নয়াদিল্লিতে চলতি মাসের শেষ নাগাদ যৌথ পরামর্শক কমিশন (জেসিসি) বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ ও ভারত। বৈঠকে ঢাকার পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন নেতৃত্ব দেবেন। অন্যদিকে নয়াদিল্লির পক্ষে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর নেতৃত্ব দেবেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সামগ্রিক দিক নিয়ে আলোচনা হবে বৈঠকে। আলোচনায় তিস্তা থাকলেও বহুল প্রতীক্ষিত ‘জট’ খোলা নিয়ে সুসংবাদ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

তবে শিগগিরই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফর চূড়ান্ত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। আর সেই সফরে তিস্তা না হলেও অন্য নদীর জট খোলার ইঙ্গিত মিলেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে।


আগামী ৩০ মে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সপ্তম জেসিসি বৈঠকে উভয়পক্ষের দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিশেষ করে বাণিজ্য, কানেকটিভিটি, পানি, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ইস্যুসহ নতুন নতুন অনেক ক্ষেত্রে একে অপরকে সহযোগিতার বিষয় উঠে আসবে। ঢাকার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সফর চূড়ান্ত করাসহ হাজার হাজার কোটি টাকা আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় দেশটিতে গ্রেপ্তার পি কে হালদারকে বাংলাদেশে দ্রুত ফেরত আনতে নয়াদিল্লির সহযোগিতা চাওয়া হবে।

দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস বলেন, দ্বিপক্ষীয় এজেন্ডায় যা যা আছে সবই থাকছে। ট্রেড আছে, কানেকটিভিটি আছে, কমার্স সেক্টর কোঅপারেশন, ওয়াটার কানেকটিভিটি আছে; সেখানে তিস্তা, কুশিয়ারা, ছয়টি অভিন্ন নদীসহ সব থাকবে। আরও অনেক নতুন নতুন ইস্যু আছে। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসছে-আইসিটি রয়েছে, ফুড সিকিউরিটি রয়েছে, রিনিউয়েবল এনার্জি, ক্লাইমেট ইস্যু আছে।

এবারের বৈঠকে তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোনো সুখবর থাকছে কি না-জানতে চাইলে সচিব মাশফি জানান, এখন বা এ বৈঠকে কোনো সুখবর পাওয়া যাবে না। পাশাপাশি সপ্তম জেসিসিতে কোনো এমওইউ বা সমঝোতা স্মারক সইয়ের সম্ভাবনাও নেই বলে জানান তিনি।

মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা শিগগিরই তিস্তা নিয়ে কোনো সুখবরের ইঙ্গিত না দিলেও তিনি জানান, এ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লির সফর চূড়ান্ত হতে পারে। আর প্রধানমন্ত্রী দেশটি সফরে গেলে তিস্তা না হলেও অন্য নদীর ক্ষেত্রে সুখবর পাওয়া যাবে।

কূটনৈতিক সূত্র বলছে, মোমেন-জয়শঙ্কর বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর চূড়ান্ত হবে। আর এটি আগামী মাসের মাঝামাঝি বা শেষ প্রান্তিকে হতে পারে। তাছাড়া বৈঠকে তিস্তা প্রসঙ্গ তোলাসহ আলোচনাধীন কুশিয়ারা নদীর পানি উত্তোলন বিষয়টিতে সুরাহার জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সইয়ের প্রস্তুতির তাগাদা দেবে ঢাকা। হয়তো প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফরে কুশিয়ারা নিয়ে সুখবর মিলবে। অন্যদিকে ছয়টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন ইস্যুতে আগ্রহ দেখাবে ভারত।

২০১২ সালে নয়াদিল্লিতে প্রথম জেসিসি বৈঠকে বসে বাংলাদেশ-ভারত। গত ১০ বছরে মোট ছয়বার জেসিসি বৈঠক হয়। সর্বশেষ ২০২০ সালে করোনা মহামারির মধ্যে ঢাকার নেতৃত্বে জেসিসি ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর দুই দেশের করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় সপ্তম জেসিসি বৈঠক নিয়ে বার বার অনিশ্চয়তা দেখা যায়। প্রায় ১৮ মাস পরে সপ্তম বারের মতো বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো।

গত ১৭ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জেসিসিতে আলোচনার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের জানান, বৈঠকে আমরা সব বিষয়ে আলোচনা করব। দুই দেশের মধ্যে নীতিগতভাবে অনেক সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু এগুলো অনেক ধীরগতি, এগুলোও তুলে ধরা হবে।

ওইদিন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন জেসিসিতে প্রধান এজেন্ডা সম্পর্কে জানান, ট্রেড আছে, বিনিয়োগ আছে, লাইন অব ক্রেডিট আছে, বর্ডার ইস্যু আছে, পানি ইস্যু আছে, যোগাযোগের বিষয় আছে। ভারত-বাংলাদেশ যত দ্বিপাক্ষিক বিষয় আছে সবই থাকবে জেসিসিতে।

জেসিসিতে থাকছে পি কে হালদার ইস্যু>>

চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে নয়াদিল্লি থেকে সপ্তম জেসিসি বৈঠকের চূড়ান্ত বার্তা পায় ঢাকা। জেসিসির দিনক্ষণের বার্তা পাওয়ার ছয় দিনের মাথায় দেশের আর্থিক খাতের অন্যতম বড় কেলেঙ্কারির নায়ক পি কে হালদার ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দেশটির কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) হাতে গ্রেপ্তার হন। স্বাভাবিকভাবে জেসিসিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সামগ্রিক দিক নিয়ে আলোচনা হলেও এবার ঢাকার পক্ষ থেকে পি কে হালদারকে দ্রুত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে ফেরানোর বিষয়টি তোলা হবে। এক্ষেত্রে নয়াদিল্লির সহযোগিতা চাওয়া হবে।

জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বলেন, পি কে হালদারকে দেশে ফেরানোর ক্ষেত্রে জেসিসিতে আমরা আলোচনা তুলব। আমরাতো অবশ্যই চেষ্টা করব তিনি এখান (বাংলাদেশ) থেকে যত টাকা পাচার করেছেন সব ফেরত আনতে। তার ফেরত আনার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দেখছে। আমাদের কাজ হচ্ছে কূটনৈতিক চ্যানেলে তাকে যত দ্রুত ফেরানো যায়, সেটা নিয়ে কাজ করা।

মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তার ভাষ্য, বাংলাদেশের চাওয়া থাকবে যত দ্রুত তাকে ফেরানো যায়। কিন্তু ভারতে হওয়া মামলা ও সেখানে তার যত অপকর্ম আছে সেগুলো সম্পন্ন না করে তারা দেবে বলে মনে হয় না। আমি মনে করি তাকে ফেরত পেতে সময় লাগবে।

গত ১৪ মে ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা ইডি উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অশোকনগরের একটি বাড়ি থেকে পি কে হালদার ও তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। তার গ্রেপ্তারের তিনদিন পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাতে যান ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী। সেদিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ভারতীয় দূত পি কে হালদারকে খুব সহসায় ফেরত না পাওয়ার ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেছিলেন, আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই তাকে ফেরত আনতে হবে। সেদিন পররাষ্ট্রসচিব ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের কথায়ও একই ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

চূড়ান্ত হবে প্রধানমন্ত্রীর সফর>>

গত বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে মার্চে ঢাকা সফর করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। একই বছরের ডিসেম্বরে ঢাকায় আসেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। ওই সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নয়াদিল্লি সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। মৌখিক সেই আমন্ত্রণকে পাকাপোক্ত করতে রমজানের শেষ প্রান্তে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ঢাকা সফর করে গেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। সফরে এসে তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যাকে নয়াদিল্লি সফরের আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানান। সেই আমন্ত্রণ চূড়ান্ত হবে জেসিসি বৈঠকে। উভয়পক্ষ আলোচনা করে দিনক্ষণ ঠিক করবে। আশা করা হচ্ছে, আগামী মাসের মাঝামাঝিতে না হলেও শেষ প্রান্তিকে নয়াদিল্লি সফরে যাবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

এ বিষয়ে সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস বলেন, জেসিসি বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমরা ওদের সঙ্গে আলাপ করে তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারব।

গৌহাটিতে নদী বিষয়ক কনক্লেভে যোগ দেবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী>>

ভারতের আসামের শিংলভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও থিঙ্কট্যাংক এশিয়ান কনফ্লুয়েন্স আগামী ২৮ ও ২৯ মে গৌহাটিতে নদী বিষয়ক কনক্লেভ আয়োজন করেছে। দুই দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। এতে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও থাকবেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, গৌহাটিতে ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ ফরমেটের আয়োজনে দু’দেশের এজেন্ডা ভিত্তিক কোনো আলোচনা হবে না। তবে সাইড লাইনে হয়তো উভয়পক্ষ পানি সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, ওরা আমাদের দাওয়াত দিয়েছে। আমরা অংশগ্রহণ করব। সেখানে হয়তো দুই দেশের নদী কানেকটিভিটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমরা চাইব, কীভাবে নদীপথে কানকিটিভিটি বাড়ানো যায়।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে


সূত্র : ঢাকাপোস্ট