কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী লিচুর রাজ্য খ্যাত দিনাজপুর জেলায় পরিপক্ক লিচু বাজারে উঠতে আরও এক মাস বাকি। কিন্তু এখনই বাজারে অপরিপক্ক লিচু বিক্রি করছেন কিছু ব্যবসায়ী। এই অপরিপক্ক লিচুতে রয়েছে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি। এমনকি শিশুদের মৃত্যুঝুঁকিও রয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। তবে বাজারে অপরিপক্ক লিচু বিক্রি হলেও কোনো তদারকি নেই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের।

কয়েকদিন ধরেই দিনাজপুর শহরের বাহাদুর বাজারে অপরিপক্ক লিচু বিক্রি করছেন সদর উপজেলার জালালপুর গ্রামের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন। কয়েকদিন ধরে তিনি প্রায় ৪ হাজারের বেশি অপরিপক্ক লিচু বিক্রি করেছেন। শুধু ইসমাইল হোসেনই নন, দিনাজপুর শহরের বেশ কয়েকটি স্থানে অপরিপক্ক লিচু বিক্রি করা হচ্ছে। এ ছাড়া দিনাজপুর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব লিচু চলে যাচ্ছে বিক্রির জন্য।


ইসমাইল হোসেন জানান, আমার কাছে মাদ্রাজী জাতের লিচু আছে। প্রতি একশ লিচু ২২০ টাকা করে বিক্রি করছি। জেলার বিরল উপজেলার মাধবমাটি গ্রামের বাগান থাকে এনে এসব লিচু বিক্রি করছেন বলেও জানান তিনি।

লিচু কিনতে আসা ক্রেতা সাইফুল ইসলাম বলেন, বছরের প্রথম লিচু আজ বাজারে দেখলাম। এই সময়ে বাজারে লিচু পাওয়া যাবে তা আমার ধারণা ছিল না। লিচুগুলো ঠিকমতো পাকেনি। খেতেও টক।

বিরল উপজেলার মাধবমাটি গ্রামে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক লিচুচাষি বলেন, আমাদের এই গ্রামের লিচু সাধারণত বাজারে প্রথম দিকে ওঠানোর টার্গেট নেওয়া হয়। এর জন্য ফাইটার, ক্যারোটে, যুবাস, রিভা, এমিস্টার টপসহ ইত্যাদি কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। এতে লিচু পরিপক্ক হওয়ার আগে গায়ে রং চলে আসে। ফলে ক্রেতারা পরিপক্ক লিচু ভেবে অপরিপক্ক লিচু কিনে নিয়ে যায়।

জানা গেছে, ২০১৫ সালে অতিরিক্ত কীটনাশক দেওয়া অপরিপক্ক লিচু খেয়ে বীরগঞ্জ উপজেলার পাল্টাপুর ইউনিয়নের ধুলট দাসপাড়া গ্রামের গজেন চন্দ্র দাসের ছেলে ফুল কুমার, একই এলাকার সেনগ্রামের মো. আব্দুল হকের মেয়ে মোছা. শামিমা, সনকা গ্রামের মো. আবু তালেবের ছেলে মো. মামুন, সাদুল্ল্যাপাড়া ধোপা ডাঙ্গা গ্রামের মো. রবি চাঁনের ছেলে মো. স্বপন আলী, বিরল উপজেলার মিলন, সামিউল ও সাকিব, খানসামা উপজেলার রিমি, চিরিরবন্দর উপজেলার আবু সায়েম, কাহারোল উপাজেলার ইয়াসমিন এবং পার্বতীপুর উপজেলার জেরিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

২০১৭ সালের ২৪ জুলাই ‘আমেরিকান জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন’র প্রতিবেদনে সেসময় চাষিরা লিচুতে বিষাক্ত কীটনাশক এনডোসালফেন ব্যবহার করায় তা শিশুদের পেটে গিয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রকাশ করা হয়।

তারও আগে ২০১২ সালের ৬ জুন থেকে ২০ জুন পর্যন্ত দিনাজপুর জেলায় মোট ১৩ জন শিশুর মৃত্যু হয়।

দিনাজপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক জানান, বর্তমানে আমাদের দেশে অপরিপক্ক কোনো ফলই খাওয়া ঠিক না। কেননা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ফলকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করার জন্য অত্যধিক পরিমাণ ক্যামিকেল মেশান। এছাড়াও অনেকে ফলের দাম বেশি পাওয়ার জন্য ক্যামিকেল মিশিয়ে আগেই পাকিয়ে বাজারজাত করেন। তেমনই একটি ফল লিচু। অধিক মুনাফার আশায় অসাধু চাষী ও ব্যবসায়ীরা লিচুতে অধিক পরিমাণ ক্যামিকেল মিশিয়ে ফলের রং তাড়াতাড়ি এনে বাজারজাত করেন। এটা খেলে স্বাভাবিকভাবে মানুষের শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে।

দিনাজপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. ডা. এ এইচ এম বোরহান-উল-ইসলাম সিদ্দিকী বলেন, বাজারে যে লিচু পাওয়া যাচ্ছে তা অপরিপক্ক। তাই আমি ভোক্তাদের এই অপরিপক্ক লিচু খাওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করবো। বাগানীরা অতিরিক্ত লাভের আশায় লিচুগুলোতে কীটনাশক প্রয়োগ করে বাজারে বিক্রি করে। এই অপরিপক্ক লিচু খেলে মানুষের সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই অপরিপক্ক লিচু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক শিশুদের জন্য। এমনকি এই লিচু খেলে শিশুর মৃত্যুও হতে পারে।

দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর দিনাজপুর জেলায় ৫ হাজার ৪৮১ হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ হয়েছে। ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৯ হাজার মেট্রিক টন। চলতি মাসের শেষের দিকে প্রথম দফার লিচু বাজারে উঠতে শুরু করবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) মো. খালেদুর রহমান জানান, দিনাজপুরে লিচু ভাঙার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অপরিপক্ক লিচু বাজারে বিক্রি শুরু করেছেন।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর দিনাজপুরের সহকারী পরিচালক মমতাজ বেগম বলেন, কয়েকদিনের মধ্যে দিনাজপুরের লিচু নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে একটা মিটিং অনুষ্ঠিত হবে। সেই মিটিংয়ে লিচু নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের অফিসার মো. মুসফিকুর রহমান বলেন, দিনাজপুর শহরের কয়েকটি জায়গায় অপরিপক্ক লিচু বিক্রি হচ্ছে তা আমরা জেনেছি। এ বিষয়ে কৃষি অফিসের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজের পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। এছাড়াও জেলা নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে