ সংখ্যা যায়যায়দিন - 'ভালোবাসা সংখ্যা' প্রকাশ করেছিলেন। পত্রিকাটি তখন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক নতুন মাত্রার প্রভাব ফেলেছিলো। এরপর থেকে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ১৪ ফেব্রুয়ারী ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবস দিনে দিনে এক আনন্দ উৎসবে পরিনত হয়ে যায়। ভ্যালেন্টাইন ডে এখন বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। তবে বাংলাদেশের মানুষ যেনো ভুলে না-যাই, আমাদের বাংলা নববর্ষ — বৈশাখী উৎসব, বসন্ত উৎসব ইত্যাদি বাঙালি ঐতিয্যের উৎসব আমাদের প্রাণের উৎসব আমাদেরকে হাজার বছরের শিকড়ের খোঁজ দেয়।

 


লেখক : মোহাম্মদ আব্দুল হক, কলামিস্ট ও সাহিত্যিক